জীবনানন্দ দাশ ও রূপসী বাংলা

প্রকাশ | ০৬ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

আবু আফজাল সালেহ
কল্পনাশক্তি যত শক্তিশালী হবে কবির কবিতা ততই প্রাণ পাবে। আর যদি উপমা-উৎপ্রেক্ষাগুলো যদি দেশজ হয় তাহলে পাঠকের গভীরে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগে না। কবি জীবনানন্দ দাশের ক্ষেত্রে আমরা তাই দেখি। দেশজ সুলভ সহজ-সরল উপাদানে পাঠক সমাজ মুগ্ধ। আনাচে-কানাচের উপাদানে শব্দের গাঁথুনি খুব কম কবিতায় পাওয়া গেছে। কিন্তু জীবনানন্দের ক্ষেত্রে উল্টাটাই দেখি। তার অনেক কবিতায় বাংলার রূপ তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে রূপসী বাংলা (১৯৫৭ সালে প্রকাশিত) কাব্যগ্রন্থে আমরা পাই মাটির গন্ধ। এ কাব্যগ্রন্থের প্রতি কবিতার পরতে পরতে দেশজ উপাদান ছড়িয়ে। আবার দেখা যায় 'পয়েটিক অর্ডার' ঠিক রেখে শব্দের বুননে অনন্য হয়েছে কবিতাগুলো। আরও বিশ্লেষণ করে বলা যায়, রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতে কবির প্রিয় ঋতু হেমন্তের জয়গানই করা হয়েছে। উপমা-উৎপ্রেক্ষা ব্যবহারে দারুণ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। আবহমান বাংলার আকাশ-বাতাস, পশুপাখি, ফুল-ফল, নদী, নারী প্রভৃতির ভিন্ন ভিন্ন সময়ের বিচিত্র সব দৃশ্য চিত্রায়িত করেছেন। কবিতাগুলো পড়লেই গ্রামের আনাচে-কানাচে ফিরে যাবে। মাঝে-মধ্যে নস্টালজিয়ায় ভুগতে হবে। 'আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে বসে থাকি; কামরাঙা লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতো গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে গেছে- আসিয়াছে শান-অনুগত বাংলার নীল সন্ধ্যা- কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে; ...পৃথিবীর কোনো পথে; নরম ধানের গন্ধ-কলমীর ঘ্রাণ, হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল, চাঁদা সরপুঁটিদের মৃদু ঘ্রাণ, কিশোরীর চাল ধোয়া ভিজে হাত- শীত হাতখান, কিশোরের পায়ে- দলা মুথাঘাস- লাল লাল বটের ফলের ব্যথিত গন্ধের ক্লান- নীরবতা- এরি মাঝে বাংলার প্রাণ; আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি পাই টের। (সংক্ষেপিত,আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে, রূপসী বাংলা) 'গোলপাতা ছাউনির বুক চুমে' কবিতায়- 'গোলপাতা ছাউনির বুক চুমে নীল ধোঁয়া সকালে সন্ধ্যায় উড়ে যায়- মিশে যায় আমবনে কার্তিকের কুয়াশার সাথে; পুকুরের লাল সর ক্ষীণ ঢেউয়ে বারবার চায় সে জড়াতে করবীর কচি ডাল; চুমো খেতে চায় মাছরাঙাটির পায়; ...শজিনার ডালে পেঁচা কাদে নিম-নিম নিম কার্তিকের চাঁদে।' জীবনানন্দের কবিত্বশক্তি বা অন্তর্নিহিত শক্তি যে কত শক্তিশালী তা তার কবিতাপাঠে বুঝা যায়। কবিতায় সুনিপুণ শব্দ প্রয়োগেই প্রমাণ। আমারা বিশ্বসাহিত্যের দেখি, জন কীটস বা ওয়ার্ডসওয়ার্থস প্রমুখের কবিতায় প্রকৃতির উপাদান প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করা হয়েছে। তবে প্রাচুর্যতায় জীবনানন্দ অনেক বেশি। প্রকৃতি- দেশজ উপাদান তুলে আনার ক্ষেত্রে জীবনানন্দ বিরল। এমনকি কীটস-ওয়ার্ডসওয়ার্থের চেয়েও বেশি প্রকৃতি-দেশজ উপাদানে শব্দ বুনেছেন রূপসী বাংলার এ কবি। 'অনন্ত জীবন যদি পাই আমি- তাহলে অনন্তকাল একা পৃথিবীর পথে আমি ফিরি যদি দেখিব সবুজ ঘাস ফুটে উঠে- দেখিব হলুদ ঘাস ঝরে যায়- দেখিব আকাশ শাদা হয়ে উঠে ভোরে- ছেঁড়া মুনিয়ার মতো রাঙা রক্ত- রেখা ... পৃথিবীর পথে যদি ফিরি আমি-ট্রাম বাস ধুলো দেখিব অনেক আমি- দেখিব অনেকগুলো বস্তি, হাট-এঁদো গলি, ভাঙ্গা কলকি হাঁড়ি মারামারি, গালাগালি, ট্যারা চোখ, পচা চিংড়ি-কত কি দেখিব নাহি লেখা তবুও তোমার সাথে অনন্তকালেও আর হবে নাকো দেখা। (সংক্ষেপিত, অনন্ত জীবন যদি পাই আমি, রূপসী বাংলা) আধুনিকতার ছোঁয়াও এনেছেন কবিতায়। নির্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছেন কবিতা। যুক্তির পরম্পরায় কবিতাগুলো সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছে গেছে স্থির সিদ্ধান্তে। যা কবিতাগুলোকে প্রাণবন্ত করে তুলেছেন। বিশ্বসাহিত্যের আর একজন সুন্দরের কবি- যিনি বলেছেন, 'সত্যিই সুন্দর, সুন্দরই সত্য'। সুন্দরের কবি জন কীটস। জীবনানন্দের কবিতায় শব্দ, উপমা বা চিত্রকল্পের ব্যবহার কীটসের কথা মনে করিয়ে দেয়। অবশ্য নান্দনিকতার মাপকাঠিয়ে কীটস এগিয়ে থাকলেও জীবনানন্দ খুব বেশি পিছিয়ে নেই বলে আমি মনে করি। 'সমুদ্রের জলে আমি দেহ ধুয়ে, চেয়ে থাকি নক্ষত্রের আকাশের পানে চারিদিকে অন্ধকার: নারীর মতন হাত, কালো চোখ, ম্স্নান চুল ঝরে যতদূর চোখ যায় নীলজল হৃষ্ট মরালের মতো কলরব করে ...জানি না মাদ্রাজ নাকি এই দেশ? জানি না মালয় নাকি? কিংবা মালাবার? জানি না এ পৃথিবীর কোন পথ কোন ভাষা কোন মুখে এখানে বাতাসে জানি না যৌবন কবে শেষ হয়ে গেছে কোন পৃথিবীর ধুলোতে আমার তবুও আমার প্রাণ তামিলের কিশোরের মতো ওই কিশোরীর পাশে আবার নতুন জন্ম পায় আজ; ...(সমুদ্রের জলে আমি দেহ ধুয়ে) অথবা 'সন্ধ্যা হয়' কবিতার কথা যদি বলি- 'সন্ধ্যা হয়- চারিদিকে মৃদু নীরবতা কুটা মুখে নিয়ে এক শালিক যেতেছে উড়ে চুপে; গোরুর গাড়িটি যায় মেঠো পথ বেড়ে ধীরে ধীরে; আঙিনা ভরিয়া আছে সোনালি খড়ের ঘন স্তূপে; পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে; পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে; পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দু'জনার মনে; আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে আকাশে।' কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া যায়। আর কবিতাকে ফ্রেমের মাপকাঠিতে বাঁধাও ঠিক নয়। তারপরেও ম্যাকলিসের কবিতা সম্পর্কে একটি উক্তি বা সংজ্ঞা আমার বেশ মনে ধরে। তিনি বলেন,'চড়বঃৎু ংযড়ঁষফ হড়ঃ সবধহ নঁঃ নব্থ কবিতার কোনো অর্থ নেই তবে তা হয়ে ওঠে। জীবনানন্দের কবিতায় দেখা যায় কবিতা লিখেননি কবি। অজান্তেই কবিতা হয়ে গেছেন। বলা যায় কবির সূক্ষ্ণ চিন্তা-ভাবনার প্রকাশ করে সুনিপুণ শব্দের পরম্পরায় কবিতা হয়ে উঠেছে। পেয়েছে পাঠকপ্রিয়তা। শিল্পগুণে সার্থকতা পেয়ে অনেক কবিতা কালজয়ী মর্যাদা পেয়েছে। শুধু 'বনলতা সেন' কবিতার কথা বলব- যেটা কিনা শিল্পগুণে শুধু বাংলাসাহিত্যে না বিশ্বসাহিত্যেও অনন্য মর্যাদা পেয়েছে। রূপসী বাংলা-সহ অন্যান্য কবিতাগ্রন্থের বেশির ভাগ কবিতার শেষলাইন মুগ্ধ করছে। অনেক কবিতার শেষলাইন নিয়ে অনেক বিশ্লেষণ করা যাবে। হাজার হাজার লাইনও লেখা যাবে। কবির অনেক কবিতায় ইতিহাস সচেতনার কথা বলা যায়। কবিতায় মিথ-চিত্রকল্পে ইতিহাসের অনেক উপাদান তুলে ধরে কবিতাকে গতিশীল করেছেন। যেমন- এশিরীয়-বেবিলন সভ্যতা নিয়ে তুলে বেশ কিছু কবিতায় তুলে ধরেছেন ইতিহাস-ঐতিহ্য। ছোট্ট একটা কবিতা। মাত্র চার লাইনের। কিন্তু হতাশা বা অস্থায়িত্ব ফুটে উঠেছে অনেক প্রগাঢ়ভাবে। অনেক ক্ষেত্রে অনেক লাইনেও তা তুলে ধরা সম্ভব না। কিন্তু কবি জীবনানন্দ তা পেরেছেন- কয়েক চরণে। এখানেই কবির সার্থকতা। 'চারিদিকে শান্ত বাতি- ভিজে গন্ধ- মৃদু কলরব; খেয়ানৌকোগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে; পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে রবে চিরকাল;- এশিরীয় ধুলো আজ- বেবিলন ছাই হয়ে আছে।'- (চারিদিকে শান্ত বাতি) দেশ থেকে বিদেশ। ইতিহাসের উপাদানও নিয়ে এসেছেন কবিতায়। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ব্যাপারেও কবি সজাগ। সচেতনভাবেই ব্যবহার করেছেন বিশ্বঐতিহ্যের সব উপাদান। শক্তি পেয়েছে কবিতা। গতিশীল হয়েছে অনেক বেশি। ইতিহাস-ঐতিহ্যের ব্যাপারেও কবির যথেষ্ট প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায়। 'রূপসী বাংলা' কাব্যেও তার প্রমাণ মেলে কয়েকটি কবিতায়। যেমন- 'তুমি কেন বহু দূরে' কবিতার কিছু লাইন- 'তুমি কেন বহু দূরে- ঢের দূর- আরও দূরে- নক্ষত্রের অস্পষ্ট আকাশ তুমি কেন কোনো দিন পৃথিবীর ভিড়ে এসে বলো নাকো একটিও কথা; আমরা মিনার গড়ি- ভেঙে পড়ে দুদিনেই- স্বপনের ডানা ছিঁড়ে ব্যথা রক্ত হয়ে ঝরে শুধু এইখানে- ক্ষুধা হয়ে ব্যথা দেয়- নীল নাভিশ্বাস; ফেনায়ে তুলিছে শুধু পৃথিবীতে পিরামিড যুগ থেকে আজও বারোমাস; ...জ্বলিতেছে যেন দূর রহস্যের কুয়াশায়,-আবার স্বপ্নের গন্ধে মন কেঁদে ওঠে- তবু জানি আমাদের স্বপ্ন হতে অশ্রম্নক্লান্তি-রক্তের কণিকা ঝরে শুধু স্বপ্ন কি দেখেনি বুদ্ধ- নিউসিডিয়ায় বসে দেখেনি মণিকা? স্বপ্ন কি দেখেনি রোম, এশিরীয়, উজ্জায়িনী, গৌড় বাংলা, দিলিস্ন, বেবিলন?' (সংক্ষেপিত) বহুলপঠিত একটি কবিতা 'আবার আসিব ফিরে'- কবিতায় কবির জন্মস্থান তথা রূপসী বাংলার প্রতি গভীর মমত্ববোধ ফুটে উঠেছে। এমন অবশ্য 'রূপসী বাংলা'র সব কবিতায় উঠে এসেছে। 'আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়ির তীরে- এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে; হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠালছায়ায়; হয়তো বা হাঁস হবো- কিশোরীর- ঘুঙুর রহিবে লাল পায়, সারা দিন কেটে যাবে কলমির গন্ধ ভরা জলে ভেসে-ভেসে; ...হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে; হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্ণীপেঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে; হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে; রূপসা ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেঁড়া পালে ডিঙা বায়- রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে দেখিবে ধবল বক: আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে' বলতে পারি 'তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও' কবিতার সুরে- 'তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও-আমি এই বাংলার পারে রয়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে; দেখিব খয়েরি ডানা শালিকের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে ...বনের হিজল গাছ ডাক দিয়ে নিয়ে হৃদয়ের পাশে; দেখিব মেয়েলি হাত সকরুণ- সাদা শাঁখা ধূসর বাতাসে শঙ্খের মতো কাঁদে: সন্ধ্যায় দাঁড়ালে সে পুকুরের ধারে, খইরঙা হাঁসটিরে নিয়ে যাবে যেন কোন কাহিনীর দেশে- ...চলে যায় কুয়াশায়- তবু জানি কোনোদিন পৃথিবীর ভিড়ে হারাব না তারে আমি-সে যে আছে আমার এ বাংলার তীরে।' দেশজ ও গ্রামীণ উপাদানে শব্দবুননের মাধ্যমে কবি কবিতাকে গতিশীলতা আনয়ন করেছেন। 'রূপসী বাংলা' কাব্যগ্রন্থের সব কবিতায় উঠে-আসা মাটিগন্ধী উপাদান পাঠকপ্রিয়তা পেতে সাহায্য করেছে। এমন একটি কবিতা-'আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে'- 'আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে বসে থাকি; কামরাঙা লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতো গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে গেছে-আসিয়াছে শান- অনুগত বাংলার নীল সন্ধ্যা-কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে; আমার চোখের পরে আমার মুখের পরে চুল তার ভাসে; পৃথিবীর কোনো পথ এ কন্যারে দেখেনিকো দেখি নাই অত অজস্র চুলের চুমা হিজলে কাঁঠালে জামে ঝরে অবিরত, জানি নাই এত স্নিগ্ধ গন্ধ ঝরে রূপসীর চুলের বিন্যাসে পৃথিবীর কোনো পথে; নরম ধানের গন্ধ-কলমির ঘ্রাণ, হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল, চাঁদা সরপুঁটিদের মৃদু ঘ্রাণ, কিশোরীর চাল ধোয়া ভিজে হাত-শীত হাতখান, কিশোরের পায়ে- দলা মুথাঘাস,-লাল লাল বটের ফলের ব্যথিত গন্ধের ক্লান্ত- নীরবতা-এরই মাঝে বাংলার প্রাণ; আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি পাই টের।' 'এই ডাঙা ছেড়ে হায়' কবিতার কথা বলতে পারি। দেশের প্রতি মমত্ব কীভাবে জাগিয়ে তুলেছেন আশপাশের উপাদানগুলো তুলে নিয়ে এসে- 'এই ডাঙা ছেড়ে হায় রূপ কে খুঁজিতে যায় পৃথিবীর পথে। বটের শুকনো পাতা যেন এক যুগান্তের গল্প ডেকে আনে: ছড়ায়ে রয়েছে তারা প্রান্তরের পথে পথে নির্জন অঘ্রানে;- তাদের উপেক্ষা করে কে যাবে বিদেশে বল- আমি কোনো-মতে বাসমতী ধানক্ষেত ছেড়ে দিয়ে মালাবারে-উটির পর্বতে যাব নাকো, দেখিব না পামগাছ মাথা নাড়ে সমুদ্রের গানে কোন দেশে,-কোথায় এলাচিফুল দারুচিনি বারুণীর প্রাণে বিনুনি খসায়ে বসে থাকিবার স্বপ্ন আনে;-পৃথিবীর পথে যাব নাকো ...' 'ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন' কবিতায় কবি মৃতু্যর সময় বা পরেও নস্টালজিয়ায় ভুগছেন যেন- 'ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে; তখনো যৌবন প্রাণে লেগে আছে হয়তো বা -আমার তরুণ দিন তখনো হয়নি শেষ- সেই ভালো- ঘুম আসে-বাংলার তৃণ ...লাল-লাল বটফল কামরাঙা কুড়াতে আসিবে এই পথে যখন হলুদ বোঁটা শেফালি কোনো এক নরম শরতে ঝরিয়ে ঘাসের পরে,-শালিক খঞ্জনা আজ কত দূরে ওড়ে- কতখানি রোদ-মেঘ- টের পাবে শুয়ে শুয়ে মরণের ঘোরে।' অথবা 'সন্ধ্যা হয়ে আসে' কবিতায়- ...রক্তে রক্তে ভরে আছে মানুষের মন রোম নষ্ট হয়ে গেছে-গেছে বেবিলন পৃথিবীর সব গল্প কীটের মতন একদিন ভেঙে যাবে : হয়ে যাবে ধুলো আর ছাই রোম নাই আজ আর-বেবিলন নাই আজও তবু হৃদয়ের হৃদয়কে চাই।' (সংক্ষেপিত) 'মনে হয় একদিন আকাশের' কবিতায় সকরুণ আকুতি- ...মৃতু্যরে কে মনে রাখে?- কীর্তিনাশা খুঁড়ে খুঁড়ে চলে বারো মাস নতুন ডাঙার দিকে-পিছনের অবিরল মৃত চর বিনা দিন তার কেটে যায়- শুকতারা নিভে গেলে কাঁদে কি আকাশ? রবীন্দ্রনাথ আধুনিকতার ছোঁয়া এনেছেন কিছুক্ষেত্রে। মাইকেল, ঈশ্বরচন্দ্র কবিতায় আধুনিকতা আনার চেষ্টা করেছেন। কবি জসীমউদ্‌দীনও কবিতায় আধুনিকতা এনেছেন। কিন্তু দেশজ উপাদান ব্যবহারের নান্দনিকতায় সবাইকে ছাড়িয়ে আধুনিক কবিতা উপহার দিয়েছেন কবি জীবনানন্দ দাশ।