অতিমানবের ঈশ্বরবাসনা

প্রকাশ | ১৭ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

চৌধুরী শাহজাহান
হুমায়ূন মালিকের উপন্যাসগুলোয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং বিষয়াঙ্গিকে অভিনবত্ব বিশেষ করে প্রতীক, রূপক, জাদু ও অধিবাস্তবতার মধ্য দিয়ে তার মিথ ও ইতিহাসের ব্যবহার লক্ষণীয়। অতিমানবের ঈশ্বরবাসনা (২০১৩) সেই ধারাবাহিকতারই ফসল। এই উপন্যাসের উপজীব্য কী উপন্যাসের শেষাংশে লেখক এক বাক্যে নিজেই তা বলেনÑ ‘এ গ্রিন ওশানের কোন এক দ্বীপের নিরেট সত্য এক ইতিহাস।’ (পৃ:Ñ ৯৬) কিন্তু সে ইতিহাস শোষণে-শাসনে-ষড়যন্ত্রে এমনই বিদ্ঘুটে, এতটাই এবড়ো-খেবড়ো আর বৈকল্যে ঠাসা যে বাকি দুনিয়ার কারও কারও কাছে তা এক অবাস্তব ফ্যান্টাসি।’ এই ইতিহাস এবং ফ্যাক্টকে ফ্যান্টাসিধমীর্ এক ফিকশনে রূপদানে লেখকের পারঙ্গমতা আমাদের কৌত‚হলি ও আকৃষ্ট করে। লেখক যদিও বলেন, এ হচ্ছে শ্যাম নামক এক দ্বীপ-রাষ্ট্রের ইতিহাস। কিন্তু শেষ বিচারে এটি শুধু কোনো একক রাষ্ট্রের ইতিহাসে সীমাবদ্ধ থাকে না। দেশজ ঘটনাগুলো হয়ে পড়ে বৈশ্বিক তাৎপযের্ সমুজ্জ্বল। তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র্যপীড়িত মানুষ, পরিবেশ প্রতিবেশের বিপযর্য়, দেশীয় অথর্নীতিতে নব্য সাম্রাজ্যবাদের করাল থাবা, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নব্য ঔপনিবেশিক হস্তক্ষেপ, অস্থিতিশীল রাজনীতি, দুনীির্ত, ঘুষ, মসনদ দখলের অসুস্থ প্রতিযোগিতা, নিম্নমানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সে সুযোগে সামরিক শক্তির প্রত্যক্ষ পরোক্ষ হস্তক্ষেপÑ এসব সাধারণ বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় নিলে উপন্যাসটি হয়ে ওঠে তৃতীয় বিশ্বের এক চলমান ইতিহাস। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বি-উপনিবেশিক প্রক্রিয়ায় স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলোর চিত্র কি এর বাইরে? গত শতাব্দীর শেষ দশকে পূবর্ ইউরোপ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে যে নয়া-বিশ্ব-ব্যবস্থার উদ্ভব হয় এবং তারই ফলে বিশ্বে মাকির্ন যুক্তরাষ্ট্রের একক মহাশক্তিরূপে উত্থান, তার তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে আধিপত্য বিস্তারের নীলনকশাÑ এ সবই উপন্যাসটিতে উঠে এসেছে অভিনব আঙ্গিকে। সাম্রাজ্যবাদ এসেছে নয়ারূপে, অতিজাতিক-বহুজাতিক করপোরেশন এবং তাদের দোসর বড় বড় অথৈর্নতিক সংস্থা তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর আছর করে তাদের অথর্নীতিকে পঙ্গু করে করপোরেট স্বাথের্র ছঁাচে গড়ে তোলে খনি-খামার-শিল্পকারখানা। শেষ বিচারে এটি রাজনৈতিক ইতিহাসকেও ছাড়িয়ে যায়। যখন দেখি ক্ষুধা, দুভির্ক্ষ, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊধ্বর্গতি, পতিতাবৃত্তি, জন্মনিয়ন্ত্রণ, কারখানার বজর্্য, নকল ওষুধের বাজারিকরণ, বিজ্ঞাপনী সংস্কৃতি, মাইক্রো ক্রেডিটের জঁাতাকল ইত্যাদি সামাজিক প্রপঞ্চগুলো এক দক্ষ আর কৌশলী বণর্নায় হয়ে ওঠে জীবন্ত তখন মনে হয়, এ হচ্ছে রাজনৈতিক ইতিহাসের ছঁাচে সামাজিক ইতিহাসের এক স্বাথর্ক রূপায়ন। তবে এসব বিষয় দেহে শিরা-ধমনি তথা রক্তসংবহন তন্ত্রের মতো থাকে শিল্পসম্মতভাবে উপন্যাসের বিষয়াঙ্গিকে গোপন। এ ক্ষেত্রে সুকৌশলে রূপায়িত বিভিন্ন টানটান, রসঘন আখ্যানের মধ্যে নান্দনিক সৌন্দযর্ই প্রধান হয়ে ওঠে।