আমাদের নাটক মানে

নাটকের চিরাচরিত আঙ্গিকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ

প্রকাশ | ১৫ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

তৌফিকুর রহমান
কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ৭১তম জন্মদিন উপলক্ষে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নাট্যদল বহুবচন গত ১৩ নভেম্বর বুধবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় মঞ্চায়ন করল হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে নাটক 'দেবী'র ১২০তম মঞ্চায়ন। মঞ্চায়নের অধিকর্তা এবং মঞ্চের মিসির আলীখ্যাত অভিনেতা তৌফিকুর রহমান যায়যায়দিনের আহ্বানে কথা বলেছেন দেবীর মঞ্চায়ন, হুমায়ূন আহমেদকে স্মরণ এবং দলীয় কার্যক্রম নিয়ে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন- অপূর্ব কুমার কুন্ডু \হ যায়যায়দিন : হুমায়ূন আহমেদকে স্মরণ আয়োজন নিয়ে কিছু বলুন। তৌফিকুর রহমান : দেখুন সম্প্রতি আমি মঞ্চে দুটি বায়োগ্রাফি আশ্রিত নাটক দেখলাম। শেখ সাদী এবং কালিদাস। একজন পারস্যের কবি অন্যজন প্রাচ্যের। নাটক দুটির নাট্যকারের কথা অংশে দেখলাম কবিদ্বয়ের জীবনী গ্রন্থ সেভাবে পাওয়া না গেলেও তাদের রচিত গ্রন্থগুলো পাওয়া যায়। যেমন- গুলিস্তা, বোস্তা, কুমার সম্ভব, অভিজ্ঞান শকুন্তলা প্রভৃতি। ফলে আমার একটা ভাবনা মনে এলো, চারদিকে আজ এত যে প্রচার প্রচারণা, নিজের ঢাকে নিজেরই ঢোল পেটানোর তাড়না সে সবই কি দীর্ঘকাল টিকে থাকবে? অথচ শেখ সাদী প্রায় ৮০০ বছর আগেকার মানুষ হয়ে আজও টিকে আছে তার কৃতকর্মের মধ্যদিয়ে। কালিদাসও একইভাবে বেঁচে আছে তার সৃজন কর্মের মধ্যদিয়ে। ফলে কর্মই মানুষকে অমরত্ব পাইয়ে দেয়। বাংলাদেশের হুমায়ূন আহমেদের জাদুকরী লেখা দিয়ে যেভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনের টানাপড়েন, হাসি-কান্না, চাওয়া-পাওয়া, সমাজ বাস্তবতা তুলে ধরেছেন তা এক কথায় নান্দনিক এবং অনবদ্য। হিমু চরিত্রের বিবাগীমন আর মিসির আলী চরিত্রের যৌক্তিকতায় নিমগ্ন এমন মানুষ শুধু বাংলাদেশে কেন বিশ্বের অনেক দেশে প্রবাসী বাঙালির ভিড়ে দেখা মিলবে। ফলে হুমায়ূন আহমেদ স্বশরীরে আজ আমাদের মধ্যে না থাকলেও তিনি জীবন্ত তার সৃজিত কর্মের মধ্যদিয়ে। আমরা নাটকের মানুষ, নাটক মঞ্চায়নের মধ্যদিয়েই তাকে আমরা স্মরণ করেছি, শ্রদ্ধা জানিয়েছি। ৪৮ বছরের দল আমাদের। আমরা বহুবচনই প্রথম তার নন্দিত নরকে উপন্যাসকে মঞ্চনাট্যরূপ দিয়ে মঞ্চে আনি। তারপর দেবী। প্রথমটি আপাতত অনিয়মিত মঞ্চায়ন হলেও দেবী আমরা নিয়মিত মঞ্চায়ন করছি। সেটি যেমন দেশে তেমনি বিদেশে। ফলে হুমায়ূন আহমেদের ৭১তম জন্মদিনকে আমরা উদযাপন করেছি 'দেবী' নাটক মঞ্চায়নের মধ্যদিয়ে। যায়যায়দিন : নন্দিত নরকে এবং দেবী মঞ্চায়ন প্রসঙ্গে আপনার মতামত কী। তৌফিকুর রহমান : হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে মঞ্চ মাধ্যমে পথচলায় নাট্যদল বহুবচন সঙ্গত কারণে গৌরবের অংশীদার। ১৯৭৫ সালের শেষ নাগাদ আমরাই মঞ্চে আনি 'নন্দিত নরকে' উপন্যাসের নাট্য প্রযোজনা। উপন্যাস থেকে নাট্যরূপের জটিল কর্মটি কীভাবে করা হবে প্রশ্নে হুমায়ূন আহমদের সমাধান ছিল, 'জাফর ইকবালকে বলে দেবো, ও-ই নাট্যরূপ দেবে'। সত্যি সত্যি তখন আমরা ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালের নাট্যরূপে নাটকটি মঞ্চে আনি। নারী হৃদয়ের রক্তক্ষরণের এই নাটকটি একদিকে যেমন দর্শকপ্রিয়তা পায় অন্যদিকে আমরা ধারাবাহিকভাবে অনেক প্রদর্শনী করতে পারি। এরপর আমরা দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিই, হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় উপন্যাস 'দেবী' মঞ্চায়ন করব। একদিন আমরা লেখকের গ্রিনরোডের বাসায় হাজির। আমাদের চাওয়ার বিপরীতে তার অভিব্যক্তি ছিল প্রাণবন্ত, নান্দনিক ও অকৃত্রিম। তিনি বলেছিলেন, 'আমার নাটক লেখার অনুপ্রেরণা তো বহুবচন। আমার যে কোনো নাটক আপনারা নাট্যরূপ দিয়ে মঞ্চস্থ করতে পারেন। আপনাদের প্রতি আমার বিশ্বাস আছে।' এরপর আমাদের দলে এক সময়ের সভাপতি ও আজীবনের নাট্যকর্মী বন্ধু মো. ইকবাল হোসেনের নাট্যরূপে আর আরহাম আলোর নির্দেশনায়, দেড় বছরের মহড়া শেষে ১৯৯৪ সালে মঞ্চে আসে 'দেবী'। এটি দেশ ও কলকাতায় নাট্যানুরাগী এবং নাট্যবোদ্ধাদের কাছে বহুল প্রশংসিত প্রযোজনা। ২৫ বছর ধরে এটি মঞ্চায়ন হচ্ছে। যায়যায়দিন : দেবী নাটকের কাহিনী যদি সংক্ষেপে বলুন। তৌফিকুর রহমান : দেবী এক রানু নামের ষোল-সতের বছর বয়সি কিশোরীর মনের চেতন এবং অবচেতন মনের দ্বন্দ্বের গল্প। একদিকে রানুর মনোজগতে দেবীর উপস্থিতি অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মিসির আলীর যৌক্তিক বাস্তব ব্যাখ্যার মধ্যদিয়ে তৃতীয় মাত্রার আত্মোপলব্ধির নাটক দেবী। রানুকে নিয়ে রহস্য আবার রহস্যের উন্মোচন শেষে নতুন রহস্যের অবতারণ একদমই হুমায়ূন আহমদের রচনার অতি আশ্চর্য কৌশল। যায়যায়দিন : দেবী নাটকের কলাকুশলী কারা কারা? তৌফিকুর রহমান : অভিনয়ে মনু মাসুদ, সালাউদ্দীন আহমেদ, রুমানা হোসেন, ম্যাগডিলিন গমেজ রীনা, হ্যাপী সিকদার, স্বর্ণা, মোহাম্মদ উলস্ন্যাহ মাহমুদ, আয়শা মণি, রচনা, সাহিত্য, তাপস, আলো দীপক, আরহাম আলো, জেসমিন, কবিতা, আশিক, সাগর, রাত্রী, আমিসহ আরও অনেকে। যায়যায়দিন : মিসির আলী চরিত্রের সঙ্গে আপনার বোঝাপড়া কেমন? তৌফিকুর রহমান : নটর ডেম কলেজ কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকাল থেকেই আমার নাটকে অভিনয়। আবদুলস্নাহ আল মামুন, মমতাজ উদ্দীন আহমেদ, মনোজ মিত্র, চন্দন সেন প্রভৃতি নাট্যকারদের রচিত নাটকের মুখ্য চরিত্র রূপায়ণ করেছি মঞ্চায়নের ধাপে ধাপে। তবে অভিনয় উপস্থাপনায় আমার কাছে আকৃষ্টের, অনুসরণের এবং অনুকরণের ছিল অভিনেতা উৎপল দত্ত। তার স্পষ্ট উচ্ছারণ, সংলাপের রসাস্বাদন, প্রয়োগের সময় জ্ঞান, দৃষ্টি ক্ষীপ্রতা, সহশিল্পীর প্রতি সহযোগিতা প্রভৃতি আমার সব সময়েই ভালো লাগত এবং স্মৃতিতে এখনো ভালো লাগে। ফলে মিসির আলী চরিত্র রূপায়ণে একদিকে আমি বিবেচনায় রাখি হুমায়ূন আহমেদের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যদিকে উৎপল দত্ত আশ্রিত আমার অভিনয় আঙ্গিক। ফলে মিসির আলী চরিত্রের সঙ্গে আমার বোঝাপড়া শ্রদ্ধার, আত্মস্থ করার সাধনার এবং উপস্থাপন করার তীব্র ব্যাকুলতার। আর এই অভিনয় পরিক্রমায় সদাই আমার সহযাত্রী, সহমর্মী এবং গুণগ্রাহী আমার স্ত্রী শারমিনা তৌফিক যিনি উইংসের আড়ালে দাঁড়িয়ে আমার অন্তরাত্মার প্রেরণা। যায়যায়দিন : বহুবচন নিয়ে আপনার নিজস্ব ভাবনার কথা বলুন। তৌফিকুর রহমান : দেখুন সবে দেশ স্বাধীন হলো। রণাঙ্গনের পালা সাঙ্গ হলো। এবার ভাঙা দেশটাকে গড়ে তোলার পালা। মতিঝিল নিপুণা পেট্রল পাম্পে দিনের পর দিন আড্ডা চলত। অবশেষে সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম নাটক করব। সেলিম, মোতাহার, আরমান, বিন হক, নওশাদ, ঝিনু, মাজহার, বিপস্নব, দুলাল, দুলু আর আমি মিলে কণ্ঠে তুলে নিলাম এই স্স্নোগান- 'আমাদের নাটক মানে শুধু নাটকীয়তা নয়, নাটকের চিরাচরিত আঙ্গিকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ'। দলের নাম রাখা হলো বহুবচন। 'প্রজাপতির লীলালাস্য' নাটক দিয়ে আমাদের দলীয় যাত্রা শুরু, সে দলীয় যাত্রায় ৪৩ বছরে ২২টি নাটক প্রযোজনা করা হয়েছে। চলতি পথ কখনো দ্রম্নত ধাবমান, কখনো ছিল ধীরলয়। শেষাবধি বহুবচন কখনো মঞ্চ ছাড়েনি, ছাড়বেও না। এই অনুকূল-প্রতিকূুল উভয় অবস্থায় বহুবচন বিকশিত হয়েছে আবার নান্দনিকতা অক্ষুণ্ন রেখে প্রকাশিত হয়েছে। এটাই আমাদের আনন্দ ও গর্ব। সামনে নতুন নাটক নিয়ে নতুন গতিতে এগিয়ে চলবে বহুবচনের পথচলা। যায়যায়দিন : যায়যায়দিনের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ। তৌফিকুর রহমান : ধন্যবাদ যায়যায়দিনকেও।