বর্ণবাদবিরোধী মানবতাবাদী সাহিত্যিক টনি মরিসন

প্রকাশ | ০৯ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
টনি মরিসন একজন বিশ্বখ্যাত মানবতাবাদী সাহিত্যিক ও সাংবাদিক, বর্ণবাদবিরোধী বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৯৩ সালে। আর পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৮৮ সালে। টনি মরিসনের মতো আরেকজন নোবেল বিজয়ী মার্কিন নারী লেখক পার্ল এস বাক। বিশ্বসাহিত্যের একজন অসাধারণ লেখক তিনি। তিনি একজন জীবনবাদী ঔপন্যাসিক। তার বিখ্যাত উপন্যাস গুড আর্থ। মাটি ও মানুষের প্রতি তার যে ভালোবাসা, প্রকৃতির প্রতি যে তার গভীর টান, তা তার এই উপন্যাসের মাধ্যমে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই উপন্যাসে বাকের বর্ণনা ভঙ্গি অসাধারণ। ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে চীনের আর্থ-সামাজিক অবস্থা অতি সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এই উপন্যাসে। তখনকার গণচীনের জমিদারি প্রথা দাসপ্রথা মানুষে মানুষে বৈষম্যকে তিনি জীবন্ত করে ফুটিয়ে তুলেছেন। আমরা যদি বিশ্বসাহিত্যের দিকে তাকাই, বিশেষ করে কথাসাহিত্যে, তা হলে অবাক হই এই ভেবে যে, যারা নোবেল বিজয়ী তাদের সাহিত্যে জীবনদর্শন ভাষাশৈলী চরিত্র সৃজন এক অসামান্য ব্যঞ্জনায় সিক্ত। যা পাঠককে নিয়ে যায় ভিন্ন এক চিন্তার জগতে। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, টমাস হার্ডির দ্যা মেয়র অব ক্যাস্টারব্রিজ, আই জ্যাক বাসিভিস সিঙ্গারের শোশা, গুস্তাভ ফ্লেয়বারের মাদাম বেভোরি, টলস্টয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস ও আনাকারিনিনা, মেক্স্রিম গোর্কির মা, গাও ঝিংজিয়াং এর সোল মাউন্টেন এবং গার্বিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিসু্যাড বা শত বছরের নিঃসঙ্গতা। এসব উপন্যাস পড়ার পর মনে প্রশ্ন জাগে আমরা কী লিখি আর তারা কী লিখেছেন। তাদের জীবনবোধের গভীরতা ও ভাষার গতিশীলতাই অন্যরকম। লেখালেখি যে একটি শ্রমসাধ্য কাজ, সাধনা, বিষয়টি মেধা-মননের তা আমরা বাংলাদেশের লেখকরা ভুলে যাই। টনি মরিসনকে 'নিখুঁত লেখক' হিসেবে বর্ণনা করা হয়, যিনি 'অক্ষরসম্পন্ন বিশ্বকে সমৃদ্ধ করেছেন'। এ কথাটা সর্বাংশে সত্য। টনি মরিসনের লেখা 'দ্য বস্নুয়েস্ট আই' বর্ণবাদবিরোধী একটি সফল উপন্যাস। লেখক যেন কৃষ্ণাঙ্গদেরই একজন হয়ে এক কৃষ্ণাঙ্গ বালিকার নির্দয় ভাগ্য আর অভিশপ্ত জীবনের কথা বলেছেন। টনি মরিসন নিজে একজন আফ্রিকান-আমেরিকান লেখক হিসেবে এক কৃষ্ণাঙ্গ বালিকার জীবনের অত্যন্ত বেদনাবিধুর গল্প বলেছেন এই উপন্যাসে। বারো বছরের ছোট্ট কালো মেয়েটির জন্য কালো তো কেবল গায়ের রং নয়, কালো তার জীবনের এক অভিশাপ। কালো তাকে নগণ্য, মূল্যহীন বানায় প্রতি মুহূর্তে। কালো যেন তাকে নোংরা আর অপবিত্র করে সব সময়। তাই সে চায় নীল চোখ, সাদা ইউরোপিয়ানদের লালচে চুল আর নীল চোখ। সমাজে সৌন্দর্যের প্রতীক যে নীল চোখ, বিজ্ঞাপন আর বিলবোর্ডে উলিস্নখিত সেই নীল চোখ, টেলিভিশনের নায়িকাদের মতো মনোমুগ্ধকর সেই নীল চোখ। নিজেকে সে আপাদমস্তক বদলে ফেলতে চায়। তার যে বর্ণের জন্য, গড়নের জন্য সে আজ অবহেলিত, মা তাকে ভালোবাসে না, কেউ প্রশংসা করে না, সেই বর্ণ আর গড়ন বদলে ফেলাই যেন জীবনের মূল কেন্দ্র হয়ে যায় তার। উপন্যাসটি কেবল বর্ণবৈষম্যের ওপর চিত্রিত কোনো সাহিত্যসৃষ্টি নয়, জীবনে অর্থনীতির প্রভাবও স্পষ্ট দেখানো হয়েছে এখানে। এক অসাধারণ বর্ণবাদবিরোধী কণ্ঠস্বর এই উপন্যাস। লেখালেখির মাধ্যমে বর্ণ বৈষম্য, লিঙ্গ বৈষম্য, শ্রেণি বৈষম্য, জাত বৈষম্য বিশ্ব থেকে দূর করার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। বর্ণবাদবিরোধী আরেকজন লেখক ছিলেন নাদিম গর্ডিমার। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার লেখক এবং একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। তিনি লেখালেখির মাধ্যমে এবং রাজনৈতিকভাবে বর্ণবাদকে মোকাবিলা করেছেন। বর্ণবাদবিরোধী ও মানবতার এক উজ্জ্বল কণ্ঠস্বর তিনি। একইভাবে টনি মরিসনও। টনি মরিসনের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যে, ১৯৩১ সালের ১৮ ফেব্রম্নয়ারি। গত ৬ আগস্ট, ২০১৯, ৮৮ বছর বয়সে আমেরিকায় তার মৃতু্য হয়। ১৯৪৯ সালে তিনি লরেইনের উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অনার্স গ্রাজোয়েট হন। এখানে বিশেষভাবে উলেস্নখ্য, ওটা ছিল একটি শ্বেতাঙ্গ স্কুল। ওই সময়ে তিনিই ছিলেন একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রী। তিনি উইলিয়াম ফকনারের ওপর গবেষণা করেন। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস দ্য বস্নুয়েস্ট আই। এর তিন বছর পর ১৯৭৩ সালে বের হয় দ্বিতীয় উপন্যাস সুলা। দুজন কৃষ্ণাঙ্গ মহিলার বন্ধুত্বকে কেন্দ্র করে উপন্যাসের কাহিনী গড়ে উঠেছে। এই উপন্যাস টনির স্বপ্নকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যায়। পাঠক ও সমালোচকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে। লেখক খ্যাতির জন্য তাকে অপেক্ষাও করতে হয়নি। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় তার আরও নয়টি উপন্যাস। ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত হয় উপন্যাস সং অব সলোমান। এই উপন্যাসে একজন কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষের ওপর আলোকপাত করা হয়। ১৯৮১ সালে প্রকাুিশত হয় টারবেরি। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত বিলাভেড উপন্যাসের জন্য পরের বছরই তিনি পুলিৎজার পুরস্কার পান। একই উপন্যাসের জন্য পান আমেরিকান বুক অ্যাওয়ার্ড। ১৮৬০ সালের একজন কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকার কঠোর জীবন ছিল এ উপন্যাসের বিষয়বস্তু। যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এই দাস কেনটাকি থেকে ওহাইও পালান। এরপর ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় জাজ, ১৯৯৪ সালে প্যারাডাইজ। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় তার নাটক ড্রিমিং ওস্মোট। টনি মরিসনই প্রথম আপ্রিকান-আমেরিকান মহিলা যিনি ১৯৯৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। মার্কিন সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৯৬ সালে পান ন্যাশনাল বুক ফাউন্ডেশনের মেডেল অব ডিস্টিংগুইশড কন্ট্রিবিউশন সম্মাননা। ২০১২ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা প্রেসিডেনসিয়াল মেডেল অব ফ্রিডমে ভূষিত করেন। কর্মজীবনে টনি মরিসন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেছেন। কাজ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশনা সংস্থা র?্যানডম হাউসে সম্পাদক হিসেবে। যে কজন লেখক আমেরিকান সাহিত্যে মানবিকতা প্রাধান্য দিয়ে ভাষার প্রতি দরদ নিয়ে লিখে গেছেন, টনি মরিসন তাদের একজন। তার বর্ণনাশৈলী আর সম্মোহনী গদ্য পাঠককে আকৃষ্ট করে সহজেই। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, আত্মতৃপ্তি কখনো কখনো মানুষের এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সে আর নতুন কিছু করার কথা ভাবতে পারে না। আত্মতৃপ্তি যদি কঠোর পরিশ্রমের ভেতর দিয়ে আসে তবে ক্ষতি নেই। কারণ কঠোর পরিশ্রমের সামনে কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। মানুষ যদি অতীতের ভুলভ্রান্তি এবং সত্য-মিথ্যা শনাক্ত করার কৌশল রপ্ত করতে পারে, তবে সাফল্য ধরা দেবেই। তার মতে, আমি 'কৃষ্ণাঙ্গ ও নারীবাদী' এই দুটো বিশেষ শব্দের সংমিশ্রণে বেড়ে উঠেছি। তিনি আরো বলেছেন, আমি মানুষের হৃদয়ের নৈতিক ইচ্ছায় বিশ্বাস করি। বিশ্বাস করি সৌন্দর্যের আহ্বানে। প্রত্যেককে জানতে হবে, যদি পৃথিবীকে বাঁচাতে না-ও পার, অন্তত তাকে ভালোবাসো। এই বিপর্যস্ত পৃথিবীকে আর কষ্ট দিও না। এটা সত্য শ্বাস নেয়ার সক্ষমতা ক্ষমতাও হারাতে বসেছে আজকের পৃথিবী। একে আর আঘাত কোরো না। চিহ্নিত করো সেই সব অমানুষদের যারা এই সুন্দর পৃথিবীটাকে এলোমেলো করে দিতে চায়। সম্পদ ও বিলাসিতার মোহ, লোভ, অন্যের ওপর দখলদারি করার গোপন বাসনা আর ভবিষ্যৎকে অবহেলা করার চিন্তা দূর করে ফেলো জীবন থেকে। ঘৃণার কথা ভুলে গিয়ে আজ ভালোবাসো সবাইকে। তার লেখালেখি সম্পর্কে কথা হচ্ছে, আমি মোটেও রাজি নই, অন্য মানুষের পরামর্শে আমার লেখার আঙ্গিক বদল করে জটিলতা সৃষ্টি করা। লেখালেখিতে আমি নিজেকে একটি বিশেষ চিন্তায় আবদ্ধ না রেখে চেষ্টা চালিয়েছি বহুমুখি চিন্তার শিল্পরূপ দিতে। কোনো রাজনৈতিক ভাবাদর্শের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে, লেখক নিরপেক্ষ কিনা, সেটা পাঠকের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এ ব্যাপারে তার উপদেশ, নিজের গল্প নিজেকে তৈরি করার জন্য সব সময়ই মনের ভেতরকার কথা শুনতে হবে। তুমি কে এবং কী তোমার দায়িত্ব তা খুঁজে বের করতে হবে। আর এটা সম্ভব হলেই নিজের গল্পের নির্মাতা হতে পারবে নিজেই। হতে পারবে মহৎ লেখক।