কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে সামাজিক দায়বদ্ধতা

প্রকাশ | ২৩ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

সালাম সালেহ উদদীন
একটি জাতির মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের জন্য যে জিনিসটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো তার শিল্প সাহিত্যের বিকাশ ও প্রসার। যে জাতি ঐতিহাসিক দিক থেকে যত গুরুত্বপূর্ণ তার শিল্প সাহিত্যের ভান্ডারও তত বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ। বাংলাসাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করার জন্য সদ্যপ্রয়াত কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান নিরন্তর কাজ করে গেছেন। সমাজ ও মানুষের জীবনের অসঙ্গতি ও বঞ্চনা এবং জাতিসত্তার শিকড় অনুসন্ধানে তিনি ছিলেন এক নিরলস গবেষক। আর্থ-সামাজিক অবস্থান মানুষের সমাজ জীবন ও মনস্তত্ত্বকে যেভাবে প্রভাবিত করে, মানবিক মূল্যবোধ ও অধিকারকে যেভাবে বিনষ্ট করে, সেখান থেকে সেভাবেই তুলে আনেন রিজিয়া রহমান তার সৃজনশীলতার বাস্তবসম্মত ও নিরীক্ষাধর্মী বক্তব্য। এ ক্ষেত্রে কাহিনী ও শিল্পের আঙ্গিক তুলে আনার ক্ষেত্রে তিনি একজন সফল কথাশিল্পী। গল্প ও উপন্যাসের ক্ষেত্রে আঙ্গিকের নিরীক্ষায় রিজিয়া রহমান সর্বতোভাবে বিবর্তনশীল আধুনিক ও নতুনের দিশারি। শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে সামাজিক দায়বদ্ধতাকে তিনি কখনো উপেক্ষা বা অস্বীকার করেননি। তার প্রমাণ রেখে গেছেন তিনি তার বিভিন্ন লেখায় ও কর্মে। প্রচারবিমুখ ও নিভৃতচারী স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান এই কথাসাহিত্যিক সম্প্রতি পরপারে চলে গেছেন। রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত শুক্রবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে তার মৃতু্য হয়। তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। নারী লেখক, এই বিবেচনায় তাকে কখনো মূল্যায়ন করা হয়নি। নীরবে নিরন্তর কাজ করে বাংলা কথাসাহিত্যে তার অবস্থান শক্ত করেছেন। একজন লেখক হিসেবে তোষামোদি তিনি একদম পছন্দ করতেন না। কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুরবৃত্তিও করেননি তিনি। কলমের শক্তিই ছিল তার প্রধান শক্তি। এই শক্তির জোরেই তিনি আবিষ্কার করেছেন মানুষের ভেতরের মানুষ বাস্তবতার ভেতরের বাস্তবতা। সামাজিক নানা অন্যায়-অসঙ্গতি, প্রতারণা-ভন্ডামি তার গদ্যশৈলী ও বিষয়ের গভীরতা এবং তা বিশ্লেষণের ক্ষমতা ছিল অনন্য সাধারণ। তার ভাষার গতিশীলতা পাঠককে আকর্ষণ ও আবিষ্ট করে সহজেই। পাঠককে নিয়ে যায় ভিন্ন এক জগতে। একজন কথাশিল্পী হিসেবে এখানেই তার সার্থকতা। তার লেখালেখির শুরু কবিতা দিয়ে। তারপর গল্প-উপন্যাস লেখা শুরু করেন তিনি। তার 'নির্জন প্রহরে' গল্পটি আজও পাঠক হৃদয়ে দাগ কেটে আছে। একইভাবে দাগ কেটেছে তার উপন্যাস 'রক্তের অক্ষর' ও 'বং থেকে বাংলা'। মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী একজন নারীর অন্ধকার অসহায় জীবন নিয়ে লেখা 'রক্তের অক্ষর' উপন্যাস। এই উপন্যাসের বর্ণনাভঙ্গি অসাধারণ ও হৃদয়গ্রাহী। এর শুরুটা এমন- 'সকালটা এখানে অকেজো নেশাখোরের মতো ঝিম ধরে পড়ে আছে। পলেস্তারা খসা ইট বের হওয়া দেয়ালের সরু রোদের রেখা বিনা পয়সার খরিদ্দারের মতো বেহায়াভাবে লুটোপুটি খাচ্ছে। ময়লা উপচানো ড্রেনের ধারে কয়েকটা শালপাতার ঠোঙা আর ছেঁড়া তেলচপচপে কাগজ নিয়ে গৃহবিবাদে রত একদল কাক। একটু দূরেই একটা ঘেয়ো কুকুর কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। আর কোনো শব্দ নেই।' কী অসাধারণ বর্ণনা। কান্দুপট্টি পতিতালয়ের সকাল বেলার কী অসাধারণ দৃশ্যকল্প। জাতির মর্যাদার প্রতীক বীরাঙ্গনা ইয়াসমীন এ উপন্যাসে নির্যাতিতা বীরাঙ্গনা হয়ে বলে ওঠেন, ' কতদিন আর বিকৃত রুচি পুরুষদের নির্যাতনের শিকার হয়ে নারীরা নিষ্ফল আর্তচিৎকারে দীর্ণ হবে?' কান্দুপট্টি পতিতালয়ের তথা নিষিদ্ধ পলস্নীর প্রামাণ্য দলিল এই উপন্যাস। নারায়ণগঞ্জের টানবাজার ও পুরনো ঢাকার কান্দুপট্টি পতিতালয় উচ্ছেদের পর, গণিকারা নানা বেশে রাজধানীতে ছড়িয়ে পড়ে। কে গণিকা আর কে ভালো নারী তা চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। দুটো পতিতালয় উচ্ছেদ পরবর্তী নাগরিক পরিস্থিতি ও আধুনিক সামাজিক নারী তথা কল গার্লদের নিয়ে নগরবালা নামে একটি উপন্যাস লেখার জন্য প্রস্তুতি নিই। মাঠ পর্যায়ে বেশ কিছু নারীর সাক্ষাৎকার নিই। লেখা শুরুর আগে বিষয়টি নিয়ে বিশিষ্ট রাজনীতিক ও লেখক হায়দার আকবর খান রনোর সঙ্গে আলাপ করি। তখন তিনি আমাকে রিজিয়া রহমানের রক্তের অক্ষর উপন্যাসটি পড়ার অনুরোধ করেন। রক্তের অক্ষর উপন্যাসটি যেখানে শেষ নগরবালা উপন্যাসটি সেখানে শুরু। উপন্যাসটি ২০০৫ সালে আজকের কাগজের ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হওয়ার পর আপার কাছে কপিও পাঠিয়েছিলাম। তখন আপার সঙ্গে আমার প্রায়ই ফোনে আলাপ হতো, অথচ তার সঙ্গে আমার কোনো দিন দেখা হয়নি। ২০১৪ সালে কথাসাহিত্যিক আফরোজা পারভীন আমার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে নগরবালা নিয়ে কথা বললেন। তিনি তখন রিজিয়া আপার মন্তব্য তুলে ধরলেন। রিজিয়া আপার যে নগরবালা উপন্যাসটি ভালো লেগেছে এবং আফরোজার কাছে প্রশংসা করেছেন, শুনে অবাক হলাম। তিনি তখন আমাকে বলেছিলেন, চরিত্র উপস্থাপনের টেননিক নিয়ে তার দ্বিমত রয়েছে। তবে এটা সত্য তার রক্তের অক্ষর উপন্যাসটি পড়ে আমি আলোড়িত হই এবং অধিক উৎসাহ নিয়ে নগরবালা লিখি। এখানে বিশেষভাবে উলেস্নখ্য আফরোজা পারভীন রিজিয়া আপার একজন বিশেষ অনুরাগী। তিনি মাসে অন্তত দুবার আপার সঙ্গে দেখা করতে তার উত্তরার বাসায় যেতেন। নারী লেখক বললে এ দেশের এক শ্রেণির লেখক ক্ষিপ্ত হন। অপ্রিয় হলেও সত্য অনেক নারী লেখকের লেখা পড়লে বোঝা যায় এটা 'নারীর লেখা।' অথচ রিজিয়া রহমানের গল্প উপন্যাস পড়লে কখনোই মনে হয়নি এটা নারীর লেখা। বিদেশি নারী লেখকদের লেখা পড়লেও তা মনে হয় না। আমাদের দেশের বেশিরভাগ নারী লেখকের লেখা পড়ে একজন পাঠকের এমন ধারণা কেন তৈরি হবে, তার যথাযথ উত্তর খুঁজে বের করতে হবে নারী লেখকদেরই। তার 'বং থেকে বাংলা' উপন্যাস বাঙালির ইতিহাসের ধারাক্রম অতি সুনিপুণভাবে ফুটে উঠেছে। 'উপন্যাসটি লিখেছেন তিনি মূলত বাঙালির ইতিহাসকে সঠিকভাবে সামনে আনার জন্য। বাংলাদেশের জাতি গঠন, বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ ও ভাষার বিবর্তন এ ক্ষেত্রে মূর্ত হয়ে উঠেছে। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বং গোত্র থেকে শুরু হয়ে একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় পর্যন্ত এই উপন্যাসের বিস্তৃতি ও আখ্যান। অবহেলিত, নির্যাতিত-নিষ্পেষিত প্রান্তিক মানুষের জীবনচিত্র অতি সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এই উপন্যাসে। বাঙালি জাতির ইতিহাস ও সংগ্রাম একাকার হয়ে আছে এই উপন্যাসে। \হতার 'উত্তর পুরুষ' উপন্যাসে তিনি চট্টগ্রামে হার্মাদ জলদসু্যদের অত্যাচার ও পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের দখলদারির চিত্র তুলে ধরেন। এতে চিত্রিত হয়েছে আরাকান-রাজ-সন্দ-সুধর্মার অত্যাচার, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বীরত্ব, পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের গোয়া, হুগলি, চট্টগ্রাম দখলের ইতিহাস। তার অন্যান্য গ্রন্থ হচ্ছে- অগ্নিস্বাক্ষরা, ঘর ভাঙা ঘর, অরণ্যের কাছে, শিলায় শিলায় আগুন, অলিখিত উপাখ্যান, ধবল জোৎস্না, সূর্য সবুজ রক্ত, একাল চিরকাল, হে মানব-মানবী, হারুন ফেরেনি, উৎসে ফেরা। রিজিয়া রহমান 'অভিবাসী আমি' ও 'নদী নিরবধি' নামে দুটি আত্মজীবনী লিখেছেন। এতে তিনি ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তার শৈশবের বর্ণনা দিয়েছেন। তার দ্বিতীয় আত্মজীবনীমূলক বই 'নদী নিরবধি' ২০১১ সালে প্রকাশিত হয়। এতে তিনি তার শৈশবের পাশাপাশি লেখক জীবনের বর্ণনা দিয়েছেন। এই দুটো গ্রন্থেও উপন্যাসের আবহ ও আবেদন রয়েছে, ভাষাও অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও গতিশীল। ১৯৩৯ সালে কলকাতার ভবানীপুরে রিজিয়া রহমানের জন্ম। দেশে রিজিয়া রহমানের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ফরিদপুরে। সেই সময় শখের বশে কবিতা লিখতেন। দেশভাগের পর পরিবারের সঙ্গে তিনি এপার বাংলায় চলে আসেন। ১৯৫০ সালে তিনি যখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়েন, তখন তার লেখা গল্প 'টারজান' সত্যযুগ পত্রিকায় ছোটদের পাতায় ছাপা হয়। ১৯৫২ সালে বাবার মৃতু্যর পর তারা ঢাকার শাইনপুকুরে নানার বাড়িতে চলে আসেন। শৈশব থেকে বিভিন্ন পত্রিকায় রিজিয়া রহমানের কবিতা ও গল্প ছাপা হলেও তার প্রথম গল্পগ্রন্থ 'অগ্নিস্বাক্ষরা' ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয়। তিনি ইডেন মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৬৫ সালে এই কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। রিজিয়া রহমান সাহিত্য পত্রিকা ত্রিভুজের সম্পাদক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর তিনি বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর ও জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ষাটের দশক থেকে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্যসহ সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার মূল পরিচিতি ঔপন্যাসিক হিসেবে। সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান রিজিয়া রহমান। আর সরকার চলতি বছর তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। পারিবারিক জীবনে রিজিয়া রহমান মো. মীজানুর রহমানের সহধর্মিণী। মীজানুর রহমান ছিলেন একজন খনিজ ভূ-তত্ত্ববিদ। রিজিয়া রহমানের একমাত্র ছেলে আবদুর রহমান। তার মৃতু্যর মধ্য দিয়ে বাংলাসাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তিনি দূর আকাশে মিলিয়ে গেছেন কিন্তু রেখে গেছেন তার অনন্য সৃষ্টি, যা বাংলাসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারকে জানাই গভীর সমবেদনা।