একুশের বইমেলা প্রাণের মেলা সাইফুজ্জামান

প্রকাশ | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
ফেব্রম্নয়ারি মাস ক্যালেন্ডারের একটি নির্দিষ্ট মাস শুধু নয়- এটি এখন বাঙালির আত্মমর্যাদা, প্রকাশের অহংকার ও নিজেকে উন্মোচনের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ফেব্রম্নয়ারিতে ভাষা শহিদদের স্মরণ করা হয়। ফেব্রম্নয়ারি মাসজুড়ে চলে বইমেলা। প্রতিটি বাঙালি অপেক্ষা করে কখন আসবে ফেব্রম্নয়ারি, আর কখনই বা শুরু হবে বইমেলা। লেখক, পাঠক, প্রকাশক অধীর আগ্রহ অপেক্ষা এই প্রহরের। বাঙালির আবেগ আর ভালোবাসায় থরে থরে কম্পোমান বইমেলা। অজস্র বই প্রকাশিত হয়। কতটুকু মানসম্মত সব বই প্রশ্ন সাপেক্ষ। তবু বই প্রকাশিত হয়। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে বর্ণিল রঙের বিজয় নানা রঙে রঞ্জিত হয় বইমেলা। নতুন বইয়ের মাতোয়ারা গন্ধ ও বই স্পর্শ করার আনন্দে কেটে যায় বাঙালির দিনরাত্রি। বইমেলা কখন শুরু হয়েছিল? এর ব্যপ্তি যে এত ব্যাপক, কীভাবে সৃষ্টি হলো তা জানার আগ্রহ রয়েছে পাঠকের। ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে বই মেলার আলোচনায় সূত্রপাত ১৯৬১-তে বাংলা একাডেমিতে। ১৯৬৪ সালে একটি বইমেলার আয়োজন টিচার্স ট্রেনিং কলেজে, অন্যটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের নিচ তলায়। প্রথমটি বছরের শুরুতে ও পরেরটা ১৮ অক্টোবর থেকে ২৪ অক্টোবর। ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জে একটি সফল বইমেলার আয়োজন করা হয়েছিল। সবচেয়ে সার্থক ও আশা সঞ্চারী বইমেলা ছিল ২০ ডিসেম্বর ১৯৭২ থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে আয়োজিত বইমেলা। উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। মুক্তধারা স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স ও বর্ণমিছিল বই বিক্রির ব্যবস্থা করেছিল। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের তৎকালীন পরিচালক সরদার জয়েন উদ্দীনের আগ্রহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় ১৮৭৩ ও ১৯৭৪ সালে শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দুটি বইমেলা ছিল নজরকাড়া। ১৪ ফেব্রম্নয়ারি ১৯৭৪ থেকে ২১ ফেব্রম্নয়ারি ১৯৭৪ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধন করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সাহিত্য সম্মেলনে যুক্ত করা হয়েছিল বই প্রদর্শনীর একুশকে কেন্দ্র করে ১৯৭৫ সালে মুক্তধারা বাংলা একাডেমির প্রধান ফটকে ছোট পরিসরের বইমেলার অস্থায়ী প্রদর্শনী ও বিক্রয়ের সূচনা করেছিল তা পরে বৃহৎ পরিসরের বইমেলা আয়োজনের এক বিশাল অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বইমেলায় আস্তেধীরে প্রকাশকদের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। ১৯৭৬ ও ১৯৭৭ সালে আয়োজিত বইমেলা পাঠক লেখকদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। বাংলা একাডেমির প্রকাশনা, মুদ্রণ বিক্রয় বিভাগ ১৯৭৮ সালের ১৫ ফেব্রম্নয়ারি থেকে ১৮ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত বইমেলা আয়োজন করে। ১৯৭৯ সালে হয় আরেকটি বইমেলা। এসব মেলা প্রকৃত অর্থে প্রাচুর্য ও সৌন্দর্যে ভরা ছিল। ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলার নামকরণ হয় 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা'। ক্রমে ক্রমে বইমেলার পরিসর বৃদ্ধি পায়। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত বইমেলায় স্থান সংকুলানের অভাব তৈরি হয়। মূল প্রাঙ্গণের বাইরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলাকে সম্প্রসারিত করা হয়েছে। খাবার দোকান, ক্যাসেটের দোকান, রকমারী গৃহস্থালি সামগ্রী বেচাকেনা মেলায় যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছিল আশির দশকে, পরে এটা বিযুক্ত হয়ে প্রকৃত কেন্দ্রিক মেলায় পরিণত হয়েছে। বইমেলায় রয়েছে আধুনিক প্যাভিলিয়ন, বহু রং ও রেখায় শোভিত বইমেলার স্টল প্রতিদিন দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠছে। বিজ্ঞাপন ও ভাষায় রয়েছে ভিন্নতা ও চমক। বইয়ের নামে এসেছে পরিবর্তন। প্রচ্ছদ সাইজ রয়েছে আকর্ষণ। সুসজ্জিত বইমেলায় প্রকৃতি নানা সাজে রঞ্জিত। ঝরাপাতা, বিচিত্র ফুল, পাখির ডাক ও নানা বয়সি পাঠকের কলরবে মুখরিত বইমেলা শুধু মিলনমেলা নয়, স্মৃতিভারে গ্রথিত একটি অনন্য কেন্দ্র। ভালোবাসার টানে, নতুন বইয়ের গন্ধে আমরা বইমেলায় আসি, আবার ঘরে ফিরে যাই। সঙ্গে নিয়ে যাই প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য স্মৃতি। বইয়ে পড়া কোনো চরিত্র অলক্ষ্যেই হয়ে যাই। আনন্দ-বেদনায় লীন হয়ে কখনো দুই চোখ ভিজে যায়। দীর্ঘশ্বাস বুক ফুড়ে বেরিয়ে আসে। অতীতের পাওয়া না পাওয়া নিয়ে যে দোলাচালে আমরা বন্দি থাকি তার সামান্যটুকুই আমরা ধারণ করতে পারি। অমর একুশের মেলা, প্রাণের মেলা। এই মেলা ঘিরে প্রতিদিন জন্ম নিক নতুন অভিজ্ঞতা। বইমেলা চিরজীবী হোক।