জন্মদিনের শুভেচ্ছা

প্রিয় কবি হাসান হাফিজ

প্রকাশ | ১১ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

জাকির আবু জাফর
নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলেন এমন লোকের সংখ্যা নেহায়েতই কম। অথচ নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলা জরুরি। জরুরি কারণ নিজের মুখোমুখি হলে সত্য-মিথ্যার চেহারা দ্রম্নত স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। নিজেকে নিজে বোঝার বিষয়টিও পরিষ্কার হয়ে যায়। একাকী হলে অনেক বিষয়ের মতো ফুটে ওঠে কাছের দূরের মুখগুলো। কে কাছের কে দূরের? এর জবাব বোধহয় সবারই জানা। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে মনে পড়ে যাকে। একাকী হলে ভেসে ওঠে যে মুখ এবং যার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অনুভূতি তাকে কাছের মানুষ বলতেই হয়। তেমনি একজন কাছের মানুষ কবি হাসান হাফিজ। কিছু কিছু মুখ প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে ভেসে ওঠে মনের আর্শিতে। কবি হাসান হাফিজ তেমনি একটি মুখ। তেমনি অনুভূতির সঙ্গে জড়ানো একজন মানুষ। প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে মনে পড়ে তাকে। কখন কীভাবে প্রথম দেখা আজ আর মনে নেই। অথচ মন এটুকু খোদাই করেছে এই মুখটি ভোলা যাবে না কখনো। ভুলে থাকাও যাবে না কোনোদিন। কেন? এক কথায় এর কোনো জবাব নেই। দীর্ঘ পথচলার এক বিশাল পথ যখন রচিত হয়। সে পথের কোন বাঁকে কি বৃক্ষের ছায়ায় হৃদয় খুলে দাঁড়িয়েছি তার তো নকশা থাকে না। কিন্তু তার একটি আবহ-প্রবাহ এবং চিহ্ন থেকে যায়। এসব চিহ্ন যোগ হতে হতে হয়ে যায় এক বিরাট সেতু। সেই সেতুটি দীর্ঘ হতে হতে দীর্ঘতর হতে থাকে। হচ্ছে। এবং হতেই থাকবে ক্রমাগত। আমাদের যোগসূত্রের প্রধান সেতুটি কবিতা। কবিতার আনন্দ আমাদের মধ্যবর্তী স্থানটুকুর সংযোগ ঘটিয়ে দেয়। আমরা হয়ে উঠি পরস্পরের অনুভূতির একজন। কবি হাসান হাফিজ আমার অনুভূতির সঙ্গে জড়ানো একজন কবি। আমি তার কবিতা উদযাপন করি। হাসান হাফিজ কবিতার রাজপথের মানুষ। কবিতার সরব পথিক। যে কোনো মূল্যে কবিতাই যাদের একমাত্র হয়ে ওঠে হাসান হাফিজ তাদেরই একজন। তিনি অনবরত কবিতা সান্নিধ্যের মানুষ। কবিতা আমৃতু্য নিজের ধমনির সহযোগী করে নিয়েছেন। কবি হিসেবেই তিনি পথ চলেন। বলেন। এবং করেন। কবিতার পৃথিবীটা তার ভীষণ আকাঙ্ক্ষার। কবিতার প্রেমই তাকে জীবনের পক্ষে প্রেম জোগাতে সাহায্য করেছে। দৃষ্টি দিয়েছে জীবনকে নতুন করে দেখার। হাসান হাফিজ কবিতার নিবচ্ছিন্ন যাত্রী। সম্ভাবনার সকল দরোজা খোলেন কবিতাচাবির কৌশলে। যখন থেকে কবিতা লেখার যাত্রা- কখনো থামেননি আর। অনবরত ছোটার কাজটি করেছেন ভালোবাসার সঙ্গে। জীবন চলার পথে দুঃখ-বেদনা তো থাকেই। সমস্যাও কম থাকে না। নিশ্চয় তিনিও মুখোমুখি হয়েছেন এসবের। এখনো হচ্ছেন। কিন্তু না এর প্রভাব তাকে ক্রিয়া করার সাহস রাখেনি। তিনি কোনো- সমস্যার কাছে পরাভূত হননি। কোনো বাধাই তাকে বিচলিত করেনি। কবিতার পথে থামাতে পারেনি তার গতি। তার প্রকাশিত বইয়ের দিকে তাকালে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। এককভাবে তার কবিতাগ্রন্থের সংখ্যা পঞ্চাশটি। ভাবা যায়! কবিতাগ্রন্থ হিসেবে সংখ্যাটি বিস্ময়ের বটে। বিস্ময়টি একারণে তিনি যে শুধু কবিতা লেখেন এমনটি নয়- ছড়ায়ও তার উপস্থিতি ধনীদের মতো। ছড়াশিল্পে চিহ্নিত করার মতো আছে তার স্থান। প্রবন্ধের জায়গায়ও তিনি সচ্ছল। অনুবাদেও কম যান না। আছে শিশুসাহিত্য। সম্পাদনার ক্ষেত্রটিও বেশ প্রশস্ত। তিনি সাংবাদিক। সংগঠক এবং সাহিত্যবিষয়ক সম্পাদনায় সিদ্ধহস্ত। হাসান হাফিজ একজন বিচরণশীল কবি। কবিতার যে কোনো আয়োজনে তার উপস্থিতি লক্ষ্য করার মতো। কবিতার পক্ষ উচ্চারণে তিনি সাহসী। কবিতাঙ্গনে যারা খ্যাতিমান তাদের প্রায় সবার সঙ্গে তার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। যারা গত হয়েছেন তাদের সঙ্গে। যারা বর্তমান তাদের সঙ্গেও। এর মধ্যে কিছু কিছু বিখ্যাতজনদের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিবীড়। তিনি গ্রন্থ রচনা করেছেন তাদের অনেকের ওপর। সাক্ষাৎকার নিয়ে ছাপিয়েছেন পত্রিকায়। প্রকাশিত হয়েছে সাক্ষাৎকারের বই। এভাবে তিনি নিজেকে সাহিত্যাঙ্গনে ছড়িয়েছেন বিরাট বৃক্ষের মতো। কবি হাসান হাফিজের একটি বিশেষ দিক তিনি অন্যের জন্য কাজ করেন সানন্দে। করেন আন্তরিক স্বচ্ছতায়। একজন লেখককে এগিয়ে দেয়ার মানসিকতায় তিনি উদার। এ উদারতা তাকে দিয়েছে সাহিত্যাঙ্গনে প্রিয়তা। সাহিত্যাঙ্গন নিয়ে তার আছে বিশ্লেষণ। আছে মতামত। আছে সমালোচনা। রাজনৈতিক দলাদলির অসুন্দরকে তীব্রভাবে অপছন্দ করেন তিনি। সাহিত্যের বিচার সাহিত্য ছাড়া আর কিছুতেই চলে না এ সত্য তার কাছে আদর্শনীয়। তিনি এ সুন্দর লালন করেন। বিভিন্ন মত পথের ঊর্ধ্বে উঠে সাহিত্যের পথই তার গন্তব্যের শিখা। কবিতাই একজন কবির মূল্যায়নের একমাত্র বিবেচনার দিক। কবিতা ছাড়া একজন কবিকে কি করে গ্রহণ করা যায়? রাজনৈতিক পছন্দ অপছন্দ কবির বিবেচ্য হতে পারে না। পারে না কবির বৈশিষ্ট্য হতে। হাসান হাফিজ এ সত্যকে ধারণ করেন। সে উদারতার অনুষঙ্গেই চলেন তিনি। বলেন এ সুন্দর পথের কথা। যতদূর জানি তিনি মানুষের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন না। কাউকে খাটো করার চেষ্টা করেন না। কাউকে ঠেলে নিজে এগিয়ে যাবেন এমন মানসিকতাও দেখি না। কবিদের প্রতি লেখকের প্রতি তার অনুরাগ বেশ স্বচ্ছ। যাকে শ্রদ্ধা করা যায় তাকে শ্রদ্ধা করেন। যাকে প্রশংসা করার তার প্রশংসাও করেন। এবং যে ভালোবাসার তাকে ভালোবাসেন। এ ভালোবাসা কৃত্রিম নয়- হৃদয় জারিত। দেখানো নয় অনুভবের। একই সঙ্গে সাময়িক নয় সবসময়ের। তিনি খোশমেজাজী একজন কবি। তার মুখে কাব্যিক প্রসন্নতা আছে। কবিতার ঔজ্জ্বল্য আছে। হাস্যমুখে সাক্ষাতের আনন্দ আছে। আমাদের বেশির ভাগ কবিই বিষণ্নতায় গোমড়া। হাসির সৌন্দর্য তাদের প্রাণীত করে না। ভারী মুখে মানুষের মুখোমুখি হওয়া একজন কবির জন্য মানায় না। কোথাও কোথাও এটি অশোভনও বটে। হাসান হাফিজ এসব দুর্বলতা থেকে বেঁচে থাকেন। তার চিন্তার প্রশস্তিও উদযাপন করার মতো। সুস্থ চিন্তার মানুষ তিনি। মানুষের পক্ষে তার উচ্চারণ। মানুষের কল্যাণকর উপলক্ষ গ্রহণ করার চেষ্টা আছে তার। অকারণ অন্যের সমালোচনায় নিজেকে ডোবান না। অন্যের দোষের দিকে আঙুল তোলার স্বভাবও নেই তার। সময়টি এমন এখন প্রত্যেকেই তার অপছন্দের মানুষ তো বটেই বরং পছন্দের মানুষের সমালোচনা নিন্দায় রত। নিজের দিকে তাকানোর অবসর কারও নেই। কেবল অন্যের দুর্গন্ধ চেটে নিজের মনটি কুলুসিত করার এক অসুন্দর খেলায় রত সব। এখানেও কবি হাসান হাফিজ নিজেকে সংযত করার চেষ্টায় এগিয়ে। তিনি সাধারণ অকারণ সমালোচনা অথবা অন্যের দোষ ঘাঁটাঘাঁটির প্রবণতা গ্রহণ করেন না। সাহিত্যাঙ্গনে নানাবিধ কাজে বিস্তৃত তার পরিধি। এতসব কাজের ফিরিস্তি উদ্ধার করার সাধনায় তিনি দারুণ পরিশ্রমী। সময় যথাযথ কাজে লাগানোর এক সচেতন দৃষ্টি তাকে পরিশ্রমী করে তুলেছে। অকারণ সময় খরচ করার যুক্তিতে তিনি একেবারেই নারাজ। সময় সমষ্টি তো জীবন। কর্মজীবনের পরিচয়। সময়ের ব্যবহার কে কীভাবে করেন তার ওপরই নির্ভর করে কর্মের ঔজ্জ্বল্য। সময়কে যারা কর্মে রূপান্তরিত করেন তাদের জীবনের রূপ দাঁড়ায় এক। অকাজে খরচ করার মানুষের আরেক। হাসান হাফিজ সময়কে অর্থবহ করার কাজেই নিয়ত চলমান। না কারও কাছেই চাওয়ার কিছু নেই। কিছু পাওয়ারও নেই কারও কাছ থেকে। চাওয়া-পাওয়ার সব হিসেবে মিলে যায় কর্মের কাছে এসে। মানুষ তার নিজের ভূমিকা থেকেই পাওয়া না পাওয়ার ইন্ধন পায়। একজন পরিশ্রমী লেখকের কাজ সময়কে যথার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেকে ইন্ধন দেয়া। ভবিষ্যতে নিজের নামটি রক্ষণের নকশা বর্তমানেই আঁকতে হবে। সে নকশা কোনো ছলনার আশ্রয়ে জমে না। সততার সৌন্দর্যে তুমুল করার যোগ্যতা চাই। তবেই তো জীবন হবে মানুষের ফিরে দেখার। স্মরণে রাখার। এবং সংরক্ষণে রাখার উপযোগী। নিজের নামটি কালের অক্ষরে লেখার লক্ষ্যে কলমটির যথাযোগ্য ব্যবহার করা জরুরি। কবি হাসান হাফিজ সাধ্যমতো তারই সাধনায় তৎপর। জন্মদিনে তাকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা।