জ্যোৎস্না ও জনকের গল্প

প্রকাশ | ২৯ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

ওমর খালেদ রুমি
আমরা ছয় ভাই-বোন। বলতে গেলে পিঠাপিঠি। মাঝখানে তিন-চার বছরের ব্যবধান। বলতে গেলে ছোট-খাটো একটা দল। বাবা, মা আমাদের দলবেঁধে মাজারে নিয়ে যাচ্ছে। বাগেরহাটের খানজাহান আলীর মাজার। আমরা যাচ্ছি নৌকায় করে। মাঝি দিনক্ষণ, জোয়ার-ভাটা সব ঠিকঠাক করে নিল। আমরা যথাসময়ে রওনা হলাম। কয়েকদিন নৌকায় থাকতে হবে। ভালোই লাগছে বলতে হবে। জোয়ার আর ভাটার স্রোতকে কাজে লাগিয়ে নৌকা চলছে। এ ছাড়া উপায় নেই। খরস্রোতা নদী। স্রোতের বিপরীতে চলা প্রায় অসম্ভব। নদীতে মাঝেমধ্যে তুফান, জলের ঘোলা, মাঝি শক্তহাতে বৈঠা ধরছে। তবুও একবার নৌকা ডোবার উপক্রম হলো। মা আয়াতুল কুরসি পড়ে সবার গায়ে ফুঁ দিলেন। বিপদ কেটে গেলে আমরা হাসলাম। মাঝির নাম তোফাজ্জল। সে এলাকার সেরা মাঝি। তবুও তাকে বেগ পেতে হচ্ছিল। মাঝেমধ্যে স্রোত আর তুফানের কাছে তাকে অসহায় লাগছিল। মাজারে পৌঁছে প্রথমে দোয়া করা হলো। আমরা বলতে গেলে সবাই ছোট। বাবা-মা দোয়া করলেন। আমরা হাত তুলে যোগ দিলাম। অতঃপর বিরাট দীঘিতে গোসল করা। তারপর শখের জিনিসের কেনাকাটা। সময় খুব দ্রম্নত কেটে যাচ্ছিল। মাঝখানে খাওয়া-দাওয়া করে নিলাম। বাগেরহাট ছোট শহর। সেই ছোট শহরেই আমরা তিন ভাই-বোনের একটা ছোট দল ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ বাকিদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেলাম। হারিয়ে গিয়ে কেউ কেউ কাঁদতে শুরু করলাম। অবশ্য অতি অল্প সময়ের মধ্যে বাবা-মা আমাদের খুঁজে বের করে ফেলল। অতঃপর মৃদু বকাঝকা। এসবে তখন খুব একটা মাথাব্যথা নেই। ঘোরার মজাই আলাদা। পরের বছর বাবার সঙ্গে একাই রওনা হলাম। গন্তব্যস্থল বরিশাল। শীতের ঘন কুয়াশা ঢাকা ভোরে প্রায় চার মাইল হেঁেেট গিয়ে তারপর কাঠের এক তলা লঞ্চ। লঞ্চের নাম চরদোয়ানী। সেই লঞ্চ অবিরাম আওয়াজ তুলে সারাটা দিন চলল। মাঝখানে কিছু কিছু ঘাটে ভিড়ল। তারপর সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। চোখ যখন ঘুম ঘুম ভাব তখনই আলোকোজ্জ্বল বরিশাল শহর দৃষ্টিগোচর হলো। আমার বড় ভাইয়ের বাসায় যখন পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় নয়টা। ভাত খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। জীবনে এই প্রথম কোনো বড় শহরে এলাম। এখানে এসে অনেক কিছু দেখলাম। রেডিওর সঙ্গে পরিচয় হলো। নতুন জামা-কাপড় পেলাম। বড় ভাই বাড়ির জন্য একটা রেডিও কিনে দিলেন। ন্যাশনাল রেডিও। সার্ভিস ভালো। সবকিছু স্পষ্ট শোনা যায়। কয়েক দিন শহরে বেড়িয়ে আবারও সেই লঞ্চযোগে বাড়ি ফেরা। একটা ভ্রমণ যেন আমাকে অনেকটা বড় করে দিল। আট বছরের একটা শিশুর জন্য এটা সত্যিই দারুণ একটা বিজয়। জীবনের জন্য এর প্রভাব অনেক অনেক বেশি। পরের বছর পরীক্ষা শেষ করে আবারও ভ্রমণ। এবার গেলাম নানা বাড়ি। সন্ধ্যার পর পরই রওনা হলাম। আমার জন্য দীর্ঘ পথই বলতে হবে। টানা নয় মাইল। নয় বছর বয়সের একটা বাচ্চার জন্য এই পথ হাঁটা কষ্টসাধ্য নয়। তবুও এই পথ পাড়ি দেওয়া খুব বেশি কঠিন মনে হচ্ছে না। কারণ আর কিছু নয়। বাবার সাথে যাচ্ছি। এই যাওয়ার আনন্দই আলাদা। সন্ধ্যার পর হালকা একটু অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। তারপর যত পথ পাড়ি দিচ্ছিলাম জ্যোৎস্না ততই প্রবল হচ্ছিল। এক সময় চারদিক ধব ধবে সাদা মনে হচ্ছিল। আমি কিছুটা পথ হাঁটছিলাম। কিছুটা পথ বাবার কাঁধে চড়ছিলাম। গ্রাম পেরিয়ে খোলা মাঠ। সেই মাঠের মাঝখান চিরে সাপের শরীরের মতো আঁকা-বাঁকা রাস্তা। যতদূর চোখ যায় ধু-ধু মাঠ। এখানে উন্মুক্ত মাঠ আর খোলা আকাশের নিচে জ্যোৎস্নার পস্নাবনে সব কিছু মিলেমিশে একাকার। বলার অপেক্ষা রাখে না- এখন শীতকাল। মাঠের ফসল উঠে গেছে। মাঠ শুষ্ক। সেই মাঠে রবিশস্য চাষ করার আয়োজন চলছে। এই দৃশ্য আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু সেদিনের জ্যোৎস্নাভেজা ভ্রমণে এসব চিরচেনা দৃশ্যেরও ভিন্ন একটা গভীর তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ দাঁড়িয়ে গেল। নয় বছর বয়সের একটা শিশুর কাছে পুরো পরিবেশটা একটা অন্যতম আবেগ নিয়ে ধরা দিল। আমরা এভাবেই বেড়ে উঠি। নানাবাড়িতে শীতকালে বেড়ানোর পাশাপাশি সার্কাস দেখা যাবে। টানা সাতদিনব্যাপী আয়োজন। সার্কাস, পুতুল নাচ, যাত্রাপালা আরও কত কী? সেই সঙ্গে হাতি দেখার আনন্দ। পরদিন থেকেই শুরু হবে। মনের ভেতর অন্যরকম একটা অস্থিরতা। আমি যেন ভেতরে ভেতরে আনন্দে ভেসে যাই। নানাবাড়িতে দিনভর আনন্দ। সন্ধ্যার পরপরই চলে যাই সার্কাসের মাঠে। বিখ্যাত লক্ষ্ণণ দাসের সার্কাস। বিরাট বিরাট হাতি বাঁধা রয়েছে প্যান্ডেলের থেকে কিছুটা দূরে। সেই হাতি বড় বড় কলাগাছ শুঁড় দিয়ে ভেঙেচুরে চুরমার করে খাচ্ছে। কলাগাছের মতো অর্থহীন একটা জিনিসের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার দেখলাম। একরাতে সার্কাস দেখি তো অন্যরাতে পুতুল নাচ। পরের রাতে আবার যাত্রাপালা। তারপর একটা বন্ধ ঘরের মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মোটরসাইকেলের খেলা। দেখতে দেখতে সাতটা দিন কেটে যায়। আকাশের বুকে জ্যোস্না ক্রমেই ফিকে হয়ে আসে। আমারও অস্থিরতা বাড়তে থাকে। অন্যরকম অস্থিরতা। বাড়ি ফেরার তাড়া। মায়ের কোলে ফেরার অধীরতা। সার্কাসের বিনোদনও এক সময় ফিকে হয়ে আসে। পরের শীতে আবারও বাবার সাথে ভ্রমণের আয়োজন। এবার মোংলাবন্দর। সেখানে বন্দরের কাছাকাছি ছোট্ট শহরতলিতে আমার এক ফুফু বসবাস করে। তার বাসায় উঠলাম। জীবনে প্রথম এত বড় জাহাজ দেখলাম। হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া আনন্দে বুক ভরে নিশ্বাস নিলাম। এখানে এসে একটা অদ্ভুত জিনিস খেলাম। ফুফুর হাতের করলা ভাজি। করলা যে তিতা এটা প্রমাণ করাই কষ্ট। বাবা-মায়ের সঙ্গে এমনি অজস্র ভ্রমণে জ্যোৎস্না দেখার ভাগ্য আমার হয়েছে। আমার বাবা-মা আজও বেঁচে আছেন। এখনো গ্রামের বাড়িতে গেলে তাদের সঙ্গে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে যখন জ্যোৎস্না দেখি মনে হয় জীবনের চুয়ালিস্নশটি বছর মাত্র একটা ছোট্ট স্বপ্ন।