চাঁদনী রাত

প্রকাশ | ২৯ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

শহিদুল ইসলাম লিটন
রাতুল আর ঋতু আজ তাদের বিবাহবার্ষিকী তাদের দাম্পত্য জীবন আজ দুবছর পূর্ণ হয়েছে। দিনের বেলা বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয় স্বজনের বাসায় ঘুরাঘুরি করে রাতের খাবারটি তারা হোটেলে সেরে আসে। আজ বেশ ঘুরাঘুরি করায় শরীরে বেশি ক্লান্তি অনুভব করছে তারা। তাই অন্যান্য দিনের মতো বিলম্ব না করে আজ তাদের তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। রাতুল মনে করছে বিছানায় শুয়ে পড়লে হয়তো সে খুব সহজেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাবে। কিন্তু হঠাৎ একটি চিন্তা তার মনে উদ্রেক হয়। সেই দৃশ্য তার চোখে বারবার ভেসে ওঠায় শত চেষ্টা করেও সে মনকে সংযত করতে পারছে না। ভাবছে আজতো চাঁদনী রাত, ঘুম যখন আসছে না ছাদ থেকে একটু ঘুরে আসি। মিটি মিটি তারার আলো আর অপরূপ চাঁদের দৃশ্য দেখে মনকে একটু হালকা করতে চায় রাতুল। সে বারবার চেষ্টা করে আকাশের অপরূপ মিতালির মাঝে যদি সে ভাসিয়ে দিতে পারে তার দুঃস্বপ্নকে তখন হয়তো নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে। ক্লান্ত শরীরে ঘুমের আবেশ, কিন্তু চোখের পাতায় দুঃস্বপ্নের প্রলেপ শত চেষ্টা করেও তার চোখে ঘুম আসতে চায় না। প্রিয় মানুষটিকে কাছে না দেখে ঋতুও ছুটে চলে যায় ছাদে। ঋতু রাতুলকে প্রশ্ন করে আজতো তুমি বেশ ক্লান্ত, না ঘুমিয়ে এত রাতে তুমি ছাদে কি করছো। রাতুল ঋতুর প্রশ্নের উত্তর দিতে কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়ে যায়। খুব সহজে তার মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। সে যেন আকাশের দিকে অপলক দৃষ্টিতে থাকিয়ে আছে। ঋতু রাতুলকে একটু ধমক দিয়ে বলে শোনতে পাচ্ছ না, আমি কি বলছি। তুমিতো কবি বা সাহিত্যিক নও যে, আকাশের দিকে থাকিয়ে কবিতা লিখবে। রাতুল ঋতুকে বলে- তুমি অভয় দিলে আজ আমি তোমাকে সত্যি একটি ঘটনা বলতে চাই। ঋতু বলে, বলো তাড়াতাড়ি, আমি মনোযোগ দিয়ে শুনবো তোমার কথা। জানো ঋতু আজ আমরা যে হোটেলে খাবার খেতে গিয়েছিলাম তার পাশের আসনে বসাছিল মোট চারজন লোক। স্বামী-স্ত্রী, আর সঙ্গে ছিল একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। তুমি প্রত্যেক্ষ করছো কি না আমি নিজেকে অপরাধী মনে করে খুব তাড়াহুড়ো করে তোমাকে নিয়ে বেরিয়ে আসি। তার কারণ তুমি কি জানো? ঋতু বলে- না। জানো ঋতু, আজ প্রায় পনের বছর পর প্রাণের প্রিয় সাথীর সঙ্গে আমার দেখা। চোখে চোখ পড়তে আমি নিজেকে অপরাধীর মতো আড়াল করে নেই। সাথী হয়তো জানতো আমি বিস্তৃতির অতল গহ্বরে কখন যেন হারিয়ে গেছি। কিন্তু বিধাতার অশেষ কৃপায় আমি যে আজ পর্যন্ত বেঁচে আছি, সে হয়তো জানে না। আমাকে আবিষ্কার করতে যদি তার দৃষ্টি আরও গভীর হয়, হঠাৎ যদি সে বলে ফেলে, তুমি কি রাতুল? তখন তাকে আমি কি জবাব দেব। এই ভয়ে আমি খুব তাড়াতাড়ি করে চলে আসি। ঋতু জানতে চায়, সে দেখতে কেমন? তুমি কেন তাকে বিয়ে করনি? ঋতু সে এক ইতিহাস। বিধির বিধানে যদি তার সঙ্গে আমার সংসার করা কপালে না থাকে তাহলে একজনমের প্রেমও সেখানে বিফল হয়। হরিণীর মতো টানাটানা ছিল তার দুটো চোখ, যেন দেখতে জলে ফোটা পদ্ম, অপরূপ মায়াবী চেহারা, সুন্দরে সুসমায় ছিল- এক কথায় সে অনন্যা। সে ছিল খুব রক্ষণশীল এবং পবিত্র ছিল তার মনমানসিকতা। তার মুখে মোনালিসার মতো ছিল ভুবনজয়ী মনকাড়া হাসি। কিন্তু বাস্তবতা যে একদিন, সবকিছু কেড়ে নিয়ে ম্স্নান করে দেবে সব আশা সব স্বপ্ন, তা কি কেউ জানে। জানো ঋতু, সাথীর খাবারের টেবিলে হোটেল বয় যখন অর্ডার নিতে আসে, তখন বাচ্চাদের আবদার ছিল একটু ভালো খাবারের, কিন্তু সাথী বারবার বারণ করছে। শেষে খুব কমদামের হালকা খাবারের জন্য বাচ্চাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছে। সেই দৃশ্যটুকু আমাকে দারুণভাবে মর্মাহত করেছে। আমি বুঝতে পেরেছি, আমার সাথী সাংসারিক জীবনে খুব একটি স্বচ্ছল নয়। অথচ আমাদের টেবিলে দামি খাবারটুকু অধিকাংশ উচ্ছিষ্ট হিসেবে ফেলে দেয়া হবে। আমি কি পরিচয়ে তাদের সহায়তা করব আমি বারংবার উদ্যোগ নিয়েও বিবেকের কাছে হেরে যাই। এই সহায়তার পরিণাম যদি এক সময় সাথীর জীবনে কাল হয়ে আসে। মনে পড়ে অতীতের স্মৃতির কথা, যখন সাথীর সঙ্গে আমার গভীর ভালোবাসা ছিল, নিকটাত্মীয় হিসেবে অনেক সময় তাদের বাড়িতে আমার প্রায়ই খাওয়া দাওয়া হতো। একদিন সাথী আমাকে বলল, দিব্যি করে বলছি, আজ আমি তোমাকে যা খেতে দেব, তুমি কিন্তু তা ফিরিয়ে দিতে পারবে না। আমি বললাম, ঠিক আছে। একসঙ্গে যখন খেতে বসি তখন সাথী তার খাবারের মাংসের অংশটুকু আমায় দিয়ে দেয়। আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও তা খেয়ে ফেলি। আর আজ হোটেলে সেই দামি খাবারটুকু আমি খেতেও পারছি না, সাথীকে দিতেও পারছি না। সেই বেদনাবিধুর স্মৃতিটুকু আমার কোমল হৃদয়ে বারবার আঘাত দিচ্ছে। আজ বিবেকের দংশনে আমি লজ্জিত, অনুতপ্ত। সাথীর প্রতিদান আমিতো কোনো দিন শোধ করতে পারব না। রাতুল ঋতুকে সব সত্যিকথা বলে আমিতো ইচ্ছাকৃত আমার প্রিয় মানুষটিকে জীবন সঙ্গিনী থেকে বঞ্চিত করিনি। আমার প্রেম এবং প্রতিশ্রম্নতি ছিল সত্য এবং পবিত্র। হঠাৎ একদিন আমি গুরুতর অসুস্থ হই। আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার আমাকে বলে যে, আমি যে রোগে আক্রান্ত তাতে আমার বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম। তাই আমি সিদ্ধান্ত নেই আমার সংকীর্ণ জীবন আর নিরানন্দের বৃত্তে সাথীকে বন্দি করে তার অনাগত ভবিষ্যৎ, আর মূল্যবান জীবনকে নষ্ট করে আমি পরম করুণাময়ের কাছে অপরাধী হতে চাইনি। আমি বিদেশে গিয়ে চিরকাল সাথীর চোখ থেকে আড়াল হয়ে যাই। বিদেশে মোটামুটি ভালো আয় রোজগার করি। একাকিত্বের অবসান থেকে মুক্তি পেতে আমি এক সময় কন্ট্রাক ম্যারেজ করি। আর্থিক সচ্ছলতার কারণে অনেক দর্শনীয় স্থানে আমরা ভ্রমণ করি। হাসি-আনন্দ আর উচ্ছ্বাস মনের মধ্যে যেন এক পুলক সৃষ্টি হয়। কিন্তু অর্থবিত্ত আর চাকচিক্যের মধ্যে ডুবে থাকলেও ভুলে যাইনি দেশের কথা। মন যে সবসময় পড়ে থাকে দেশের মাটিতে, দেশের আসার আগে ডাক্তারের কাছে গিয়ে নিজের শরীর ভালোভাবে চেক করাই। ডাক্তার আমাকে বলে আমি পুরোপুরি সুস্থ। আপনি নির্ভয়ে দেশে যেতে পারেন। আমি আজ দেশে আমার ব্যবসা-বাণিজ্য আর ঋতু তোমাকে নিয়ে বেশ ভালোই আছি। বেশ ভালো চলছে আমাদের সংসার কিন্তু আমার সাথীকে আমার জীবনে প্রিয় সঙ্গী হিসেবে জীবন সঙ্গিনী করা হলো না। আমার প্রেম আমার ভালোবাসা মিথ্যে প্রমাণিত হলো। সাথীর পরিবর্তে ঋতু হলো আমার জীবন সঙ্গীনি। সাথীর অবিকল প্রতিচ্ছবি দিয়ে বিধাতা তোমাকে পাঠিয়েছে আমার ঘরে। তোমার ভুবনজয়ী হাসির মধ্যে আমি খুঁজে পাই আমার সাথীকে। যখন ভাবি দারিদ্র্যতা আমার সাথীর নিত্যসঙ্গী, তখন কেঁদে কেঁদে দুচোখের জলেভাসি। ঋতু তুমি কি আমার ছোট একটি অনুরোধ রক্ষা করতে পারবে। নিকট আত্মীয়তার সূত্রে তুমি সাথীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখবে। আমার পরিচয়ে নয়, তোমার পরিচয়ে তুমি কি সাথীকে ছোট বোন হিসেবে গ্রহণ করবে। ঋতু আমি কথা দিলাম, আমি কোনোদিন সাথীর মুখ দর্শন করব না। তোমার একটু আর্থিক সহায়তায় যদি সাথী ফিরে পায় সচ্ছলতা, বাচ্ছাদের নিয়ে সাথী যদি একটি সুখী সুন্দর আনন্দময় জীবনযাপন করতে পারে, তবেই আমি তার অভিশাপ থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পাব। তমসার বুক চিরে সূর্যের আলো পৃথিবীকে আলোকিত করার পূর্বেই আমার হৃদয় থেকে যদি সাথীর দুঃসহ জীবনের করুণ স্মৃতি ম্স্নান হয়ে যায় তবে মরে গেলেও আমার আত্মা শান্তি পাবে। আমি তোমার কাছে শুধু এই অনুকম্পাটুকু চাই ঋতু।