কল্যাণী রানী দাস

প্রকাশ | ১৮ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

লতিফ জোয়ার্দার
শ্রাবণের দ্বিতীয় সপ্তাহ চলছে তখন। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সকাল। চারদিকে ধূসর অন্ধকার। ঘুম থেকে জাগা হলেও, বিছানা ছাড়া হয়নি তখনও। এমন যে প্রতিদিন হয় তা কিন্তু নয়- একটু সকাল করেই ঘুম থেকে জাগতে হয় প্রতিদিন। ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় ধরে হাঁটাহাঁটি করে তবেই না বাড়িতে ফিরি আমি। কিন্তু আজকের দিনটাকে অন্যরকম মনে হচ্ছিল। কোনো তাড়া নেই আমার। যেন মৃত মানুষ আমি। হঠাৎ করে কল্যাণী রানী দাসের কথা মনে হলো। এই নামে আমার কোনো বন্ধু অথবা ক্লাসমেট ছিল কিনা ঠিক মনে করতে পারছিলাম না। অথচ গত দুদিন ধরে বিষয়টা আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। থানা থেকে জানানো হয়েছে কল্যাণী রানী নামে এক ভারতীয় মহিলা আমার খোঁজ করছেন। ভারতীয় দূতাবাস থেকে প্রশাসনকে আমার বিষয়ে খোঁজখবর নিতে বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে ডিবি পুলিশ আমার বিষয়ে তদন্তে নেমেছে। বিষয়টা কিছুতেই মাথায় আসছিল না। কল্যাণী রানী, ডিবি পুলিশ কোনো কিছুই। আমি মনের অজান্তে বিদ্যালয়ের বারান্দায় হেঁটে বেড়াই। মেয়েদের কমন রুমে উঁকি মারি। কিন্তু আমার স্মৃতির পাতায় কোনো কল্যাণী রানী নামে কাউকে খুঁজে পাই না। তখন মনে হলো, হয়তো কল্যাণী রানী আমাদের সঙ্গেই পড়ত। আমার খুবই চেনা সে। এখন হয়তো নামটা বদল করেছে মাত্র। সাপের মতো খোলস বদল যাকে বলে। এই কদিনে আমাদের পাড়ায় আমাকে নিয়ে অনেকটা হৈচৈ পড়ে গেছে। কেউ কেউ আমাকে কোনো মামলার আসামি ভাবছে। কেউ ভাবছে আমি বড় কোনো অপরাধী দলের সদস্য। ইতোমধ্যে ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানও আমাকে ডেকে বসেছে। বিষয়টা এক কান দুই কান করে তার কানেও গেছে হয়তো। ঘরের বাইরে তখন আর বৃষ্টি নেই বলে মনে হলো। বউ বলল, -এই বৃষ্টির দিনে আর তোমার জন্য আমি রুটি বানাতে পারব না। একযুগেরও বেশি সময়ে ধরে আমার ডায়াবেটিস। দুইবেলা হাঁটাহাঁটি করি, রুটি খাই। কখনো ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে কখনো বা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। মাঝেমধ্যে বড্ড মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করে আমার। আমি সুদেব বৈরাগীর দোকানে বসে একশো গ্রাম জিলাপী নিয়ে বসি, এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেলি সব জিলাপী। একসময় এসব বিষয় নিয়ে বেশ চিন্তা হতো আমার। কিন্তু এখন ডাল-ভাতের মতো নিরামিশ হয়ে গেছে। বাড়ির অন্য সবাই বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি পছন্দ করে। সে কারণে আজ আর অন্য কোনো প্রকার রান্না হবে না বাড়িতে। চুলায় আগুন জ্বলছে। ভেজাখড়ির ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে আছে আমাদের রান্নাঘর। বারবার চুলায় ফুঁ পাড়ছে জোবেদার মা। দুদিন ধরে সিলিন্ডারের গ্যাস ফুরিয়ে গেছে। তার কথা শুনে মুখের অবয়বটার একটু পরিবর্তন হলো। তারপরও বউকে কিছু বলতে পারলাম না। রাত-দিন সংসারে খাটা-খাটুনি করতে করতে বেচারি এখন অনেক সময়ই অসুস্থ হয়ে থাকে। ছেলেমেয়ে, গরু-ছাগল রান্না-বান্না নিয়ে তার পাগল হওয়ার দশা। তার জন্য নামমাত্র চিকিৎসা ওমেদ ডাক্তারের কাছে। অসুখ দুদিন ভালো থাকলেও চারদিন সেই আগের মতো। পাড়া-প্রতিবেশীরা বলেছে ভালো ডাক্তার দেখাতে। আমারও ইচ্ছে করে কিন্তু পারি না। দুই মেয়ে আর এক ছেলের সংসার। সবাই লেখাপড়া করছে। আমার যে রোজগার ওদের খরচ জোগাতেই হিমশিম খেতে হয়। ডাক্তার কবিরাজের কাছে যাই কী করে! মনে হলো বউ হয়তো কিছু বলতে চায় আমায়। দুইবার ঘুরে গেছে। কিন্তু কেন জানি না! বলি বলি করেও বলতে পারেনি। কিন্তু যখন খেতে বসেছি এই সময় আর রক্ষা নেই। দুনিয়ার সব চিন্তার কথা আর দুনিয়ার যাবতীয় অভিযোগ তাকে এই সময়ই করতে হবে। কার কি হয়েছে। কার কি নেই। পাশের বাড়ির ছাগলটা চারা আমের গাছটা খেয়ে গেছে। দুই হালি ডিম দিয়েছিল রফিকুলের মা সেই ডিমের টাকা দেয়া হয়নি এখনো। হাচানের দোকানে বাকি পড়েছে ১৩০ টাকা। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় টাকাগুলো দিয়ে যেও কিন্তু। তখন মাত্র আমার অর্ধেক খিচুড়ি খাওয়া হয়েছে। শুরু হলো জোবেদার মার প্যান-প্যানানি। কথা নেই বার্তা নেই কান্নাকাটি শুরু করে দিল। -দেখো আমি আর তোমার ভাত খাবো না। বাপের বাড়ি চলে যাবো আমি। আমি একবার তার মুখের দিকে তাকালাম। বিষয়টা বুঝে ওঠার চেষ্টা করলাম। নতুন করে আবার তার কী হলো? -দ্যাখো জোবেদার মা, রাতদিন আর তোমার এসব প্যান-প্যানানি আমার ভালো লাগে না। -তা তো লাগবিই না। আমি চলি গেলিই তো বাঁইচি যাও তুমি। রাস্তা পরিষ্কার হয় তোমার। তখন সোজাসুজি ঘরে আইনি তুলতে পারো। তখনও বিষয়টা অজানা আমার। এসব কথা কেন বলছে জোবেদার মা। সবকিছুরই তো একটা বয়স লাগে। সময় লাগে। আর আমার জীবনে এমন কেউ নেই যে সে আমার ঘরে এসে উঠবে। পেস্নটে অর্ধেক খিচড়ি রেখেই পানি ডেলে দেই। -হ, আমার কথা তো আর সহ্য হবি লা তোমার। যাও দ্যাখো, মাগি তোমার অপেক্ষায় বইসি আছে। ওপাড় থেকে যদি এপাড় আসতি পারে! এটুকু রাস্তা আসতি আর কত সময় লাগবিনি। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না জোবেদার মা কল্যাণী রানীর কথা বলছে। হায় রে কপাল আমার। যার সাথে আমার একবারও দেখা হলো না। একবারও কথা হলো না। সে আমার ঘরে এসে উঠবে। ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য তৈরি হতে থাকি। জোবেদার মা সামনে এসে দাঁড়ায়। -যাবেই তো এখন? যাও, দ্যাখো সে এলো বলে! বদমাইশ, লুচ্চা কোনেকার, মেয়ে মানুষের কথা শুনলেই আর মাথা ঠিক থাকে না। এমন সময় ঘরের বাইরে একটা পুরনো মোটরসাইকেল এসে দাঁড়ানোর শব্দ কানে এলো। এই পাক কাঁদার দিনে আমাদের এই মাটির রাস্তায় মোটরসাইকেল। পাক কাঁদায় একাকার হয়ে বাড়ির সামনে এসে লালু মেম্বার দাঁড়ালো। লালু মেম্বারের হাঁকডাক দেখে, সাত বাড়ির মানুষ টের পায় যে মেম্বার এসেছে। হঠাৎ তার কাছে লালু মেম্বার বিষয়টা বুঝতে আর কষ্ট হয় না। হয়তো চেয়ারম্যান সাহেব পাঠিয়েছে। শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে ঘর থেকে বের হই আমি। -তো, আব্দুল কাদের-কেমন আছো? তোমার ডাক পরিছে। এখনই যেতে হবে আমার সাথে। -কোথায় যাব মেম্বার সাহেব? -কেন! ইউনিয়ন পরিষদে। চেয়ারম্যান তোমার অপেক্ষায় বইসি আছে। থানা থেকে নাকি বারবার ফোন আসতিছে। আর এক মিনিটও লা। এখন আমার মোটরসাইকেলে ওঠ কচ্ছি। কুনু ওজুহাত শুনবো নানে কিন্তুক। বৃষ্টির দিন বলে ইউনিয়ন পরিষদ বেশ ফাঁকাফাঁকা। লোকজন তেমন একটা নেই। চেয়ারম্যান একবার তার রুমে যাচ্ছে আবার রুম থেকে বের হচ্ছে। ঠোঁটে লাগাতার সিগারেট জ্বলছে তার। রুমাল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে চেয়ারম্যানের রুমে প্রবেশ করতেই, চেয়ারম্যান সাহেব গম্ভীরভাবে তাকালো আমার দিকে। আমার সালামের উত্তর নিল কিনা ঠিক বুঝতে পারলাম না। মনে হলো বড় কোনো অপরাধী আমি। চেয়ারে বসতে গিয়েই হোঁচট খেলাম। -দ্যাখো আ. কাদের। পরিষদে বসার জায়গা সবার হয় না। তার ওপর কোনো অপরাধীর। কোনে কি করে এসেছো আলস্নাহপাকই জানেন। ওসি সাহেব তো ঘণ্টায় ঘণ্টায় তোমার খোঁজখবর নিচ্ছেন। বড় কোনো বিষয় হবে হয়তো। তবে দ্যাখো দুই চার পঞ্চাশ হাজারে কিন্তু কাম হবি নানে। টাকা দুই লাখ জোকার করো। তারপর দেখতিছি। আমার ইউনিয়ন থেকি আসামি লিলে যাওয়ার ক্ষমতা পুলিশের নাই। - এসব কি কন চেয়ারম্যান সাহেব। কল্যাণী রানী দাসকে আমি চিনিনা। আর সে বিদেশি। আমার নামে কেন সে থানা পুলিশ করতি যাবি? -সেসব আমাক বইলি লাভ হবিলানে। আমি তোমার ভালো চাই বলিই এসব বলতিছি। রাজি না হলি থানায় সংবাদ দেই। পুলিশের হাতে তুইলি দেই। তারপর দুই-চার ঘা দিলেই সব বারানিনি। আজকের এই ঠান্ডা ঠান্ডা আবহাওয়ার মধ্যে ঘেমে উঠি আমি। একি জ্বালায় পড়লিম। কোনকার কোন কল্যাণী রানী দাস। তার জন্যই আজ আমার ঘুম হারাম হবার অবস্থা। খাওয়া হারাম হবার অবস্থা। \হ-আমাক দিনা দইয়েকের জন্যি সময় দ্যান চেয়ারম্যান সাহেব। বাড়ির গরুডা বিক্রি কইরি হাজার পঞ্চাশ টাকার ব্যবস্থা করি আমি। -ওসবে কাম হবিলানে কচ্ছি। পুরা দুই লাখই লাগবি। তাও দেখি ওসি সাহেবকে রাজি করাতি পারি কিনা। -কি কন চেয়ারম্যান সাহেব। আমি এত টাকা কোনে পাব। তার চেয়ে আপনে আমাক পুলিশের হাতে দ্যান। আমি কোটে কাঠগড়ায় দাঁড়ায়ে ক্ষমা ভিক্ষি করি। কোনু রকম অপরাধ না কইরি যদি অপরাধী সাজা লাগে! তালি আর এদেশে গরিবের বিচার কোনে? চেয়ারম্যান সাহেব নাছোড়। অবশেষে দেড় লাখ টাকায় রাজি হতে হয়। বাড়িতে তিনটা গরু ছিল আমার। আগামীকাল অরণখোলা হাটে বিক্রি করতে হবে। নইলে আর কোনো রাস্তা দেখতে পাচ্ছি না আমি। ইউনিয়ন বোর্ড থেকে বাড়ি যেতে যেতে পাক খেয়ে পড়ার অবস্থা হয় আমার। চোখে আন্ধার দেখতে থাকি। বাড়িতে গিয়ে এসব কথা বউকে বলার পর তো, জোবেদার মা মরা বাড়ির কান্না শুরু কোরলি। -এই ছিলি আমার কপালে। হারামজাদা কোন মাগির সাতে কি করিছে তার জন্যি আজ আমার গরু, বাছুর ঘরবাড়ি সব বিক্রি করতি হবি। আরে পুলিশ কি তোক কম থুবিনি। আমার ছাওয়াল মিয়ি সব আজ পথে বসলি বইলি। ও আমার আলস্নাহ্‌। কান্নাকাটি শুনে বাড়ির আশপাশের লোকজন জড়ো হয়। নানাজন নানা কথা বলতে থাকে। তখন আমার মনে হলো আজ আমি বিষ খাইয়ে মরি। একজীবনে এত অশান্তি আর ভালো ঠ্যাকে না। তখন আমার সেই কল্যাণী দাসকে একবার দেখতে ইচ্ছে হলো। তার মুখের উপর বলতে ইচ্ছে হলো। কোন অপরাধে আমাকে এভাবে শাস্তি দিচ্ছেন আপনে? কিন্তু কোথায় পাবো আমি কল্যাণী দাসকে। পরেরদিন সকালবেলায় বাড়ির সামনে পুলিশের গাড়ি থেকে চমকে উঠি আমি। বুক শুকিয়ে আসে। কাউকেই কিছু বলতে পারি না। আশপাশের বাড়ি থেকে কেউই বের হয় না। মনে হয় এটা কোনো জঙ্গি আস্তানা। আমি বড় কোনো জঙ্গি দলের নেতা। আমার বাড়ি থেকে কোনোভাবে বের হওয়ার অবস্থা নেই। কিছু সময়ের মধ্যে সাইরেন বাজাতে বাজাতে আরও এক গাড়ি পুলিশ এলো। বাড়িতে রান্নাবাড়ি বন্ধ আজ। ছেলেমেয়েগুলোও না খেয়ে আছে। বাড়িতে চিড়ামুড়ি থাকলেও এ সময় কারও মুখে কিছু ওঠার কথা নয়। দুপুর হই হই সময়। একবার চেয়ারম্যানকেও দেখা গেল। কিন্তু সে আমার কাছে এলো না। এ অবস্থা দেখে আমার মনে হলো, আজ নির্ঘাত আমার জন্য বড় কিছু অপেক্ষা করছে। দুপুরের পরে আমার বাড়িতে ডিসি এসপি সবাই এলো। বাড়িতে তিনটা পস্নাস্টিকের লাল চেয়ার মাত্র। কোথায় যে বসতে দিই তাদের। ডিসি সাহেব আমাকে কাছে ডেকে নিলেন। আমাদের বসতে হবে না কাদের সাহেব। হঠাৎ করে আমি অপরাধী থেকে সাহেব হয়ে গেলাম। সে বললো, শুধু ম্যাডাম এসে বসতে পারলেই হলো। কিছু সময় পর আরও একটা গাড়ি এলো। হলুদ রঙের গাড়ি। গাড়িটাকে দেখে মনে হলো, হলুদ রঙের শার্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে কোনো এক হিমু। মনে হলো আমি কোনো স্বপ্ন দেখছি। গাড়ি থেকে নেমে এলো আমাদের অপেক্ষার সেই রানী। তখন চোখ তুলে তাকিয়ে, একবারও চমকে উঠিনি আমি। অপেক্ষার রানীকে দেখে মনে হলো, একসঙ্গে চারক্লাস পড়েছি আমরা। একই গ্রামে বাড়ি আমাদের। ছোটবেলায় কত কথা হতো তার সঙ্গে। একসঙ্গে কতদিন এক স্কুলে গেছি আমরা। একদিন প্রথম ভালোলাগা প্রকাশ করেছিলাম যার কাছে। রানীকে চোখ মুছতে দেখে আমি আর ঠিক থাকতে পারলাম না। এত এত লোকের মধ্যে রানী আমাকে জড়িয়ে ধরল। কাছে ডেকে লাল চেয়ারে বসালো। সবাইকে দূরে সরিয়ে দিয়ে এই মাটিকে প্রণাম করল। অতঃপর একান্তে কিছু কথা হলো তার সঙ্গে আমার। একবার উঠে দাঁড়িয়ে, নিজের বাড়ির দিকে তাকিয়ে আমাকে বলল, তুই কি জানিস কাদের? আমাদের জন্ম ভিটাটা কীভাবে আলাউদ্দিন রাজাকারের হলো। বলতে পারিস কেমন করে কীভাবে আমাদের স্বজনরা গ্রামছাড়া হলো। দিনে দিনে সংখ্যালঘু হলাম আমরা। মনে পড়ে কত ভয়াবহতায় এদেশ ছেড়েছিলাম আমরা। আর কিছু বলতে পারল না রানী। মনে হলো আমি যেন স্বপ্ন দেখছি তখন। অবশেষে সব পাখির মেলা শেষ হলে! আমি বুঝলাম, জন্মভিটা হারানো পশ্চিমবঙ্গের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার মন্ত্রী কল্যাণী রানী দাস একদিন আমার বন্ধু ছিল।