জসীমউদ্‌দীন কবি ও গীতিকার

প্রকাশ | ১৭ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

আবু আফজাল সালেহ
'তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়। গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়...' (জসীমউদ্‌দীন) জসীমউদ্‌দীন ১৯০৩ সালের প্রথম দিন ফরিদপুর শহরের কুমার নদ বিধৌত ফরিদপুরের তাম্বুলখানায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কবি, গীতিকার, ঔপন্যাসিক। আবহমান গ্রামবাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে সাহিত্যে প্রয়োগ করেছেন। এ ক্ষেত্রে অনেক গ্রামের মানুষের মুখে মুখে চলা প্রবাদ পরিমার্জন করে পাঠক উপযোগী করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একেবারে আঞ্চলিক শব্দগুলোর যতটা পারা যায় প্রমিত করার চেষ্টা করেছেন। গ্রামবাংলার বিভিন্ন উপাদানে তার কবিতা বা সাহিত্য ভরপুর। সে সময়ে কেউ কল্পনাই করতে পারেনি! সঙ্গত কারণে তাকে পলস্নী কবি উপাধি দেওয়া হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে খুব কম লোকই তাকে অনুসরণ করতে পেরেছেন। জসীমউদ্‌দীন ফরিদপুর জিলা স্কুল মাধ্যমিক পড়াশুনা শেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাসাহিত্যে স্নাতক (১৯২৯) স্নাতকোত্তর (১৯৩১) ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ বছর শিক্ষকতা করেন। ১৯৪৪ সালে শিক্ষকতা ছেড়ে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকার এবং পরে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৬২ সালে অবসরগ্রহণ করেন। জসীমউদ্‌দীন ছিলেন প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার একজন দৃঢ় সমর্থক। তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। জসীমউদ্‌দীন একদম অল্পবয়স থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। কলেজে অধ্যয়নরত থাকা অবস্থায় পরিবার এবং বিয়োগান্ত দৃশ্যে, একদম সাবলীল ভাষায় তিনি বিশেষ আলোচিত কবিতা কবর লিখেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাবস্থায় কবর কবিতাটি প্রবেশিকার বাংলা পাঠ্যবইয়ে স্থান পায়। 'ওইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে,/তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।/এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,/পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।/এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা,/সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা।/সোনালী ঊষায় সোনামুখে তার আমার নয়ন ভরি,/লাঙ্গল লইয়া ক্ষেতে ছুটিতাম গাঁয়ের ও-পথ ধরি।/যাইবার কালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত,/এ কথা লইয়া ভাবি-সাব মোর তামাশা করিত শত।'-(কবর) গাঁয়ের লোকের দৃষ্টিতে গ্রাম্যজীবন এবং পরিবেশ- প্রকৃতি ফুটিয়ে তোলার জন্য জসীমউদ্‌দীন বিশেষভাবে পরিচিত। তার এই সুখ্যাতি তাকে পলস্নী কবি উপাধি এনে দিয়েছে। তার কাব্যের গঠনপ্রণালি এবং বিষয়বস্তু পাঠককে বাংলা লোকসাহিত্যের প্রগাঢ় আস্বাদন এনে দেয়। তার রচিত নকশীকাঁথার মাঠ কাব্যগ্রন্থকে তার শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং পৃথিবীর অনেক ভাষায় এটি অনূদিত হয়েছে। কবি জসীমউদ্‌দীন লোকসাহিত্যের অনেক কিছু উদ্ধার করেছেন বা সংগ্রহ করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পাদনাও করেছেন। সম্পাদনায় অবশ্য তিনি সীমাবদ্ধতার কথা বলেছেন। সম্পাদনার ক্ষেত্রে তিনি কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৌলিকতা এড়িয়ে বা বলা যায় বিতর্ক এড়ানোর জন্য সতর্ক হয়ে সম্পাদনা করেছেন। কিছু ক্ষেত্রে তার মতো করে সম্পাদনা করেছেন। ১৯৩১ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত দীনেশচন্দ্র সেনের সঙ্গে লোকসাহিত্য সংগ্রাহক হিসেবে জসীমউদ্‌দীন কাজ করেন। তিনি পূর্ববঙ্গ গীতিকার একজন সংগ্রাহকও। তিনি ১০,০০০ এরও বেশি লোকসংগীত সংগ্রহ করেছেন, যার কিছু অংশ তার সংগীত সংকলন জারি গান এবং মুর্শিদা গানে স্থান পেয়েছে। তিনি বাংলা লোকসাহিত্যের বিশদ 'ব্যাখ্যা এবং দর্শন' খন্ড আকারেও লিখে গেছেন। অমর কিছু গান তিনি রচনা করেছেন। কবি জসীমউদ্‌দীনের এমন কিছু বাংলা গান এখনো মনের অজান্তে গুনগুন করে ছেলে-বুড়ো-আমরা। লোকজ এবং মাটির গানগুলোকে তুলে দিয়েছেন শহুরে মানুষের মুখে মুখে। আমরা মনের অজান্তে কবি জসীমউদ্‌দীনের অনেক গান গেয়ে থাকি। তবে অনেকেই গীতিকারের নাম জানেন না। শিল্পী রথীন্দ্রনাথের কণ্ঠের অমর অনেক গানই শিল্পীর সুনাম বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু গীতিকার পর্দার আড়ালেই থেকে গেছেন। কয়েকটি অমর গানের কথা বলতেই পারি- 'প্রাণ সখিরে/ঐ শোন কদম্বতলে বংশী বাজায় কে।/বংশী বাজায় কে রে সখি, বংশী বাজায় কে।/আমার মাথার বেণী খুইলা দিমু/তারে আনিয়া দে...' 'আমার হাড় কালা করলাম রে/আমার দেহ কালার লাইগা রে/আরে আমার অন্তর কালা করলাম রে/দুরন্ত পরবাসে...'(রথীন্দ্র নাথ রায়) 'আমার সোনার ময়না পাখি/কোন দেশেতে গেলা উইড়া রে/দিয়া মোরে ফাঁকি রে/আমার সোনার ময়না পাখি...''ও আমার দরদী আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না...'/'আমায় ভাসাইলিরে আমায় ডুবাইলিরে অকূল দরিয়ায় বুঝি কূল নাইরে...'/নদীর কূল নাই কিনার নাইরে...আমি কোন কূল হইতে কোন কূলে যাবো...'/ অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গানের স্রষ্টা পলস্নীবাংলার সুখ-দুঃখের কবি জসীমউদ্‌দীন। পলস্নীগীতি, দেশেরগান বা ধর্মীয় অনুভূতির গানগুলো অনেক সুন্দর। যেমন বলা যেতে পারে- 'ছলছল কলকল নদী করে টলমল.../ ও বাজান চল যাই চল মাঠে লাঙ্গল বাইতে... কিংবা কি বলবি সোনার চাঁদ... অথবা তোরা কে কে যাবি লো জল আনতে.../ নিশিতে যাইও ফুল বনে গো ভোমরা, নিশিতে যাইও ফুল বনে.. আবার রঙ্গিলা রঙ্গিলারে' এ রকম অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা কিন্তু কবি জসীমউদ্‌দীন। আধুনিক গান, ইসলামি গান, পলস্নীগীতি, জারি, সারি, মর্শিদী, ভাটিয়ালি, বিচ্ছেদি, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া, পালাগান এবং উর্দুসহ অসংখ্য গান লিখে বাংলা গানের জগৎকে করেছেন সমৃদ্ধ এবং উজ্জ্বল। জসীমউদ্‌দীন প্রাইড অব পারফরমেন্স পুরস্কার (১৯৫৮),একুশে পদক (১৯৭৬) ও স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর, ১৯৭৮) পান। তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৬৯ সালে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মানসূচক ডি লিট উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি ১৩ মার্চ, ১৯৭৬ সালে ঢাকায় মৃতু্যবরণ করেন। তার শেষ ইচ্ছা অনুসারে তাকে ফরিদপুর জেলার আম্বিকাপুর গ্রামে তার দাদির কবরের পাশে দাফন করা হয়। গোবিন্দপুরে প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে তার জন্মদিনকে স্মরণ করে জসীম মেলা নামে একটি পাক্ষিক উৎসব উদযাপন করা হয়।