কবি কাজী কাদের নওয়াজ

বলয়ের বাইরে কলেস্নালযুগের ব্যতিক্রমী একজন

প্রকাশ | ১৭ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

কামাল আহমেদ
বিগত শতকের ত্রিশের দশকে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র বলয়ের বাইরে এসে ইউরোপীয় ভাবধারায় সাহিত্য সাধনার চেষ্টায় কলেস্নাল যুগের সূচনা হয়েছিল। 'তমঘা-ই-ইমতিয়াজ' পদক পাওয়া কবি কাজী কাদের নওয়াজ উভয় ধারার মধ্যে নিজেকে স্বতন্ত্ররূপে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তখন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও স্বতন্ত্রধারায় ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়ে নিজের অবস্থান বাংলা সাহিত্যে পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন। কবি কাজী কাদের নওয়াজ তবুও আলাদা একজন। কবি কাজী কাদের নওয়াজ একাধারে শিক্ষক, কবি, বহুভাষা-পারদর্শী পন্ডিত, ঔপন্যাসিক ও অতি সাহসী একজন মাতৃভাষাপ্রেমিক ছিলেন। তিনি প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারীও ছিলেন। সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের সময়ে উর্দু হরফে বাংলা লিখতে হবে, এমন ঘোষণার প্রতিবাদে এক সাহিত্য সম্মেলনে উপস্থিত অনেকের মধ্যে তিনিই প্রতিবাদী ভাষায় বক্তৃতা করেন। বহুভাষী কবিতা তাদের স্ব স্ব ভাষায় আবৃত্তি করে বাংলায় বুঝিয়ে দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন যে, প্রত্যেকের কাছে মাতৃভাষাই দামি। কবি কাজী কাদের নওয়াজ, শিশু-কিশোরকাব্য ও নীতিকাব্যেই অমরত্ব যার। এই এক অনন্যধারায় তিনি আজও তুলনাহীন। তার কবিতায় মাতৃভক্তি, গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা, শিশুদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, দেশপ্রেম ও নিঃসর্গপ্রেম সাবলীলভাবে ফুটে উঠেছে। ছাত্রজীবনে 'শিশুসাথী' পত্রিকার প্রকাশিত তার 'মা' কবিতায় মাতৃভক্তির যে স্বরূপ দেদীপ্যমান, তা তুলনীয় নয়। প্রথম দুটো লাইন আজও বাংলার ঘরে ঘরে কাপড়ে রঙিন সুতোয় লিখে বাঁধাই করা অবস্থায় শোভিত দেখা যায়, শিশুশিক্ষার পাঠে দেখা যায়। কথাগুলো হলো- 'মা কথাটি ছোট্ট অতি, কিন্তু জেনো ভাই,/ইহার চেয়ে নাম যে মধুর তিন ভুবনে নাই।/সত্য ন্যায়ের ধর্ম থাকুক, মাথার পরে আজি,/অন্তরে 'মা' থাকুক মম, ঝরুক স্নেহরাজী।' তিনি তার 'হারানো টুপি' কবিতায় কবি লিখেছেন : 'টুপি আমার হারিয়ে গেছে/হারিয়ে গেছে ভাইরে/ বিহনে তার এ জীবনে/কতই ব্যথা পাইরে;' কবিতাটি প্রকাশের পর ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। ব্যাপক সাড়া জাগানো একটি কবিতা, 'শিক্ষাগুরুর মর্যাদা' কবিতায় তিনি মুঘল হেরেমের বিভিন্ন চরিত্র ফুটিয়ে তুলে উপস্থাপন করেছেন শিক্ষকের সম্মান বা মর্যাদার কথা। কবিতায় তারই প্রতিফলন ঘটেছে : 'বাদশা আলমগীর/কুমারে তাহার পড়াইত এক মৌলভী দিলিস্নর।/ উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষক তবে দাঁড়ায়ে সগৌরবে,/ কুর্ণিশ করি বাদশাহর তরে কহেন উচ্চরবে-/'আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির/ সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।' উলিস্নখিত কবিতাগুলো জানা নেই, এমন কোনো পড়ুয়া বাংলাদেশি এখনো খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তার বিখ্যাত হয়ে ওঠার জন্য, পাঠক মনে আসন স্থায়ী করার জন্য এগুলোই যথেষ্ট। কবি কাজী কাদের নওয়াজ ১৯০৯ সালের ১৫ জানুয়ারি অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম কাজী আলস্নাহ নওয়াজ, মাতার নাম ফাতেমাতুন্নেছা। পৈর্তৃক নিবাস বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোর্ট গ্রামে। তিনি ১৯১৮ সালে বর্ধমান জেলার মাথরুন উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯২৯ সালে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ (অনার্স) পাস করেন। ১৯৩২ সালে তিনি বিটি পাস করেন। শিক্ষানুরাগী ও শিক্ষাবিদ কবি কাজী কাদের নওয়াজ ১৯৩৩ সালে স্কুল সাব-ইন্সপেক্টর পদে ও পরে কিছুদিন কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। দেশ বিভাগের পর তিনি ১৯৪৮ সালে মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মুজদিয়া গ্রামের এক হিন্দু জমিদার বাড়ি বিনিময় করে চলে আসেন। প্রথম নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ও সবশেষ, তিনি দিনাজপুর জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে ১৯৬৬ সালে অবসর গ্রহণ করেন। প্রাসাদতুল্য এই দ্বিতল বাড়িতে আমৃতু্য স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। 'মরাল', 'নীল কুমুদী', 'দুটি পাখি দুটি তীরে', 'উতলা সন্ধ্যা', 'দসু্য লাল মোহন', 'দাদুর বৈঠক' প্রভৃতি তার উলেস্নখযোগ্য গ্রন্থাবলি। তৎকালীন সময়ে বহু পত্রপত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। এর মধ্যে 'মাসিক মোহাম্মদী', 'মাহেনও', 'মাসিক নবারুণ', 'ভারতবর্ষ', 'বসুমতি', 'প্রবাসী', 'সপ্তডিঙ্গা', 'দৈনিক আজাদ', 'দৈনিক সংবাদ', 'পাক জমহুরিয়াত', 'শিশু সওগাত', 'গণদাবী' ইত্যাদি উলেস্নখযোগ্য। কবি কাজী কাদের নওয়াজ সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ 'তমঘা-ই-ইমতিয়াজ' পদক ছাড়াও ১৯৬৩ সালে শিশু সাহিত্যে 'বাংলা একাডেমি পুরস্কার', ১৯৬৬ সালে 'প্রেসিডেন্ট পুরস্কার' লাভ করেন। ১৯৮৩ সালের ৩ জানুয়ারি এ মহৎ কবি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মুসলিম ঐতিহ্যের সুমহান আদর্শে উজ্জীবিত এই কবি তার কবিতায় সত্য-সুন্দর আর সুনীতিকে আঁকড়ে ধরেছেন, পথ দেখিয়েছেন। তিনি তার সৃষ্টি সম্ভারকে অনভিপ্রেত বাহুল্য ও দুর্বোধ্যতা মুক্ত রেখেছেন অত্যন্ত সচেতনভাবে। ঐতিহ্য, প্রেম, প্রকৃতি ও স্বদেশ তার কবিতার বিষয়বস্তুকে অধিক তাৎপর্য দিয়েছে। সহজ-সরল ভাব ও ভাষায় রচিত তার কাহিনীধর্মী এবং নীতিকথামূলক শিশুতোষ রচনার সংখ্যা অধিক। তবে সংখ্যা বিচারে নয়; নীতিকথা ও শিশুশিক্ষার বিষয়বস্তুর পাঠক-প্রিয়তার নিরিখে অল্পকিছু লেখাই তাকে সাহিত্যে অমরত্বের আসন তৈরি করে দিয়েছে।