রিজিয়া রহমান বেঁচে থাকবেন বং থেকে বাংলায়

প্রকাশ | ২৩ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

বাসার তাসাউফ
রিজিয়া রহমানের জন্ম হয়েছিল কলকাতার ভবানীপুরে। কিন্তু কলকাতার কাশিপুর থানার নওবাদ গ্রামে ছিল তাদের বাড়ি। তার বাবার ছিল বদলির চাকরি। সেই সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে কেটেছে তার শৈশবের অনেকটা সময়। তার বয়স যখন ছয় কিংবা সাত তখন বাবা ফরিদপুরে চাকরি করতেন। তাই তার প্রাথমিক শিক্ষাটাও শুরু হয়েছিল সেখানে। পরিবারের লোকজনও সেখানেই থাকত। কিন্তু ১৯৫২ সালে বাবা মারা যান। তার বাবার নাম ছিল আবুল খায়ের মোহাম্মদ সিদ্দিক। তিনি পেশায় ছিলেন ডাক্তার। সংগীতের অনুরাগী ছিলেন। উচ্চাঙ্গ সংগীত শুনতেন। বাবা এস্রাজ বাজাতেন। মাঝে মাঝে বাঁশিও বাজাতেন। তার মায়েরও গান শোনার শখ ছিল- বাবার মতো উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনতেন না। মা শুনতেন সায়গল, জগন্ময় মিত্রের গান। মায়ের পছন্দের শিল্পী ছিলেন কানন বালা। মা নিজে গিয়ে দোকান থেকে হিন্দি আর বাংলা গানের রেকর্ড কিনে আনতেন। মাঝে মাঝে মায়ের সঙ্গে তিনিও যেতেন। আর এমনি এক সাংস্কৃতিক পারিবারিক পরিমন্ডলের কারণে তার মাঝেও এর প্রভাব পড়ে। বাবা মারা যাওয়ার পরে ঢাকার শাইনপুকুরে নানার বাড়িতে চলে আসেন রিজিয়া রহমান। তখন তার এক মামা চাকরি করতেন চাঁদপুরে। তাকে চাঁদপুরের নিয়ে গিয়ে একটি মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি করা হলো। সেখানে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মামাদের পরিবারের কনজারভেটিভ আচরণের জন্য স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। অবশ্য এর পরে এক বছরের মধ্যেই প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে ম্যাট্রিক পাস করে ফেলেন। তাদের পরিবারে একটা সাংস্কৃতিক আবহ ছিল শুরু থেকেই। দাদার লেখাপড়ার অভ্যাস ছিল। দাদার ঘরে সেলফ ভর্তি বিভিন্ন বই ছিল। তাই তাদের পরিবার খুবই উদার ঘরানার ছিল। তবে বাবা মারা যাওয়ার পরে মামাদের পরিবারে এসে লোকজনের কথায় তাকে বোরখা পরতে হয়েছিল। কিন্তু সেটা অল্প সময়ের জন্য। প্রথমে অনেকটা শখের বশে কবিতা লেখা শুরু করলেও সেটা ছিল নিতান্তই নিজের ভালোলাগার বিষয়। বাড়ির কাউকে দেখাতেন না। কাউকে দেখালে তারা হাসতেন। বলতেন, তিনি নাকি অন্য কারো কবিতা দেখে নকল করে লিখেছেন। কিন্তু বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলে তার কবিতার দেখতে চাইত। তখন তিনি লুকিয়ে রাখা কবিতার খাতাটি এনে বাড়ির অতিথির সামনে তুলে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। প্রথমে কবিতা লেখলেও প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল গল্প। ১৯৫০ সালের দিকে কলকাতা থেকে 'সত্যযুগ' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো। সেখানে তার 'টারজান' নামে একটি গল্প ছাপা হয়েছিল। ছাপার অক্ষরে সেটিই তার প্রথম গল্প ছাপা হওয়ার ঘটনা। তখন তিনি প্রাথমিকের গন্ডিটা পার হননি, পড়েন পঞ্চম শ্রেণিতে। বয়স এগারো বছরের মতো। গল্পটি 'সত্যযুগ' পত্রিকায় ছোটদের পাতায় ছাপা হয়েছিল। গল্পটি পড়ে পরিবারের সবাই অনেক প্রশংসা করেছিল। কবিতা লেখা নিয়ে যারা হাসাহাসি করত তারাও তখন উৎসাহ দিতে শুরু করেছিল। 'টারজান' গল্প ছাপা হওয়ার পর অনেকদিন কোথাও কোনো লেখা ছাপা হয়নি। তারপর প্রায় ১০ বছর পরে অর্থাৎ ১৯৬০ সালে 'ইত্তেফাক' পত্রিকায় আবার তার গল্প ছাপা হয়েছিল। 'বিকল্প' নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন, 'ইত্তেফাক' পত্রিকায়ই কিছুদিন সেটা ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়েছিল। ১৯৬৭ সালে 'ললনা' নামের পত্রিকায় 'লাল টিলার আকাশ' নামে আরেকটি গল্প ছাপা হয়েছিল। এরপর এই পত্রিকাটিতে আরও অনেক গল্প ছাপা হয়েছে। রিজিয়া রহমানের প্রথম বইয়ের নাম 'অগ্নিস্বাক্ষরা'। গল্পের বই। যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। তার প্রকাশিত বইটি গল্পের হলেও তিনি যখন দেখল তার যা বলার কিংবা যেসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে চান গল্পে পুরোপুরি তুলে ধরা সম্ভব নয়। এ জন্য কিছুটা বড় পরিসর বা বড় ক্যানভাস প্রয়োজন অর্থাৎ উপন্যাস লিখতে শুরু করলেন। তিনি মনে করতেন, 'গল্প এবং উপন্যাস এ দু'টো বিষয়ই আলাদা। উপন্যাসে বিস্তারিত বলার যে সুযোগটা রয়েছে, গল্পে এমনটা নেই। তবে গল্প কিংবা উপন্যাস যাই হোক না কেন, তা সময়ের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন হবেই। তখন তার ভাষাও ভিন্ন হতে বাধ্য। এ সময়ে এসেও বঙ্কিমের ভাষায় উপন্যাস লিখতে পারি না। কিংবা শরতের মতো গল্পের ভাষা এখন কেউ লিখবে না। তবে এটা মনে রাখতে হবে যে, লেখার ভাষাটা যাতে উন্নত সমসাময়িক হয়।' তার উপন্যাসগুলোর দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে প্রতিটি উপন্যাসেই নির্দিষ্ট এবং স্বতন্ত্র বিষয়কে নিয়ে। কোনোটিতে বস্তিজীবনের কথা, কোনেটিতে নিষিদ্ধপলস্নীর কথা আবার কোনোটিতে উঠে এসেছে বাংলা এবং বাঙালির ইতিহাসের সন্ধান। তার 'ঘর ভাঙা ঘর', 'রক্তের অক্ষর' এবং 'বং থেকে বাংলা' উপন্যাসগুলো এ ক্ষেত্রে উলেস্নখযোগ্য। কোনো লেখকই অভিজ্ঞতার বাইরে গিয়ে লেখে না। অভিজ্ঞতা বিভিন্ন রকমের হতে পারে। 'ঘর ভাঙা ঘর' বস্তির মানুষের গল্প নিয়ে লিখেছেন। এক সময় তার বাসার কাছেই বস্তি ছিল। সেখানকার ছেলেমেয়েরা তার বাসায় আসত। তাদের ক্লেদাক্ত, যন্ত্রণার কথা শুনতেন। তাদের নিয়েই লিখেছেন 'ঘর ভাঙা ঘর' আর 'রক্তের অক্ষর' উপন্যাসের ভাবনাটি তিনি পেয়েছিলেন সম্পাদিত 'বিচিত্রা' পত্রিকার মাধ্যমে। পত্রিকাটি একবার পতিতাদের নিয়ে একটি কভার স্টোরি করেছিল। তখন সেখানে কাজ করত শাহরিয়ার কবির, আনু মুহাম্মদ, শামীম আজাদ। তিনি পত্রিকায় নিউজটা পড়ে শাহাদত চৌধুরীর কাছে গিয়ে বললেন, 'স্টোরিটা আমার ভালো লেগেছে। তখন শাহাদত চৌধুরী বললেন, 'আপনি এই বিষয়ে একটা উপন্যাস লিখতে পারেন। তখন এই কভার স্টোরির যত তথ্য ছিল সব তাকে দিলেন। এইভাবে লেখা হয়েছিল 'রক্তের অক্ষর' উপন্যাসটি। 'বং থেকে বাংলা' উপন্যাসটি লিখেছেন তিনি মূলত বাঙালির ইতিহাসকে তুলে ধরার জন্য। বাংলাদেশের জাতি গঠন ও ভাষার বিবর্তন নিয়ে উপন্যাসটির পরিসর সাজিয়েছেন। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বং গোত্র থেকে শুরু হয়ে একাত্তরের স্বাধীনতা সংগামের বিজয় পর্যন্ত এই উপন্যাসের বিস্তৃতি। বাংলার সাধারণ মানুষ সব সময়ই অবহেলিত, নির্যাতিত এবং উপেক্ষিত। তারা কোনো দিনই অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক মুক্তি পায়নি। এখানে তিনি একই সঙ্গে ইতিহাস এবং একটি জাতি কিভাবে স্বাধীনতার মর্যাদায় এসে দাঁড়িয়েছে তা দেখিয়েছেন।