ভোরের কথা

প্রকাশ | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

নৃপ
পা দুটো ভার ভার লাগছে। দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ ধরে। ঠিক কতক্ষণ জানি না। চারদিক অন্ধকার। ডানপাশে তাকাতে চোখ পড়ল করিডোরের কোণায় লম্বা বেঞ্চের খালি সিটটার দিকে। পাশেই বিশাল খোলা জানালা। চাঁদের আলো জানালা ভেদ করে এসে কিছুটা অন্ধকার দূর করছে। আমি সেখানে গিয়ে বসলাম। আমি যে বেঞ্চটাতে বসে আছি তা বেশ লম্বা। আমার ঠিক পাশেই মুখে কাপড় পেঁচিয়ে একজন গভীরভাবে ঘুমিয়ে আছে। তার ক্লান্ত নিঃশ্বাস এই নীরবতাকে যেন আরো গাঢ় করছে। এভাবে আরো অনেকে ঘুমিয়ে আছে। ওপাশের বেঞ্চেও দু'জনকে দেখতে পাচ্ছি। আরো সামনে দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার। করিডোরের শেষ মাথায় কাচের দরজা। সেখানে মৃদু আলো জ্বলছে। দরজার গায়ে বড় বড় করে লেখা আইসিইউ। আজ আব্বুকে ওখানেই ভর্তি করেছি। ঠিক ক'টায় মনে নেই। দরজাটার দিকে তাকাতে পারছি না। কেন যেন হৃৎপিন্ডের কম্পন বাড়তে থাকে। মনে হয় যেন বুকের পাঁজর ভেঙে সবকিছু বের হয়ে আসবে। ধুঁক ধুঁক শব্দে কান ভার হয়ে আসে। সারা শরীর বরফের মতো ঠান্ডা হতে থাকে। কাঁপুনি শুরু হয় হাত-পা জুড়ে। এ সময় বড় কষ্ট হয় নিঃশ্বাস নিতে। দম বন্ধ হয়ে আসে। দেহের সব শক্তি হারিয়ে যায়। ক্লান্তি লাগে। তবুও ঘুম নেই। জানালা দিয়ে চাঁদটাকে দেখা যাচ্ছে। সাদা মেঘের উপর ভেসে ভেসে মনে হচ্ছে চাঁদটা এখনই কোথাও চলে যাবে। নিয়ে যাবে সব আলো। আমায় রেখে যাবে অন্ধকারে। মৃদু বাতাস বইতে শুরু করল। খুব চেনা এ বাতাস। যেন কানের কাছে ফিস ফিস করে কিছু একটা বলতে চাইছে, গান গাইছে, শব্দ করে নেচে বেড়াচ্ছে। মিষ্টি একটা গন্ধ পাচ্ছি। এ কোনো ফুলের গন্ধ নয়। বাতাসের নিজের গায়ের গন্ধ। এত পথ পাড়ি দিয়ে আসা দেহের ক্লান্ত গন্ধ। \হছোটবেলায় প্রতিবছর গ্রীষ্মের ছুটিতে গ্রামে যেতাম। আমাদের বাড়িটা ছিল এক বিশাল বট গাছের পাশে। তিন দিকে তিনটা বড় বড় ঘর আর মাঝখানে উঠোন। উঠোনের শেষ প্রান্তে কয়েকটা নারকেল গাছ। তার মাঝ দিয়ে ঢালু পথ ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে। উঠোন থেকে যতদূর চোখ যায় ধানক্ষেত। তারপর নদী। রাতের বেলা নদীতে জোনাকি পোকার মতো মিটিমিটি আলোগুলো পালতোলা মাছধরা নৌকা। আব্বুর কোলে কাঁধে মাথা রেখে দেখতাম সেই আলোর খেলা। যেন আকাশের তারাগুলো নেমে এসেছে মাটিতে। আব্বু আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে সারা উঠোন হেঁটে বেড়াতেন আমাকে ঘুম পাড়ানোর জন্য। আর সেই চেনা বাতাস। যেন কানের কাছে ফিসফিস করে কিছু একটা বলতে চাইত, গান গাইত, শব্দ করে নেচে বেড়াত। মিষ্টি গন্ধে ঘুমিয়ে পড়তাম আমি। এ বাতাস আজই বইতে হবে। বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মনে হচ্ছে আমার থেকে সবকিছু দূরে সরে যাচ্ছে। একা হয়ে যাচ্ছি আমি। পেটের ভেতরটা মোচড় দিচ্ছে। ইচ্ছা করছে চিৎকার করে সবার ঘুম ভাঙিয়ে দিতে। হঠাৎ আই সি ইউর দরজাটা খুলে গেল। ভেতর থেকে একজন নার্স বেরিয়ে এলেন। তিনি এদিক ওদিক তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজছেন। ডাকছেন। আমি শোনার চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। শব্দগুলো সব মিলিয়ে যাচ্ছে। শুধু বুকের ভেতর থেকে আসা ধুক ধুক শব্দ আর কানের ভেতর ঝি ঝি পোকার মতো অদ্ভুত শব্দ ছাড়া কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। আমার নাম ধরে ডাকছেন নাতো? আমি কি এগিয়ে যাব? কিন্তু ভয়ে যেতে পারছি না। গলা শুকিয়ে আসছে। এরই মধ্যে ওপাশের অন্ধকার থেকে একজন উঠে দাঁড়ালো। নার্স দ্রম্নত তাকে নিয়ে চলে গেলেন সেই আই সি ইউর রুমটাতে। এতক্ষণ পর যেন নিঃশ্বাস ছাড়লাম। আমি একা নিশাচর নই। নির্ঘুম অনেকেই ঘুমের ভান করে আছে আমার মতো। যারা এখানে আছে তাদের কেউ না কেউ এ দেয়ালের ও পাশে জীবণ-মৃতু্যর সঙ্গে লড়াই করছে। এ এক অদ্ভুত লড়াই। এত গভীর কিন্তু এত নীরব লড়াই, এখানে না এলে কেউ বুঝতে পারবে না। আব্বুর সঙ্গে মন খুলে বহুদিন কথা বলা হয়নি। ঠিক কতদিন তা মনে নেই। শেষ কি কথা বলেছিলাম তাও মনে আসছে না। ভালো করে বহুদিন আব্বুর মুখটাও দেখা হয়নি। চোখে চোখ রাখা হয়নি। আজ আব্বুর মুখটা দেখলাম দূর থেকে। এ যেন অন্য একটা মানুষকে দেখলাম। মুখে খোঁচা খোঁচা সাদা কালো দাড়ি। গালের মাংস শুকিয়ে মুখের চামড়াটা যেন মাথার খুলির সঙ্গে লেগে আছে। কপালে ভাঁজ পড়ে গেছে। চোখ বন্ধ। ভেনটিলেশনের পাইপ লাগানো মুখে। এ যেন স্বপ্ন দেখছি আমি। চিৎকার করে ডাকতে মন চাইল আব্বুকে। যেন আমি ডাক দিলেই উঠে যাবেন। আজ চোখে চোখ রেখে বড্ড কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আব্বুর কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে কানে। কিন্তু শব্দগুলো এক করতে পারছি না। মিলিয়ে যাচ্ছে। আব্বু অফিস থেকে এসে আমার নাম ধরে একবার গলা হাঁকিয়ে ডেকে তার ঘরে চলে যেতেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় যেন প্রতিক্ষায় থাকতাম। সন্ধ্যার নিরস নীরবতা ভেঙে যেত। শব্দে শব্দে মুখরিত হয়ে উঠত সারা বাড়ি। আমি আমাদের চার ভাই-বোনদের মধ্যে সবার বড়। আব্বুর আমাকে এভাবে ডাকার পেছনে আমি এক দায়িত্বভার অনুভব করতাম। আব্বু যেন হাজারো প্রশ্ন করে ফেলতেন এই ডাক দেয়ার মাধ্যমে। আর আমার নীরবতা ছিল তার স্বস্তির উত্তর। ঠিক কবে আব্বু এভাবে আমাকে ডাকা বন্ধ করে দিয়েছিলেন মনে নেই। তবে এটা মনে আছে যেদিন আব্বু আমাকে না ডেকে নীরবে তার ঘরে চলে গিয়েছিলেন, সেদিনের মতো নীরব আমার অন্ধকার ঘর কখনও হয়নি। এরপর থেকে যেন কোনো শব্দ আমার এ অন্ধকার নীরব ঘরটাতে প্রবেশ করতে পারেনি। নীরবতা যত গভীর হয়েছে অন্ধকার ততো কালচে হয়েছে। পৃথিবীতে সবাইকে নানা চরিত্রে অভিনয় করতে হয়। যার চরিত্র যত বেশি তার বিস্তার তত বেশি। আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমাকেও কিছু চরিত্রে অভিনয় করতে হবে। ভুলে গিয়েছিলাম কিছু মানুষ আমাকে ছায়া দিয়ে রেখেছে যাতে করে প্রচন্ড রোদে আমি পুড়ে না যাই, বৃষ্টির শীতল পানিতে আমি ভিজে না যাই, ঝড়ো হাওয়ায় আমি এলোমেলো না হয়ে যাই। আজ যেন মাথার ওপর থেকে সব ছায়া দূরে সরে যাচ্ছে। যেন বহুকাল ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেছে। মিলিয়ে গেছে সব স্বপ্ন। স্বপ্ন সব মিথ্যে। আশা সব সত্যি। মিথ্যে আশাই আসলে স্বপ্ন। মিথ্যে আশা বলতে কিছু নেই। এ অন্ধকারে ঘুমের ঘোরেই কত সময় নষ্ট করে ফেলেছি। আব্বু হাত পেতে দিয়েছিলেন। অন্ধকারে হয়তো দেখতে পাইনি। আজ ইচ্ছে করছে সময়টাকে টেনে ধরে পেছনে নিয়ে যেতে। প্রতিটা মুহূর্তকে আবার নতুন করে সাজিয়ে নিতে মন চাইছে। প্রতিটা ভুলকে শুধরে দিতে মন চাইছে। মন চাইছে, সব না বলা কথাগুলো গিয়ে বলে আসতে আর যা বলেছি সে কথাগুলো ফিরিয়ে নিতে। যা বলেছি তা মনের কথা ছিল না। ওগুলো ছিল অন্ধের কথা। অন্ধকারে সবাই অন্ধ। বড় কষ্ট পেয়েছিলেন আব্বু। আজ তাকে ডেকে মনের কথাগুলো বলতে ইচ্ছে করছে। অন্ধকার হাতড়ে আব্বুর পাতা হাত ধরতে ইচ্ছে করছে। হঠাৎ চমকে উঠলাম। ক্লান্ত চোখজোড়া হয়তো বা বুঁজে এসেছিল। মাথাটা বড় ভার ভার লাগছে। জানালায় মাথাটা হেলান দিয়ে আকাশের দিকে চাইলাম। চাঁদটা কোথায় যেন চলে গেছে। কেমন ভয় হতে লাগল। পাশে তাকিয়ে দেখলাম ঘুমন্ত লোকটা সেখানে আর নেই। ওপাশের পুরো বেঞ্চটাও খালি। অন্ধকারের ভেতরেও সব যেন দেখতে পাচ্ছি আমি। করিডোরের শেষ মাথায় যে কাঁচের দরজা তাতে আর আলো জ্বলছে না। আমার বুকের ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা অনুভব হচ্ছে। পা দু'টো যেন দুই বরফ খন্ড। পুরো হাসপাতালে যেন আমি একা। আমি উঠে দাঁড়ালাম। কাচের দরজাটার দিকে হাঁটতে আরম্ভ করলাম। আমার পায়ের শব্দে যেন পুরো করিডোর কেঁপে উঠছে। আমি কোনোভাবেই পায়ের শব্দ থামাতে পারছি না। কাচের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। আই সি ইউ লেখাটা দেখা যাচ্ছে না। আমি কাউকে ডাকার চেষ্টা করলাম। কিন্তু শত চেষ্টার পরও গলা দিয়ে একটা শব্দ বের হলো না। হাত দিয়ে দরজার হাতল ধরতে চাইলাম। কিন্তু হাতে কোনো শক্তি নেই। আমি আমার হাত দু'টোকে অনুভব করতে পারছি না। নিথর দেহ যেন দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ আমার পিঠে কেউ একজন হাত রাখল। আমি পেছন ফিরে তাকে দেখতে পেলাম। মানুষটাকে অনেক চেনা লাগছে কিন্তু ঠিক কে তা কিছুতেই মনে করতে পারছি না। অনেক আপন, অনেক কাছের কিন্তু ঠিক কে সে তা এ মুহূর্তে মনে আসছে না। আমার হাতটা ধরে এক অন্ধকার করিডোরে নিয়ে এলো সে। অন্ধকার কাটতে দেখতে পেলাম আমি এক ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। আমার সামনে একটা টেবিল। তার উপর একটা চেয়ার। মোমবাতির হলুদ আলোতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি। উপরে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে একটা দড়ি ঝুলছে ঠিক ফাঁসির দড়ির মতো। দেখা মাত্র ভয়ে আমি দু'পা পেছনে সরে এলাম। আমি চেয়ে আছি দড়িটার দিকে। আমার পা থরথর করে কাঁপছে। মনে হচ্ছে পায়ের সব স্নায়ুতন্তুগুলো ছিটকে পা থেকে বের হয়ে আসবে। আমি এখনই পড়ে যাব। আমাকে যে এখানে নিয়ে এসেছে তাকে আঁকড়ে ধরতে চাইলাম। কিন্তু সে তো নেই। কোথাও নেই। পুরো ঘরে আমি একা। আমি দ্বিতীয়বারের মতো মৃতু্য ভয় অনুভব করছি। প্রথমবার অনুভব করেছিলাম আমার ঘরে। আমার বোনের লাল ওড়নাটা সিলিং ফ্যানের সঙ্গে পেঁচিয়ে যখন আমি সেটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম ঠিক তখন। মনে হচ্ছিল আমি ততক্ষণে মরে গেছি। আমি আমার মৃত লাশটাকে দেখতে পাচ্ছি। হাজারো কান্নার সুর ভেসে আসছে কানে। আম্মুর কান্নার সুর। আজ আমি ঠিক এমনটাই অনুভব করছি। আমি ছুটে পালিয়ে যেতে চাইলাম কিন্তু আমার পা দুটো পাথরের মতো অসার হয়ে রয়েছে। দেহটা আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আমি চেয়ে আছি ঝুলন্ত দড়িটার দিকে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছি না আমি। কানে একটা পাখির ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ ভেসে আসছে। এবার সত্যিই বড় চমকে উঠেছি। সারা শরীরে ঘাম। কপালের এক ফোঁটা ঘাম নাকের ওপর দিয়ে বেয়ে পড়ছে। হৃৎপিন্ড ধুঁক ধুঁক শব্দে বাড়ি দিচ্ছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছি। সত্যি সত্যিই দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আমি চারদিকে তাকালাম। পাশের লোকটা এখনও মুখে কাপড় পেঁচিয়ে ঘুমাচ্ছে। ওপাশটা দেখা যাচ্ছে না। আই সি ইউ লেখা দরজাটাতে মৃদু আলো জ্বলছে। আমি জানালার পাশে লম্বা বেঞ্চটাতে বসে আছি। আকাশের চাঁদটা মেঘের ফাঁকে ফাঁকে ভেসে বেড়াচ্ছে। আমি স্বপ্ন দেখছিলাম। কী ভয়ঙ্কর স্বপ্ন! আমার শরীর এখনও কাঁপছে। কোনটা স্বপ্ন আর কোনটা বাস্তব তা বুঝতে এখনও কষ্ট হচ্ছে। একটা পাখির ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ পেলাম। জানালার পাশে কয়েকটা গাছের সারি। সেখান থেকে একটা পাখি উড়ে গেল। \হভোর হতে আর কত দেরি কে জানে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি দিনের আলো ফোটার প্রতিক্ষায়। যখন ছোট ছিলাম ভোর বেলা সবার আগে ঘুম থেকে উঠে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। দেখতে চাইতাম রাতের অন্ধকার কিভাবে দিনের আলোতে রূপ নেয়। কিন্তু কখন যে অন্ধকার কেটে গিয়ে দিনের আলো ফুটে উঠত তা ধরতে পারতাম না। মানুষ ভুলে যায় মনের কালো ছায়া তীব্র আলোতে এক পলকে মুছে ফেলা যায় না। মৃদু আলো তার সরল ভালোবাসা দিয়ে, কোমল স্নেহ দিয়ে দূর করে অন্ধকার। কেটে যায় মনের কালো ছায়া। ভোরের আকাশে মেঘগুলো ছোটাছুটি করত। তাদের নানা রং, নানা আকৃতি। আমি অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। মেঘগুলো আমাকে যেন অন্য এক রাজ্যে নিয়ে যেত। দিনের তীব্র আলো ফোটার আগ পর্যন্ত সে রাজ্যে ঘুরে বেড়াতাম আমি। অনেক বেশি আলো চোখকে অন্ধ করে দেয়। তখন দিন রাত সমান। অনেক চেষ্টা করছি স্বপ্নে দেখা মানুষটাকে মনে করার জন্য। তার চেহারাটা কোনোভাবেই মনে করতে পারছি না। তার হাতের ছোঁয়া আমার কাছে একদম সত্যি মনে হচ্ছে। কোমল তার হাত কিন্তু শক্ত তার আঁকড়ে ধরা। তার গায়ের গন্ধ যেন আমি বহুদিন ধরে চিনি। তার উপস্থিতি যেন আমার মনে এক প্রবল ভরসা এনে দিয়েছিল। তাকে বড়ো খুঁজে বের করতে ইচ্ছে করছে। তাকে খুঁজে পেলে জিজ্ঞাসা করতাম সেই অন্ধকার করিডোরে আমাকে একা ফেলে চলে কেন গিয়েছিল। আইসিইউর দরজাটা পুনরায় খুলে গেল। ভেতর থেকে দু'জন ওয়ার্ডবয় আর একজন ডাক্তার বেরিয়ে এলেন। ওয়ার্ডবয় দু'জন একটা ট্রলি বেড টেনে বের করছে। তার পেছনে সেই লোকটা যাকে নার্স ভেতরে নিয়ে গিয়েছিলেন। ডাক্তার তাদের বাইরে বের করে ভেতরে চলে গেলেন। ওয়ার্ডবয় দু'জন আর লোকটা ট্রলি বেড নিয়ে লিফটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। লোকটার মুখে গোঙানির আওয়াজ পাওয়া গেল। আমার পাশের ঘুমন্ত লোকটা নানা শব্দে ততক্ষণে উঠে পড়েছে। আমি দাঁড়ালাম। আমার দেখাদেখি আমার পাশের লোকটাও দাঁড়াল। আমি এগিয়ে গেলাম ট্রলি বেডটার দিকে। সেখানে যে শুয়ে আছে তার সারা শরীর সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা। তিনি আর নেই। তাই তার লাশ বের করে আনা হয়েছে আইসিইউ থেকে। ওয়ার্ডবয় দু'জন আর লোকটা লাশ নিয়ে লিফটে উঠে পড়ল। আমার ভেতরে এতক্ষণ ধরে পালন করা আস্থা হঠাৎ হারিয়ে যেতে শুরু করেছে। আমি আবার বেঞ্চে গিয়ে বসে পড়লাম। আমার পাশের ঘুম কাতর লোকটা তার কাপড় ভাজ করছে আর হাই তুলছে। আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, 'আপনার কে ভর্তি আছে?' 'আমার আব্বু।' বলার সময় আমার কণ্ঠ আটকে গেল। 'আমার ছোট ছেলে ভর্তি এখানে। ওর হার্টে পাঁচটা ফুটা।' কি স্বাভাবিকভাবে কথাগুলো বলে দিল লোকটি। মনে হলো যেন এ খুব সাধারণ ব্যাপার। একটুও কেঁপে উঠল না কণ্ঠ কথাগুলো বলতে। কণ্ঠে কোনো ব্যথা নেই। নেই কোনো ভীতি। হয়তো বা একটা সময় ছিল। দিনে দিনে মিশে গেছে সব। এমনও হতে পারে এই নির্লিপ্ত কণ্ঠের আড়ালে লুকিয়ে আছে সীমাহীন কাতরতা। যে কাতরতা এখন আর দেখা যায় না। তা বুকের গভীর কোণে লুকিয়ে ফেলার সক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে। আই সি ইউর ভেতর থেকে একজন নার্স বেরিয়ে এলেন। আমি তাকে আব্বুর অবস্থার কথা জানতে চাইলাম। তিনি আমাকে সকাল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বললেন। সকাল হতে আর বেশি দেরি নেই। ইতোমধ্যে ভোরের প্রথম আলো ফুটতে শুরু করেছে। আজ অনেক দিন পর দিনের আলো দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছি। আজকের দিনটাকে আমি মন ভরে দেখব। স্বপ্ন ভেঙে আমি এক নতুন আশা খুঁজে পেয়েছি। এ যেন আমার এক বড় প্রাপ্তি। আঘাত থেকে মানুষ যা পায় তার থেকে বড় প্রাপ্তি অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখন শুধু সকাল হওয়ার অপেক্ষা।