রবীন্দ্রনাথ বাঙালির অহংকার

প্রকাশ | ০৩ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

তারাপদ আচাযর্্য
বহুমাত্রিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালি জাতির অহংকার। তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক, শিল্পী ও সঙ্গীতজ্ঞ। রবীন্দ্রনাথ প্রথমত ও প্রধানত কবি। সাহিত্যের পাশাপাশি তার গান অমূল্য সম্পদ। তিনি আমাদের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা। জীবন ও জগতের অশেষ রহস্য আর সৌন্দযর্ই তাকে বেশি করে টানবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু লৌকিকের চেয়ে অলৌকিকের প্রতি, সীমার চেয়ে অসীমের প্রতি তার আগ্রহের পাল্লাটি ঝুঁকে আছে সারাক্ষণÑ এ রকম যারা ভাবেন, তাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের যে ইমেজ তা ভয়াবহভাবে খÐিত। অথচ তার বাস্তবতাবোধ যে কত সূ² এবং কতখানি সতকর্ মন নিয়ে তিনি মানুষকে বিচার ও মূল্যায়ন করেছেন তা তার গদ্য রচনাসমূহের নিবিষ্ট পাঠকরা জানেন। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-সাধনা সম্পকের্ প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-সাধনা চিরদিনই সাময়িক পত্রিকা আশ্রয় করিয়া সাথর্ক হইয়াছে। অন্তরের ভাবনাকে ভাষায় মূতির্দান করিবার প্রয়াস মানুষের অন্যতম আদিম ধমর্। বহিজর্গতের কাছে আত্মপ্রকাশের প্রবল আকাক্সক্ষা হইতেছে সাহিত্যে সৃষ্টির মূল সূত্র। বালক কবির আত্মপ্রকাশের সুযোগ মিলিল জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব নামে এক ক্ষুদ্র মাসিকপত্রের আনুক‚ল্যে।’ রবীন্দ্রনাথ কেবল সাহিত্য সাধকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন রাজনীতিমনস্ক। এ ছাড়া শিক্ষা ও কৃষিব্যবস্থা নিয়ে তার ছিল বিশেষ চিন্তা। এ বাংলায় সমবায় ব্যবস্থা তিনিই প্রবতর্ন করেন। বহুমাত্রিক রবীন্দ্রনাথ আমাদের নমস্য। রবীন্দ্রনাথ ধমর্ বলতে মানসিক উৎকষের্র কথাই বলেছেন। রবীন্দ্রনাথের ধমির্চন্তা সম্পকের্ বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী সন্জীদা খাতুন বলেছেনÑ ‘ বিজ্ঞানসম্মত নৈসগির্ক সত্যগুলিকে স্বীকার করে মানস-উৎকষর্ সাধনের ধারায় মানবপ্রেমনিষ্ঠ মিলনের পথকেই ধমের্র পথ মনে করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তবে, ধমীর্য় মূল্যবোধের মৌলিক ঐক্যের দরুন রবীন্দ্রনাথের সমগ্র সাহিত্যকমর্ প্রকাশিত ধমর্ভাবনার বিচারে একটি নিগূঢ় ঐক্যও দুলর্ক্ষ নয়। আজীবন অভিজ্ঞতায় অজির্ত বিচিত্র উপলব্ধিতে শেষ পষর্ন্ত মানব মিলনের পথেই তার ধমের্র পথ হয়ে উঠেছে।’ রবীন্দ্রনাথের ধমর্ভাব মানুষের কাছে সবক্ষেত্রেই সমপির্ত। মানুষের যিনি মঙ্গল করেন তিনি এই ‘মঙ্গলবিধাতা’ ভগবানরূপী আদ্যাশক্তি। রবীন্দ্রনাথ যে সমাজধমের্র ভিতর দিয়ে পারিবারিক পরিবেশে বড় হয়েছেন প্রসঙ্গত সে পরিবার তৎকালীন আচার সংস্কৃতিকে চচির্ত জীবনের প্রয়োজনশীলতার ভিতর দিয়েই জেনেছে। রবীন্দ্রনাথের ধমর্ নিয়ে আমাদের সারসত্তা পরিষ্কার করে যেÑ তার ধমির্চন্তার মূলে আছে মানবিকতা দেশপ্রেম কল্যাণ এবং মানুষকে মানুষ ভাবার মৌলিক পথ ও মত। স্বাধীনতা পূবর্ সময়ে পাকিস্তান সরকার কতৃর্ক রবীন্দ্রনাথকে পূবর্ বাংলায় নিষিদ্ধ করার বিষয়টি ছিল রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক। তখন রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করে মুসলিমপ্রধান পূবর্ বাংলায় তার গান-কবিতা নিষিদ্ধ করার অপপ্রয়াস চালানো হয়েছিল। কিন্তু এ দেশের প্রগতিশীল সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, কমীর্রা তা রুখে দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ যে ব্রাহ্ম এটা অনেকেই জানেন না। আজ যে আমরা বাংলা নববষর্ তথা পহেলা বৈশাখ উদযাপন করি, রমনা বটমূলে যে ছায়ানটের অনুষ্ঠান হয়, সেখানে রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে শুরু করা হয়। ওই দিন দেশব্যাপী নানা অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া হয়। দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে কেবল পহেলা বৈশাখ কিংবা রবীন্দ্র জন্ম-মৃত্যু দিবসেই নয় প্রায় প্রতিদিনই রবীন্দ্রনাথের গান বাজে। দেশের সবক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে রবীন্দ্রনাথ অবশ্য-পাঠ্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্য সাধনার পাশাপাশি পরাধীন জাতির মুক্তির চিন্তা প্রথম থেকেই করেছেন। তিনি বাংলার অসহায় মানুষের পাশে গিয়ে দঁাড়িয়েছেন। তিনি ছিলেন একজন মানবতাবাদী মনীষী। স্বদেশের রাজনৈতিক-অথৈর্নতিক বাস্তবতাকে তিনি কেবল অনুধাবনই করেননি, ভবিষ্যতের মঙ্গলামঙ্গল ও উত্তরণের সম্ভাবনার আলোকে তাকে বিচারও করে দেখেছেন। দৃষ্টি হয়তো অনেকেরই ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো অন্তদৃির্ষ্ট ছিল না তাদের। সে কারণে সমসাময়িক রাজনৈতিক ব্যক্তিবগর্ বাহ্যিক প্রলেপ লাগানো কৃষি সমাজের ভেতরের ক্ষতটি দেখতে পাননি। রবীন্দ্রনাথই প্রথম দেশের মানুষের দিকে যথাথর্ সহমমীর্ চোখে তাকান, পীড়িত হন এবং সেই পীড়ন থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার উপায় অনুসন্ধান করে ফেরেন। আজ এ কথা বলতেই হয় যে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি দরদ ও ভালোবাসা ক’জন লেখকের আছে। জমিদার-নন্দন হয়ে বাংলার পথে-প্রান্তরে নদী তীরে ধুলোমলিন কৃষকের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর কী এমন দায় ঠেকা ছিল তার। তিনি লিখেছেন গোরার মতো উপন্যাস। সোনারতরী, বলাকা, গীতাঞ্জলির মতো কাব্যগন্থ। আর সংগীতের তো তুলনায়ই নেই। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ যতগুলো কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন গীতাঞ্জলি তার অন্যতম। মূলত এই কাব্যগ্রন্থই তাকে বিশ্বব্যাপী সাহিত্যখ্যাতি এনে দেয়। তার জীবনবোধ জীবনচেতনা জীবনোপলব্ধি এবং জীবন জিজ্ঞাসা ও জীবনের গভীরতা সবই এই কাব্যগ্রন্থের মধ্যে নিহিত। মানবজাতির সমস্ত প্রেরণার ছেঁায়া তার এই গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থে রয়েছে। গীতাঞ্জলির গীতি কবিতাগুলো একটি মহত্তর ও উন্নত সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। ধমর্ আর দশের্নর গভীর সম্মিলন ঘটেছে তার কবিতায়। এগুলো মূলত গান। এ ছাড়া এগুলো সৃষ্টিচেতনা-সমৃদ্ধ গীত রসে ভরপুর। গীতাঞ্জলি প্রথম বাংলায় প্রকাশিত হয় ১৯১০ সালে। পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ইংল্যান্ড ভ্রমণের সময় গীতাঞ্জলি অনুবাদ করেন ১৯১২ সালে। গ্রন্থাকারে তিনি ইংরেজি গীতাঞ্জলির নাম দিয়েছিলেন সং অফারিংস। ইংরেজিতে গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালে। রবীন্দ্রনাথের বন্ধু আইরিশ কবি ডাবিøউবি ইয়েটস অতি যতœসহকারে গভীর মমত্ববোধ ও আগ্রহ নিয়ে এই গ্রন্থের ভ‚মিকা লিখে দেন। গীতাঞ্জলি প্রথমে লন্ডনে প্রকাশ পায়। এরপর ১৯১৩ অথার্ৎ একই বছর ইউরোপে এর পরপর তিনটি সংস্করণ প্রকাশ পায়। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে, গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পান। অবশ্য ইয়েটস নোবেল পুরস্কার পান ১৮২৩ সালে। এশিয়া মহাদেশে রবীন্দ্রনাথই সবর্প্রথম সাহিত্যে নোবেল পান। তিনি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় গীতাঞ্জলি প্রকাশিত হয়েছে। চীনে গীতাঞ্জলি অনুবাদ করেছিলেন জি বিং জিন, বাই কাওয়ানসহ আরও অনেকে। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থে তার জীবনবোধ, প্রেমবোধ, নিসগর্ চেতনা, সৌন্দযর্ বোধ, মানবাত্মা সম্পকের্ গভীর উপলব্ধির প্রকাশ। পাশাপাশি তার মানবতাবাদ ও ঈশ্বর বন্দনা অত্যন্ত উজ্জ্বল হয়ে ধরা দিয়েছে। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান প্রমুখ বাংলা গীতি কবিতার ভুবনকে উল্লেখযোগ্যভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। তবে এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথই বেশি কাজ করেছেন এবং বিশেষ খ্যাতি অজর্ন করেছেন। সম্পাদক হিসেবেও রবীন্দ্রনাথের কোনো জুড়ি ছিল না। জোড়াসঁাকোর ঠাকুরবাড়ি থেকে যে কয়টি কাগজ প্রকাশিত হয়, তার সবই রবীন্দ্রনাথ প্রধান লেখক ছিলেন, কিছু কিছু কাগজের সম্পাদক ছিলেন। তবে রবীন্দ্রনাথকে পারিবারিক কারণেই কিছু পত্রিকার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করতে হয়েছিল। মূলত দুজন বাঙালির জন্য বাঙালিরা পৃথিবীব্যাপী পরিচিত লাভ করেছেন। একজন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অন্যজন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পৃথিবীতে এমন অনেক ব্যক্তিই আছেন যারা কেবল ব্যক্তি নন, প্রতিষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথ একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান। বাংলা ভাষা সাহিত্য, সংগীত যতদিন থাকবে, বাংলা নববষর্ যতদিন থাকবে, ততদিন রবীন্দ্রনাথ থাকবেন। তিন দেশের জাতীয় সংগীত যার লেখা, যিনি সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন ১০০ বছর আগে তিনি আমাদের নমস্য। তাকে সব ধরনের বিতকের্র ঊধ্বের্ রাখা উচিত। রবীন্দ্রনাথ বাঙালি জাতিসত্তার প্রতীক। এই প্রতীক জাতীয় চেতনাকে ধারণ করে। বাঙালিকে স্বপ্ন দেখায়, জাগ্রত ও উদ্দীপিত করে। যতদিন বাংলা ও বাঙালি থাকবে ততদিন রবীন্দ্রনাথও থাকবেন। তিনি চির ভাস্বর চির অ¤øান।