প্রাক-প্রাথমিক ও নিম্নমাধ্যমিক ইলিশতত্ত্ব

প্রকাশ | ১৬ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

মাসুম বিলস্নাহ
১. আব্বা, কাইল তোমার লগে যামু কইলাম- আট বছরের সুখী তার বাবা বশিরকে কথাটা বলল। বশির ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, মাইয়ার সাহস দেখছোনি! সাঁতোর জানে না, আবার গাঙ্গে যাইতে চায়। মেয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে জবাব দেয়, সাঁতোর জানা লাগবো না, আমি যামু...যামু...তুমি নিবা...নিবা...নিবা......। হ, যাইছ, গিয়া বাপের মাছ ধরোন দেহিছ; হেরপর মাইনষে কইবো- বশির জাইলস্নার মাইয়াও জাইলস্না হইছে... বাবার কথায় ফিকফিক করে হাসে মেয়ে। বাবাও হাসিতে যোগ দেয়। রান্নাঘর থেকে খুন্তি-হাতে ছুটে আসে বশিরের স্ত্রী আয়েশা। খুন্তি উঁচিয়ে কণ্ঠে কৃত্রিম রাগ ফুটিয়ে বলে, বাপ-বেটির সুখ যে বাইয়া-বাইয়া পড়তাছে- একটু থেমে বলল, হাসোন থুইয়া আপনেরা খাইতে আসেন, রাইত ম্যালা হইছে। মেঝের পাটিতে আসন গেঁড়ে পাশাপাশি বসল বাবা ও মেয়ে। ভাতের পেস্নটে মাছ না- দেখে হু-হু করে ওঠে সুখী, ও মা, ইলিশ মাছ কই? আয়েশা ভেংচি কেটে বলে, এঁ্যা আইছে লাট সাহেবের মাইয়া...ভাত জোটে না আবার ইলিশ মাছ!...ছেঁড়ি চুপ কইরা খাইয়া ওঠ। সুখী মায়ের কথায় চুপসে যায়। মাথা নিচু করে আঙুল দিয়ে ভাতের পেস্নটের বুকে আঁকিবুঁকি কাটে। বশির মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আহ্লাদের সুরে বলে, কাইল ইলিশ মাছ জালে উঠলে বাড়ি আনুমনে।...এহন ভাত খাইয়া লও, মা। \হ রাতে রুপালী ইলিশের ছবি মাথায় করে বিছানায় এল সুখী। বাবার সঙ্গে নৌকায় বসে মাছধরা দেখবে। জ্যান্ত ইলিশ এর আগে কখনো দেখেনি সে। কতবার সে বাবাকে বলেছে, কিন্তু বশির ভয় পায় বলে প্রতিবার এড়িয়ে গেছে। এবার বাবা রাজি হয়েছে...। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে সুখী। ভাদ্রের সকাল। সকাল থেকে টিপ টিপ বৃষ্টি। বশির মেয়ের মাথায় ভালো করে শুকনো গামছা জড়িয়ে দেয়। তারপর নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মেয়েকে কাছে টেনে বলে, চল মা, যাই। সুখী পেছন ফিরে মায়ের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে বলে, ও মা, আর কিছু রানবা না কইলাম, ইলিশ মাছ আনলে রানবা... আয়েশা চোখ পাকায়। আঁচল চাপা দিয়ে মুখের হাসি লুকোয়। তারপর মেয়ে চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে থাকে। বশিরের ছোট্ট নৌকার ছইয়ের ভাঙাচোরা অবস্থা দেখে তার আর্থিক দৈন্যদশার চিত্র অনুমান করা যায়, কিন্তু ওইটুকুন মেয়ে ছইয়ের ভেতর ঢুকে বাবার দিকে অভিযোগের তীর ছুড়ে বলে, ও আব্বা, বৃষ্টি জোরে নামলে ভিইজ্যা যামু তো! এট্টু ভিজলে কিছু হইব না রে, মা।- বশির মেয়ের কথায় গুরুত্ব দেয় না। তার মন পড়ে আছে নদীর গভীর জলের বুকে। সে জাল ফেলল। তারপর মেয়ের সঙ্গে গল্পে মেতে ওঠে। গল্প ফুরিয়ে আসে। বশির গান ধরে- মেয়ের চোখে অবিশ্বাস, তার বাবা এত সুন্দর গান জানে! গান শেষে সুখী বলে, ও আব্বা, কহন জাল টানবা? সময় হইলে রে মা.....। সুখী এবার একা দুই হাত তুলে বিড়বিড় করে- আলস্না, আব্বা য্যান এত্তবড় এট্টা ইলিশ মাছ পায়...বিছমিলস্না, আলস্না...আলস্না...বড় একটা ইলিশ মাছ দেও...দেও...! মাথার ওপর সূর্য। সুখীর পেটে খিদে জেগে ওঠে, কিন্তু বাবাকে বলে না। সে নদী দেখে। নদীর দুই পাড় দেখে, এক পাড় তার চেনা, আরেকটা পাড়ে কি আছে? কারা থাকে? সে নদীর বুকে পাখি উড়তে দেখে। আকাশে পেঁজা তুলোর কথা ভাবে। মেঘের ওপারের কথা ভাবে। কী আছে মেঘের ওপারে? এ বেলা বশির মেয়েকে ডাক দেয়, সুখী মা, জলদি আয়, জাল তুলতাছি... সুখী সাবধানে পা ফেলে বাবার কাছে এসে বসে। বশির জাল গোটাতে শুরু করে। এখনো মাছের দেখা নেই। তার মুখে শরতের মেঘ জমে। তখনই সুখী হাততালি দিয়ে চিৎকার করে ওঠে, আব্বা, ইলিশ...ইলিশ...কত্ত বড় ইলিশ মাছ! বশিরও মেয়ের সঙ্গে আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। তার চোখ বিশ্বাস করতে পারে না। ছোট্ট নৌকাটিও দুলে ওঠে! এই প্রথম জ্যান্ত ইলিশ মাছ ছুঁয়ে দেখছে সুখী। সুখীর মনে হলো ইলিশ মাছটি তার দিকে তাকিয়ে আছে, তাকে বলছে, খুকী, তুমি খুশি হয়েছ তো? দ্রম্নত নৌকা বেয়ে তীরের দিকে এগিয়ে গেল বশির। নৌকা ঘাঁটে বেঁধে বাবা ও মেয়ে মাটিতে পা রাখে। একজন ভদ্রলোক বশিরের সামনে দাঁড়াল। বশির পাশ কাটাতে চাইলে লোকটি বলে, তোমার নাম কি বশির? আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি। হ, ক্যান, কী হইছে?-বিরক্তি ঝরে পড়ে বশিরের কণ্ঠে। মাছ কিনব। আইজ মাছ বেচুম না। বেশি টাকা দিব... না। আমি তোমাকে ১ হাজার টাকা দিব, মাছটা বিক্রি করো...তুমি তো প্রতিদিন মাছ ধরতে পারবে... লোকটি পকেট থেকে চকচকে ১ হাজার টাকার নোটটি বশিরের চোখের সামনে মেলে ধরে। ...বশির সংসারের কথা ভাবে, মেয়ের কথা ভাবে, বাজারের দোকানে বাকির কথা ভাবে, ধারের টাকার কথা ভাবে, ১ হাজার টাকার কথা ভাবে...তার চোখের পাতায় নতুন নোটটি ভাসতে থাকে, যেন নোটটি তাকে বলছে- আমাকে নাও, আমাকে নাও...। বশির হাত বাড়িয়ে ১ হাজার টাকার নতুন নোটটি নিয়ে তালুবন্দি করল। হতো বিহ্বল সুখীর চোখে নদীর সবটুকু জল এসে ভরে উঠল। ২. ইলিশ মাছটি কিনে নিয়ে জোর পায়ে ছুটল বিনু সরকার। সরকার বাড়ির বড় ছেলে। শহরে থাকে। অনেকদিন পর বউ-বাচ্চা নিয়ে এসেছে। দুই দিন বাদে আবার চলে যাবে। একটু পর পর মাছটি চোখের সামনে ধরে মনে মনে বলে, তাজা ইলিশ! আমার বিন্দু মা খুব খুশি হবে- বিনু সরকারের চোখ চিক চিক করে ওঠে। সে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল। শরতের আকাশটা এখন ময়লাটে। মাথার ওপর একটা শকুন পাক খেল- খুব কাছাকাছি, তারপর ডানায় শব্দ তুলে অনেকটা ওপরে উঠে গেল। নদীর পাড়ে এখনো আধপোড়া কাঠের মতো চেহারায় জেলে বশির থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে তার মেয়ে সুখীর থুতনি বুকের সঙ্গে মিশেছে, ওখানটায় লাল দাগ বসে গেছে, সুখীর সেদিকে খেয়াল নেই। কেউ কারোর দিকে এখনো তাকায়নি। বশিরের পা দুটো যেন পাথরের পা এখন। চকচকে এক হাজার টাকার নোটটি হাতের মুঠো থেকে আলগা হয়ে রাস্তার ওপর পড়ে। মেয়ে সুখী উবু হয়ে নোটটি তুলে বাবার দিকের বাড়িয়ে ধরল। বশির হাত বাড়াতে সাহস পেল না। বিনু সরকার বাড়ির উঠোনে পা রাখতেই মেয়ে বিন্দু ছুটে আসে। ছোট্ট মেয়েটি খুশিতে লাফিয়ে ওঠে- ইলিশ মাছ! তুমি ধরেছ, বাবা? বিনু সরকার বলেন, না রে মা, সরাসরি জেলে নৌকা থেকে কিনে আনলাম। স্ত্রী অনিতা এসে পাশে দাঁড়াল। স্বামীর দিকে ফিরে বলে, টাটকা ইলিশ! হুম, একটু আগেই ধরেছে। কত নিল? এক হাজার। বেশি নিয়েছে। তা হোক, এরকম তাজা ইলিশ পাবে কোথায়- বিনু সরকার হেসে বলল। অনিতার মুখে সম্মতির হাসি। মাছটি কাটার পর্ব শুরু হলো। মেয়ে বিন্দু মাছ কাটা দেখছে। একটু পর পর বলছে- আমাকে মাথাটা দিবা, লেজটা দিবা...! অনিতা হাসতে হাসতে বলেন, আচ্ছা দিব... রান্নাঘর। কাঠের চুলোয় আগুন জ্বলে ওঠে। গরম তেলে মাছ ভাজার শব্দ শোনা যায়। ইলিশ ভাজার গন্ধে পেটের ভেতর খিদে জেগে ওঠে। আকাশে শরতের মেঘ লুকোচুরি খেলে। মসজিদে দুপুরের আজান হয়। বিনু সরকার সবাইকে নিয়ে দুপুরের খাবার খেতে বসেছেন। মেয়ে বিন্দুর ভাতের পেস্নটে ইলিশ মাছের মাথা ও লেজটা তুলে দিতে বলেন। বিনু সরকারের পেস্নটে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, পাশে এক টুকরো ভাজা ইলিশ যেন এক টুকরো সোনা। বিনু সরকারের মুখের ভেতর জলে ভরে ওঠে। গোপনে সে জল টুক করে গিলে ফেলল। তারপর সে দেখল পেস্নট থেকে মাছের টুকরো উধাও-সেখানে একটি মেয়ের মুখ- তার দিকে তাকিয়ে আছে- মেয়েটির চোখে জল! বিনু সরকারের চোখের পাতায় ভেসে উঠল জেলে বশিরের পাশে দাঁড়ানো ছোট্ট সুখীর মায়াজড়ানো মুখ! বাড়ি ফিরে একটা কথাও বলেনি বশির। মেয়ে সুখীর মুখেও কথা নেই। বশিরের স্ত্রী আয়েশা তাজ্জব বনে গেছে। বলে, বাপ-বেটিরে এক লগে পাইন্নাভূতে ধরছেনি? কোনো উত্তর না পেয়ে রাগে গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে আয়েশা। ওখানে বসেও মেয়ের ওপর রাগ ঝাড়ে, কারণ, মেয়ের কথা মতো সে চুলোয় রান্না বসায়নি। দুপুর হেলে পড়ে। আলুভর্তা আর ডিমভাজি করে রান্নাঘর থেকে উঁচু গলায় ডাক দেয় আয়েশা- খাইতে আসেন আপনেরা! বশির ও সুখী এসে ঝিম মেরে বসে রইল। কারণটা এখনো বের করতে পারেনি আয়েশা। তার মেজাজ চড়ে গেল। শেষতক সে উত্তেজিত গলায় বলল, মাছ ধরতে পারেন নাই বইলস্না মুখে তালা দিয়া রাখছেন? মুইও দেখুম কয়দিন তালা না-খুইলস্না থাকতে পারেন- তারপর মেয়েকে উদ্দেশ করে বলল, নবাবের বেটি ইলিশ মাছের শোকে আধমরা হয়ে গ্যাছে...দেহি কবে জ্যাতা অয়! মায়ের কথা শুনে সুখী ফিকফিক করে হেসে ফেলল। বশিরও মেয়ের হাসির সঙ্গে যোগ দেয়। বাবা ও মেয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। হাসি থামতে চাইছে না। আয়েশা অবাক হয়ে বলে, ও আলস্না, বাপ-বেটি কি পাগল হইয়া গ্যাছে! সবুজ ঘাসের ওপর নেতিয়ে পড়া হলদে রোদটা টুক করে আবার ফিরে এল।