জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী ২০১৯

প্রকাশ | ১৯ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

অপূর্ব কুমার কুন্ডু
একজন রাজনৈতিককর্মী রাস্তায় নামে মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। একজন কবি কবিতা লেখে ভবিষ্যৎকে বর্তমানে ছুঁয়ে দিতে। একজন সাংস্কৃতিককর্মী সংস্কৃত ধারণ ও বহন করে মানুষের স্বপ্ন নির্মাণের লক্ষ্যে। একজন চারুশিল্পী চারুশিল্প সৃজন করেন মহাকালের যাত্রাপথকে সমকালে তুলে ধরতে, সমকালের ক্যানভাসে। এই ক্যানভাস হতে পারে চিত্রকলা (পেইন্টিং), ভাস্কর্য (স্কাল্পচার), আলোকচিত্র (ফটোগ্রাফি), ছাপচিত্র (প্রিন্টিং), মৃৎশিল্প (পটেরি), হস্তশিল্প (হ্যান্ডিক্রাপ্টস), কারুশিল্প (ক্রাপ্টস) কিংবা অধুনা সংযুক্ত স্থাপনাশিল্প (ইন্সটালেশন আর্ট), কৃৎশিল্প (পারফরম্যান্স আর্ট), ভিডিও আর্ট, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ডিজিটাল আর্টসহ নানান শিল্পমাধ্যম। মাধ্যম হিসেবে ঝরনা-নদী-খাল-বিল যত ভিন্নই হোক সবাই যেমন বুকে জল ধারণ করছে এবং দীর্ঘ পাহাড়ি-সমতল পথ পাড়ি দিয়ে সমুদ্রের বিশালতায় মিশে আনন্দে আপস্নুত হচ্ছে অনেকটা তেমনই চারুশিল্পীদের প্রকাশের মাধ্যম এবং বিষয়ের অন্বেষণ। বিষয় শেষ পর্যন্ত মানুষ। মানুষের চাওয়া-পাওয়া, ব্যথা-বেদনা, বাঁচা-মরার নিরন্তন লড়াই, প্রত্যাশা-নৈরাজ্য, ব্যাকুলতা-জিজ্ঞাংসা, যান্ত্রিকতায় নিমজ্জন কিংবা আন্তরিকতায় অবস্থার উত্তরণ তথা জাগতিক মানুষের জীবনের ঘটনার বাস্তবতা, প্রবাহমান শিল্প-চেতনায় ধরা দিচ্ছে চারুশিল্পীদের সৃজিত চারুশিল্পের সৃজননামায়। ৮৫০ জন চারুশিল্পীদের সৃজন কর্মের মধ্য থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি ভালো ৩১০ জন শিল্পীর ৩২২টি শিল্পকর্ম নিয়ে ১ জুলাই থেকে শুরু হয়ে আগামী ২১ জুলাই ২০১৯ পর্যন্ত বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা প্রদর্শন শাখায় প্রদর্শিত হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে ২৩তম জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী ২০১৯। ঊনিশ-বিশের পার্থক্য প্রতিযোগিতার বাজারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু শিল্পের ক্ষেত্রে সেটি ভিন্ন অর্থ। কেউ ভালো অর্থ কেউ মন্দ নয় বরং ভালো তবে অন্যের থেকে একটু বেশি ভালো। ফলে প্রদর্শনী থেকে দেখা সীমিত শিল্পকর্ম নিয়ে লিখতে চাওয়া অর্থ কাউকে বাদ দেয়া নয় বরং নমুনা প্রদর্শনের মধ্যদিয়ে সমগ্রকে তুলে ধরার ব্যাকুলতা যেমন শাপলা সিংহের ইথারনাল এক্সিসটেন্স-২ চিত্রকলাটি দেখলে বোঝা যায় ইন্টারনেটের এই যুগে যোগাযোগ মাধ্যমের বিস্ময়কর তড়িৎপ্রবাহ কতটা তীব্রভাবে মানব মস্তিষ্কের বোধ-বুদ্ধির চেতনাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলছে অলক্ষ্যের লক্ষ্য হয়ে। ময়নুল ইসলামের ভাস্কর্য বাইন্ডিং অফ ফেমে দেখা যায় নাম-যশের আরাম কেদারায় বসে থাকাটা এবং থাকটাকে অব্যাহত রাখতে চাওয়াটা সময়ে সময়ে কতটা নির্মম যাতনা। শারদ দাশের উই আর গোইং ফাস্ট !!! ভাস্কর্যে পরিষ্কার, চোখে কপালে তুলে দৌড়ালে গন্তব্যের দেখা সব সময় মেলে না। স্থাপনা শিল্পের তাজরিয়ান তাবাসসুমের রুদ্ধশ্বাস পরিষ্কার, কংক্রিটের এই নগরে জীবনের নাভিশ্বাস ওঠার দশা। তাহেরা তানজিম যুথির প্রতিবিম্ব ক্রাক্টরস বোঝায়, দেখাটা পরিষ্কার হলে দেখানোটা পরিষ্কার হয়। শাহরিন শবনেমের শহরজীবনের প্রতিচ্ছবি আলোকচিত্র বোঝায়, সাত রং মিলেই সাদা হয় এবং সপ্ত রংকে কতটা এঁটে-সেঁটে থাকতে হয় যেমনিভাবে নগরজীবনে নাগরিকদের থাকতে হয়। পলাশ ভট্টাচার্যে শক্তি ভিডিও ইন্সট্রাশন বোঝা, শক্তির রূপান্তরকে চেষ্টা করলে ধরা যায়, আফসানা শারমিনের সমব্যথা!!! ভিডিও ইলাসট্রেশন বোঝায়, মানুষই মানুষকে দেবে শেষ পর্যন্ত সহায়। ড. মো. আমিরুল মোমেনীন চৌধুরীর ঢাকা ট্র্যাজেডি-১ বোঝায়, প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ প্রকৃতির প্রতিশোধ হয়েই ধরা দেয়। সাগরদের অবচনীয় স্মৃতির মহড়া-৩ ইন্সটলেশন যেমন মানুষের অসহায়ত্বকে তীক্ষ্নভাবে চিনিয়ে দেয় তেমনি উর্মি রায়ের আলোর পথে-৬ আলোকচিত্র বুঝিয়ে দেয়, সভ্যতার ক্রমবিকাশে আলোকের উপস্থিতি আলোকময়। নিহার রঞ্জন সিংহের মুখ-৭ সিরিগ্রাফিতে পরিষ্কার, মুখোশের তলে মুখগুলো কীভাবে ফ্যাকাশে হয়ে যায় আবার সুজন মাহাবুবের তৈল সমাচার কৃৎশিল্প বোঝায়, একমাত্র মোসাহেবী করে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছানো সত্যিই দায়। দায় কিংবা বিদায়ের প্রশ্ন না বরং প্রশ্নটা সময়ের সঙ্গে আত্তীকরণের। যে কারণে ১ জুলাই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলাম বলেন, 'আমরা শুধু রংতুলিতে ছবি এঁকেছি। এখন আইপ্যাডসহ বিভিন্ন ডিজিটাল মন্ত্রের মাধ্যমে রংতুলি ছাড়াই ছবি আঁকা যায়। তাই শিল্পীদের তখন প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করতে হয়' বিশেষ অতিথি হয়ে বিশিষ্ট শিল্প সংগ্রাহক আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, 'গেস্নাবাল শিল্পকলার পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এক ধরনের শিল্পকলা প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসানসহ আমাদের শিল্পীরা যে নতুন ধারা প্রবর্তন করেন সেটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চেয়ে অনেক বেশি মানসম্মত'। ৮টি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার প্রদানের বিচারকমন্ডলীর সভাপতি শিল্পী আব্দুল শাকুরশাহ বলেন, 'তরুণদের পুরস্কারপ্রাপ্তি কাজে উৎসাহ জোগায়'। অনুষ্ঠানের সভাপতি এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, 'প্রদর্শিত শিল্পকর্মের দৃশ্যত শিল্পীরা সমকালীন বাস্তবতা, সামাজিক জটিলতা ও অসঙ্গতি এবং এসবের মধ্যে প্রকৃত সমাধান খুঁজে বের করার প্রয়াসকে তাদের শিল্পচর্চায় প্রাধান্য দিয়েছেন। অনুরাগী দর্শকদের ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এই ২৩তম চারুকলা প্রদর্শনীর মিলনমেলায়।