জানালা

প্রকাশ | ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

আবু সাইদ কামাল
হঠাৎ গেটের ছিটকিনি খোলার শব্দ হলে হোসনে আরা বেগমের কান খাড়া হয়। রান্নাঘরের আঙিনায় বসে মাছকাটা শেষে তাজা ডাঁটা কুটছে হোসনে আরা। অমনি সামনে এসে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে রাখা শাড়ির আঁচলের কোণাটা যখন ছাড়ল, তখন তার মুখের সম্পূর্ণ অবয়ব দেখে হোসনে আরা আচমকা বলে ওঠে, আরে হেলেনা, তুই...! -হ, আফা, আমি আইছি। -কইত্যে আইছস? -বাড়িত্যে...। -জামাই বাড়িত্যে কোনদিন আইছস? -গত পরশুদিন। -ভালোই আছস তুই? -হ, ভালাই। -পয়লা আইছি খালাম্মাগর ঐহানে। আপনের আম্মা বইতে কইল। আমি কইলাম আফারে আগে দেইখ্যা আই। কতদিন দেহিনা আফারে। -আইছস যহন, তাইল ব। পরে তোর কথা শুনি। -দুলাভাই কই? -ঘরে। পত্রিকা পড়ে। ততক্ষণে জাহিদ হাসান রান্নাঘরের আঙিনায় গিয়ে বলে ওঠে, আরে রেহেনা, তুমি? -হ, দুলাভাই। -কতদিন পরে দেখলাম। ঈদ উপলক্ষে বাড়িতে আসছ বুঝি? -হ। -তো একলা আইছ ক্যান, বাচ্চা-কাচ্চা কই? -বাচ্চা-কাচ্চা নাই দুলাভাই। -এইডা কী কও। ছয়-সাত বছর হয় তোমার বিয়া অইছে, এখনো বাচ্চা-কাচ্চা অয় নাই! -না দুলাভাই। -মাইনসের ছোট ছোট বাচ্চা-কাচ্চা দেইখ্যা তোমার আফসোস অয় না! -অইলেই কী করতাম! এতদিন তো জামাই-শাশুড়ি কইতো বউয়ের সমস্যার লাগিই সন্তান অয় না। কয়দিন আগে দুইজন মিইলা ডাক্তারের কাছে গেলাম, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ধরা পড়লো- জামাইয়েরই সমস্যা...। -এই যে ধরো, আমগর ছোট ছোট পোলাপান সারাক্ষণ বাড়ি-ঘর তোলপাড় করে, হই-হুলেস্নাড় করে বাড়ি মাথায় তুলে। ছোট ছোট পায়ে ছোটাছুটি করে- এইসব দেইখ্যা তোমার শূন্য কোলে একটা বাচ্চার কামনায় কখনো কান্দন আইয়ে না তোমার...! -দুলাভাই তো আমার মনের গোপন কতাডা কইয়া ফেলাইলেন। জানেন, এই কতাডা আমি কেউরে কইবার পারি না। এমনকি স্বামীরেও না। গভীর রাইত পর্যন্ত একলা জাইগা আমি কান্দি। আমার এই কান্দনের খবর তো আর কেউ জানে না। কথাগুলো বলতে বলতে হেলেনার দুচোখ জলে ঝাপসা হয়ে যায়। তা লক্ষ্য করে জাহিদ হাসান বলে, আরে! তুমি তো সত্যি সত্যি কেঁদে ফেললে। -দুঃখের কতা মনে অইলে তো কান্দন আইবই। -যতটুকু বললে, তাতে বোঝা গেল-তোমার স্বামীর সন্তান জন্ম দেয়ার সামর্থ্য নাই। এ অবস্থা যদি তোমার বেলায় হতো তাহলে... -তাইলে তো আমারে খেদাইয়াই দিত। পারলে আর ও একটা বিয়া কইরা নিত। -এখন প্রয়োজনে তুমিও তাই করো! -এইডা কি আর সম্ভব দুলাভাই? -কেন সম্ভব না, যে কাজটা তোমার স্বামী করতে পারে তো, সেই কাজটা তুমিও করতে পারো। অন্য পথেও একটা কাজ করতে পারতে। তোমার স্বামীর বন্ধ্যাত্ব প্রমাণ হওয়ায়- এখন অবশ্য তাও সম্ভব না। -কী পথ হেইডা। -এই ধরো, সন্তান জন্মদানে সমর্থবান পুরুষের সহায়তা নিতে পারতে। একথা বলে জাহিদ হাসান অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। আর তা শুনে রান্নাঘরের আঙিনা থেকে স্ত্রী হোসনে আরাও হেসে স্বামীকে শাসিয়ে বলে, তুমি না মাঝে-মধ্যে এমন কিছু কথা কও-যা, আগুনে-পানিতে সিদ্ধ হওয়ার মতো না। হেলেনাও হাসতে হাসতে লজ্জানম্র মুখে বলে, হঁ্যা গো! দুলাভাই কান্দাইবারও যেমন পারে, তেমন পারে হাসাইবারও। -হেলেনা! -হু! -সেই ছেলেডা কোথায়? -কোন ছেলে? -ঐ যে স্টেডিয়ামের কাছে এক বাসায় যখন ভাড়া থাকতাম, তখন এক বিকালে রান্নাঘরে পিছনে ছেলেটার সঙ্গে কথা বলছিলে যে। -কী কইছিলাম? -বলতেছিলে, কোরআন লইয়া শপথ কইরা কওন লাগব। কী ছিল সেই শপথের কথা? -সেইদিনের ঘটনার লাইগাই তো আমারে জোর কইরা এই জায়গায় বিয়া দিয়া দিল। -কিন্তু হেই কতা আপনে জানেন কেমনে দুলাভাই? ও ঘরে বইয়া থাইক্যা কান পাইত্যা হুনছিলেন মনে অয়। -ঐ ছেলের খবর কী? -ঐ ছেলের খবর আমি লইনা। হের লাগিই তো আমার কপালে এই দুঃকু। ঐ ছেড়ার লগে কতা কইতে দেইখ্যাই আমার মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন মনে করল, হেগর মান-ইজ্জত সব আমি ডুবাইয়া ফেলাইছি। এর লাইগাই তো হেরার পছন্দমতো বিয়া দিল। আর আমি অহন দুঃকের সাগরে ভাসতাছি। কথাগুলো বলতে বলতে কণ্ঠরুদ্ধ হয় হেলেনার। জাহিদ তা আন্তরিকতার সঙ্গে অনুভব করে পিছন ফিরে তাকায়। দুই সেদিনকার হেলেনা ছিল প্রথম বর্ষার নদীর মতো উচ্ছল। তখন উপচেপড়া যৌবন তার। চপলা ষোড়শী মেয়ে হেলেনাকে দেখে সে সময়ের মোহনীয় একটি দৃশ্যের কথা স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে ওঠে। অবশ্য এমন অপূর্ব এবং বিরল দৃশ্য সব বয়সী পৌরুষচিত্তে সম্মোহিত পুলক এবং রোমাঞ্চকর একটা উদ্দীপনার সৃষ্টি না করে পারে না। জাহিদ হাসান ঈদের ছুটিতে বাড়িতে আয়েসী সময় কাটাচ্ছে। তখন স্ত্রী হোসনে আরা ডাইনিং টেবিলে ডাকল। দুপুরের খাবার খেতে খেতে জাহিদ হাসান যেইনা জানালা পথে তাকালো, অমনি তার দু'চোখের মগ্ন দৃষ্টি ত্রিশ-চলিস্নশ ফুট দূরে পুকুরের ঘাটে গিয়ে বিদ্ধ হয়। পুকুরের ওই ঘাটে মেয়েদের গোছলের জন্য পাটশলা দিয়ে বেড়া দেয়া হয়েছে। ওই ঘাটে তখন স্নানরত দুটি মেয়ে। একটির বয়স সাত কিংবা আট। অন্যটি ষোড়শী। সে যেখানে বসে স্নান করছে, তার গা ঘেঁষা পাঠশলার বেড়াটি। ডানদিকে পুকুরের উঁচু পাড়ে বেশ কিছু গাছ-গাছালি। ওদিকে যাতায়াতের কোনো রাস্তা নেই। কাজেই চারদিকে নিশ্চিত আড়াল মনে করে নির্ভাবনায় ষোড়শী মেয়েটি স্নান করে যাচ্ছে। কিন্তু জাহিদ হাসানদের ডাইনিং রুমের খোলা জানালায় ঝুলানো পর্দার ফাঁক দিয়ে যে ঘাটের সবকিছু দেখা যায়, সে তথ্য জানলে ওই ঘাটে কোনো মেয়েই স্নান করতে আসত না। অবশ্য বাইরে থেকে জানালা পথে ভেতরে তাকালে অন্ধকারে ঘরের ভিতরের সব চোখে পড়ে না। আবার রাতের বেলায় ঘটে উল্টো। ঘরের ভিতরে বৈদু্যতিক বাতি জ্বলায় বাইরে থেকে ঘরের ভিতরের সব চোখে পড়ে। কিন্তু বাইরে অন্ধকারে সব চোখে পড়ে না। তো মেয়েটি নিশ্চিন্ত মনে মগ দিয়ে গায়ে পানি ঢেলে স্নান করছে। ততক্ষণে ভেজা কামিজ তার উন্নত বুকে লেপ্টে গেছে। মেয়েটি একে একে তার শরীরের নানা অঙ্গে পানি ঢালে। গায়ে সাবান মেখে ফেনা তুলে পানি ঢেলে ফুরফুরে হয়। তারপর কাপড় পাল্টানোর পালা। তখন গ্রীষ্মের বিষণ্ন দুপুর। আশপাশে কোনো মানুষ নেই। এমন নিরিবিলিতে মেয়েটি প্রথম তার কামিজ খোলে। অমনি তার খোলা বুকের টসটসে দুটি পুরুষ্ট স্তন জাহিদ হাসানের দৃষ্টিকে গোগ্রাসে টেনে ধরে। মনে হচ্ছে ও দুটি শৃঙ্গ তখনো কোনো পুরুষ-মানুষের স্পর্শধন্য হয়নি। খেতে বসে ওভাবে জানালাপথে জাহিদ হাসানকে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্ত্রী হোসনে আরা বলে, কী ব্যাপার! তুমি বাইরে এমনে তাকাইয়া কোথায় কী দেখতেছো? -আমার কাছে এসে জানালাপথে পুকুরঘাটে তাকিয়ে একটু দেখো। -কই দেখি, ইয়া আলস্নাহ! মেয়েডার লজ্জা-শরম নাই নাকি? -একেবারে টসটসে, তাই না? -তুমি এত অসভ্য. -তুমি যে কী কও। সুন্দর জিনিস দেখলে ক্ষতি কি? -জানালা বন্ধ করে দিব কিন্তু। -না। তাইলে মেয়েটি টের পেয়ে ভীষণ লজ্জা পাবে। -তাইলে তুমি ওদিকে তাকাবে না। -আচ্ছা। এই যে দৃষ্টি ফেরালাম। এই বলে জাহিদ হাসান খাবারে মনোযোগ দেয়। আবার চোরা চাহনিতে ওদিকে তাকিয়ে দেখতে পায়, মেয়েটি ততক্ষণে শুকনো কামিজ পরে ফেলেছে। এবার কামিজের নিচু অংশে নাভির নিচে হাঁটু পর্যন্ত আড়াল করে মেয়েটি তার ভেজা সালোয়ার খোলে। দুষ্টু বাতাসে তখন কামিজের নিম্নাংশ দুলে ওঠার ফাঁকে ফাঁকে তার জঙ্গা-উরুর বিমূর্ত অংশ চোখে পড়ে। সালোয়ার খুলে এক পর্যায়ে সে হাঁটু ভেঙে বসে। যেই না সে পানিতে চুবিয়ে সালোয়ারটি ধুইতে শুরু করে, অমনি তার দুটি উরুর সংযোগস্থলে ফুটোন্মুখ গোলাপের গোটানো পাপড়িগুলোও চোখে পড়ে। তখন স্ত্রী হোসনে আরাকে চিমটি কেটে জাহিদ হাসান নিচুস্বরে বলে, এবার একটু ওদিকে তাকিয়ে দেখো তো? স্ত্রী এক নজর ওদিকে তাকিয়েই দু'চোখ কপালে তুলে স্বামীকে শাসিয়ে বলে, অন্য মেয়েদের ওসব দেখতে খুব মজা লাগে, তাই না? আসলে পুরুষ জাতটাই এমন। আর ওই মেয়েডারেই কি কমু, একটু আক্কেল-পছন্দ যদি থাকত...! চারদিকে চোখ-কান তো একটু খোলা রাখা লাগে, নাকি! এই আমি জানালা বন্ধ করে দিলাম। বলেই হোসনে আরা সামনে পা বাড়ায়। ততক্ষণে মেয়েটি তার শুকনো সালোয়ার পরে ফেলে। তখন জাহিদ হাসান হেসে বলে, আর কষ্ট করে তোমার জানালা বন্ধ করা লাগবে না। মেয়েটিই তোমার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওর সব দরজা-জানালা বন্ধ করে ফেলছে। -যাতে তুমি আর কোনোদিন কোনো মেয়ের প্রতি চাইতে না পারো, সেজন্য এই জানালা আমি সবসময় বন্ধ করে রাখমু। স্ত্রীর এমন কথা শুনে জাহিদ হাসান শুধু হাসে, কোনো কথা বলে না। তিন ছ-সাত বছর আগে হেলেনা এমনই অঙ্গ-সৌষ্ঠবে আকর্ষণীয় ছিল। আর সে আকর্ষণেই মনোহারী দোকান করত- এমন একটি ছেলেও প্রেমের নিবেদন নিয়ে এসেছিল। দুজনে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিল। করেছিল শপথও। কিন্তু অভিভাবকদের গোঁড়ামির যুবকাষ্ঠে বলি দিতে হয়েছে হেলেনার প্রণয়ের ময়না পাখিটিকে। রান্নাঘরের আঙিনায় হেলেনা ততক্ষণ হোসনে আরার তরকারি কোটায় সহযোগিতা করছে। হোসনে আরা বলে, কী রে হেলেনা! তোর যে ভাইডা-কাঠের 'স' মিলে লেবারের কাম করত, এইডাও নাকি পাগল অইয়া গেছে? -হ আফা। -তোর না কয়ডা ভাই...? -চাইর ভাইয়ের সবকয়ডাই পাগল অইয়া গেছে। -সবার বড় ভাইডাই তো 'স' মিলে কাম করত, তাই না? সুন্দরী একটা বিয়াও করছিল। এ ঘরে বুলবুলা সুন্দর দুইডা বাচ্চাও তো ছিল। একটা বাচ্চা নাকি তুই নিতে চাইছিলি? -কী কইন আফা। কই নিমু! গেরামে থাহি। ওরা ছেলেডারে হয়তো বা দেখবার পারতো না। তহন আমার খুব কারাপ লাগবো। এর লাইগাই নেই নাই। -তোর বাপ তো মইরাই গেছে। অহন তোর মা কী কইরা খায়? -চাচায় কিছু দেয়। আর কিছু টাইন্যা-টুইন্যা, মানুষের কাছে চায়া যা পায়; তাই দিয়া চলে আর কি! -ঈদের সময় আইলি। কার বাড়িত উঠছস? - বাড়িতে মায়েরে দেইখ্যা খালাম্মাগর বাসায় উঠলাম। এই বাসায় আগে কাম করতাম বইলাই তো নিজের মনে কইরা প্রত্যেকবার আইয়া পড়ি। -তোর জামাই আইসা নেওনের আগ পর্যন্ত তো ঐ বাসাতেই তো থাকবি। দুই-একদিন আমার বাসাতেও আইসা থাকবার পারস। -না আফা, আপনেরে আইসা আইসা দেইখ্যা যামুনে। যা-দুয়েকদিন থাহনের-আপনের আম্মার ঐহানেই থাকমু। স্ত্রী এবং হেলেনার কথাগুলো শুনে যাচ্ছিল জাহিদ হাসান। এবার সরব হয়ে বলে, তো হেলেনা! তোমার স্বামী যদি কোনো সন্তান তোমাকে দিতে না পারে তাহলে কী করবে? -ডাক্তার অবশ্য কইছে, দুইজন কিছুদিন চিকিৎসা করলে সন্তান অইবার পারে। -কী করে তোমার স্বামী? -রিকশা-ভ্যান চালায়। গেরামের মানুষ তো। খুব কিপ্টা। পয়সা খরচ করবার চায় না। -সন্তান যদি তোমাদের না-ই হয়, তাহলে কী হবে টাকা-পয়সায়? -আমিও তো হেই কতাই কই। দেহি-কিছুদিনের মধ্যে আমরা আবার ডাক্তারের কাছে যামু। আনতমুখে কথাগুলো বলার সময় রেহেনার চোখে-মুখে প্রত্যাশার একটা ঝিলি ফুটে ওঠে।