চোখ

প্রকাশ | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

সমীর আহমেদ
ওর তো চোখে গস্নুকোমা হয়েছে। গস্নুকোমা! গস্নুকোমা কী? গস্নুকোমা হচ্ছে অন্ধত্বকারী একটি রোগ। এই রোগ হলে চোখের দৃষ্টিশক্তি আস্তে আস্তে কমে যেতে থাকে। একটু ব্যাখ্যা করলে বোধ হয় বুঝতে পারবেন। আমাদের চোখের ভেতরে ও বাইরে তরল পদার্থ থাকে। গস্নুকোমা হলে এই তরল পদার্থ সঞ্চালনে বাধার সৃষ্টি করে। ফলে চোখে খুব প্রেসার পড়ে। এতে অপটিক নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রোগী আস্তে আস্তে অন্ধ হয়ে যায়।শেখ লুৎফর রহমান ভয় পেয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আমার খোকার কী অবস্থা? ডাক্তার টি আহমেদ বললেন, ওর চোখের অবস্থা খুব খারাপ। আরও আগেই আসা উচিত ছিল। তাহলে ওষুধেই কাজ হয়ে যেত। এখন শুধু ওষুধে কাজ হবে না। বেশি দেরি করে ফেলেছেন।দুই বছর ধরে কলকাতায় খোকার চোখের চিকিৎসা চলছে। শিবপদ ভট্টাচার্য, এ কে রায় চৌধুরীসহ আরও অনেকজনের চিকিৎসাও নিলেন। কতরকম ওষুধপত্তর খেলো খোকা। কিন্তু চোখ ভালো হলো না। দিনে দিনে আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে চোখ দুটো। অপারেশন করার পর খোকার চোখ ভালো হবে তো? নাকি সে অন্ধ হয়ে যাবে? শেখ লুৎফর রহমান খুব বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। ডাক্তার টি আহমেদ তার শঙ্কিত চেহারার দিকে তাকিয়ে বললেন, তবে আশার কথা হলো, তাড়াতাড়ি অপারেশন করলে অন্ধত্ব থেকে রক্ষা পেতে পারে ও। শেখ মুজিব আঁতকে উঠলো, অপারেশন! আমি অপারেশন করবো না আব্বা।ডাক্তার টি আহমেদ মৃদু হেসে বললেন, অপারেশন না করলে, খুব তাড়াতাড়িই তুমি অন্ধ হয়ে যাবে। এই সুন্দর পৃথিবীর কিছুই দেখতে পাবে না। একবার চোখ বন্ধ করে দেখো তো, যদি কিছু দেখতে না পাও, কত অসহায় তুমি। চারপাশের কোনো সৌন্দর্যই উপভোগ করতে পারবে না। আর সৌন্দর্য উপভোগ ছাড়া জীবন কত অর্থহীন! জীবনের কী মূল্য আছে, বলো? কথা তো ঠিকই। শেখ মুজিব ভাবে, চোখ না থাকলে সব অন্ধকার। এ দেশের মাঠ-ঘাট, নদী-নালা, খাল-বিল, পাহাড়-পর্বত, গাছপালা, পশু-পাখি, আলো-অন্ধকার কিছুই দেখা যাবে না। দেখতে পাওয়া যাবে না এ দেশের মানুষের মুখ। কত মানুষ তার চারপাশে। মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সহপাঠী, কৃষক, শ্রমিক, মজুর, জেলে, তাঁতি, কামার-কুমার, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, নেতাকর্মী, কারো মুখই দেখা যাবে না। সব অনন্ত অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। অথচ তারা তোমার চারপাশে হাসবে, খেলবে, কথা বলবে, কাজ করবে। তাকে স্পর্শ করবে। ইচ্ছে করলে তাদেরও ধরা যাবে, ছোঁয়া যাবে। অথচ দেখা যাবে না। তা কি হয়! দম বন্ধ হয়ে আসে তার। গতকাল বিকালে গলির ধারে সাদা ছড়ি হাতে একজন অন্ধ লোকের হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তার অবস্থাও কি সে রকম হবে! গা যেন হিম হয়ে যায়। সে কথা বলে না। চুপ করে থাকে। শেখ লুৎফর রহমানের দিকে তাকিয়ে ডাক্তার টি আহমেদ বললেন, এখনই ওকে ভর্তি করে দিন। এই ওষুধগুলো ঠিক মতো খাওয়াবেন। আগামী কাল সকাল ৯টায় অপারেশন। তারপর শেখ মুজিবের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, অবশ্য ও যদি রাজি থাকে। অন্ধ হতে না চায়। শেখ লুৎফর রহমান বললেন, না না, এখনই ভর্তি করার ব্যবস্থা করেন। ডাক্তার টি আহমেদ লিখে দিলেন। সেদিনই কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে গেল সে। অপারেশন! তাও হাত-পা কিংবা শরীরের অন্য কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ না- চোখের। ভাবলেই শেখ মুজিবের গা ভয়ে কেমন ছম ছম করে ওঠে। পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। বিকালে তার মেজো আপা আছিয়া বেগম এবং দুলা ভাই ছুটে এলেন হাসপাতালে। কয়েকটি বাটি ভর্তি নানা রকম খাবারদাবার। কিন্তু ভয়ে কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না তার। চোখেমুখে ভয়ের ছায়া। বোন ও দুলাভাই তাকে খুব সাহস দেয়, এ কিছু না। তুমি টেরই পাবে না। কলকাতায় টি আহমেদ নামকরা চোখের ডাক্তার। তার হাত খুব ভালো। তার হাতে কতজনের অপারেশন হচ্ছে। কিন্তু শেখ মুজিবের মন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। অপারেশন তো অপারেশনই। কাটাছেঁড়া- তা আবার চোখের! ব্যথা না হয়ে পারে! কিন্তু অপারেশন না করেই বা কী উপায়! অন্ধ হয়ে গেলে জীবন অর্থহীন। বেরিবেরি রোগের কারণেই চোখের এই সমস্যা। দুই বছর যাবত লেখাপড়া বন্ধ। এখনো সপ্তম শ্রেণিতেই পড়ে আছে সে। অন্ধ হয়ে গেলে আর তো পড়াশোনাই হবে না। জীবনে কত কিছু দেখার, কত কিছু জানার ইচ্ছা তার! কত স্বপ্ন সব সময় তাড়িত করে তাকে। বলা চলে গোটা জীবনটা সামনে পড়ে আছে। এখন অন্ধ হয়ে গেলে সে অথর্ব হয়ে যাবে। এ যেন ফুল ফোটার আগে, রূপ-রস-গন্ধ না বিলিয়েই কুঁড়ির মৃতু্য। হাত না থাকলে মানুষ চলতে পারে। পা না থাকলেও কোনো না কোনো উপায়ে চলাফেরা করা যায়। চারপাশের প্রকৃতি ও মানুষ দেখে বেঁচে থাকার স্বাদ অনেকটাই আস্বাদন করা যায়। কিন্তু চোখ না থাকলে সব অন্ধকার। বস্ন্যাকহোল। জীবনের সব সুখ-স্বস্তি, শখ-আহ্লাদ, বেঁচে থাকার আনন্দ ও গৌরব, সব এই বস্ন্যাকহোলে হারিয়ে যায়। অন্ধের জীবন বিষাদময়। যত বড় বিত্তশালীই সে হোক- তার জীবন মূল্যহীন। ধন, সম্পদ ও গৌরবের কী দাম আছে যদি দুটো চোখ না থাকে! জীবনের সব আনন্দ উপভোগ, তাহলে, দুটো ছোট্ট বলের মতো এই চোখের ওপর নির্ভরশীল! চোখ আছে বলেই আমরা এর মর্ম বুঝতে পারি না। কিন্তু চোখ না থাকলে নিজের অসহায়ত্ব হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। শেখ মুজিব ভাবে, বেঁচে থাকতে হলে এ চোখ দুটোর আলো ধরে রাখতে হবে। কিছুতেই অন্ধ হওয়া যাবে না। ইচ্ছে না থাকলেও, আগামী কাল সকাল ৯টায় তাকে যেতে হবে অপারেশন টেবিলে। রাতে তার ভালো ঘুম হয় না। সারা রাত বিছানায় এপাশ ওপাশ করে। তার বাবা লুৎফর রহমানও ঘুমাতে পারেন না। যদিও তিনি বারবার ছেলেকে সাহস দিচ্ছেন, চিন্তা করো না বাবা। ঠিক হয়ে যাবে। ভয় পেও না। ঘুমাও। উনার হাতে প্রতিদিন কত জনের অপারেশন হচ্ছে। কিন্তু রাত যত শেষ হয়ে আসছে ছেলের চিন্তায় সে ততোই পেরেশান। শেখ মুজিবের ভেতরেও শঙ্কা বাড়তে থাকে। সকাল হয়ে এলো। হাতে গোনা সময় কত তাড়াতাড়িই না ফুরিয়ে যায়! অপারেশন থেকে বাঁচার জন্য কয়েকবার তার ইচ্ছে হয়েছিল, কলকাতা থেকে পালিয়ে গ্রামে মায়ের কাছে ফিরে যেতে। কিন্তু অন্ধ হয়ে তো বেঁচে থাকা যাবে না। সবাই তাকে সরাসরি কিংবা আড়ালে আবডালে বলবে কানা মুজিবুর, অন্ধ মুজিবুর, তা কি সহ্য হবে তার! তার চেয়ে বরং অপারেশন টেবিলে যাওয়াই ভালো। বাম চোখটার অপারেশন হয়ে গেল! না, অপারেশনের সময় কোনো ব্যথা অনুভব হয়নি তার। এ্যানেসথেসিয়া দিয়ে নিয়েছিল ডাক্তার। এখন ব্যথা যা হচ্ছে একেবারে সহ্য সীমার বাইরে নয়। ওষুধ খেলেই কমে যায়। চোখটা শাদা ব্যান্ডেজ দিয়ে আটকানো। চোখে কালো চমশা। দুলা ভাই দুষ্টুমি করে বলেন, তোমাকে এখন বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে খোকা। \হশেখ মুজিব মিটিমিটি হাসে। কয়েকদিন পর ডান চোখটারও অপারেশন হবে। অপারেশন শব্দটা যদিও খুব ভয়ের, কিন্তু এবার অপারেশন টেবিলে যেতে তার আপত্তি নেই। সাহস আছে মনে। দশ দিনের মধ্যেই শেষ হলো দুটি চোখের অপারেশন। ডাক্তার টি আহমেদ বললেন, অপারেশন খুব ভালো হয়েছে। তবে বছর দুই ওকে খুব কড়া নিয়ম মেনে চলতে হবে। পড়াশোনা, খেলাধুলা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে। দৌড়-ঝাপ বা কোনো ভারী কাজ করতে পারবে না। ব্যান্ডেজ খোলার পর আরও কিছুদিন কলকাতায় কাটিয়ে চোখে পুরু কাচের ভারি চমশা পরিয়ে ছেলেকে নিয়ে শেখ লুৎফর রহমান মাদারীপুরে এলেন। শেখ মুজিব বাড়ি থেকে বের হতে পারে না। মা নিষেধ করে। এখনই বেশি হাঁটাচলা করলে চোখের ক্ষতি হতে পারে। সেও তা ভালো করেই জানে। কিন্তু বাইরে যেতে তার মন চায়। মন চায় স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করতে। সহপাঠীদের নিয়ে খেলাধুলা করতে। গলা ছেড়ে গান গাইতে। ঘুরে বেড়াতে। কিন্তু চোখের কথা ভেবে দমে যায়। খোকা কলকাতা থেকে ফিরে এসেছে শুনে কয়েকজন সহপাঠী এসেছিল তাকে দেখতে। খোকা আরও বছরখানেক পড়াশোনা করতে পারবে না জেনে তারা হতাশই হয়েছে। শেখ মুজিবও মন খারাপ করে। তার সহপাঠীরা উপরের ক্লাসে উঠে যাচ্ছে, আর সে কিনা পড়ে আছে নিচের ক্লাসে, ভালো লাগে না। কিন্তু বসে না থেকেও তো উপায় নেই। খাওয়াদাওয়া, ঘুম আর বিশ্রাম। এভাবে কেটে গেল কয়েকটা মাস। এখন সে মাঝে মাঝে বাইরে যায়। অল্পস্বল্প হাঁটাচলা করে। সময় হলেই ফিরে আসে ঘরে। একদিন তার এক বন্ধু এসে বললো, যাবি? কোথায়? একটা বাড়িতে। রাজনৈতিক ক্লাস হয়। পূর্ণচন্দ্র দাস আসেন। সে তো ইংরেজদের ত্রাস। স্বদেশি আন্দোলন করে। তুই জানলি কীভাবে? তার সম্পর্কে কে না জানে? তা ছাড়া আমাদের বাড়িতে নিয়মিত আনন্দবাজার, বসুমতী, সওগাত, মাসিক মোহাম্মদী, আজাদ পত্রিকা রাখা হয়। ওহ। আচ্ছা। তাহলে চল, কাল যাই। \হশেখ মুজিব রাজি হয়ে যায়। পূর্ণচন্দ্র দাসকে দেখার ইচ্ছে তার অনেক দিনের। তিনি স্বদেশি বিপস্নবী। দেশ থেকে ইংরেজ তাড়াও। ভারত স্বাধীন কর- এই আন্দোলনে যশোরের বাঘা যতীনের সঙ্গে কাজ করেন। মাদারীপুর সমিতির তিনি নেতা। ইতোপূর্বে কয়েকবার তিনি গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটে ছাড়াও পেয়েছেন। তার সঙ্গী ছিলেন বাঘা যতীনের বিশ্বস্ত সহচর চিত্তপ্রিয় রায় চৌধুরী, জ্যোতিষচন্দ্র পাল, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত, নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত। ১৯১৫ সালের ১৮ ফেব্রম্নয়ারি ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান। রাস্তায় দায়িত্ব পালন করছিল পুলিশ ইন্সপেক্টর সুরেশ মুখার্জি। চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে সুরেশ মুখার্জিকে হত্যা করে। তারপর ৯ সেপ্টেম্বর সে যতীন মুখার্জির সঙ্গে অংশ নেয় বালেশ্বরের ট্রেঞ্চ যুদ্ধে। দুদিন আগেই তারা এসে পৌঁছে উড়িষ্যার বুড়িবালাম নদীর উপকণ্ঠে। একটা পুরো দিন কাটিয়ে দেন মোটামুটি শুকনো একটা ডোবার মধ্যে। নদীর ওপারে পুলিশ ও সামরিক বাহিনী নিয়ে অপেক্ষা করছে চার্লস ট্রেগার্ট, কমান্ডার রাদারফোর্ড, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কিলভি। তাদের হত্যা করার জন্য নদী সাঁতরে পার হয়ে বাঘা যতীনরা ঢুকে পড়েন পরীখার মধ্যে। প্রত্যেকের হাতে মাউজার পিস্তল। ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে তাদের শুরু হয় যুদ্ধ। পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই শহিদ হন চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী। ধরা পড়ে যান মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত, নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ও জ্যোতিষচন্দ্র পাল। শুরু হয় তাদের ওপর নির্মম পুলিশি নির্যাতন। তারপর বিচার। বিচারে মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত ও নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তকে মৃতু্যদন্ড দেয়া হয়। মাস দেড়েক পর তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। আর জ্যোতিষচন্দ্র পালকে পাঠিয়ে দেয়া হয় আন্দামান দ্বীপে। সেখানে পুলিশের নির্যাতন ও বদ্ধঘরে থাকতে থাকতে তিনি পাগল হয়ে যান। প্রায় নয় বছর পর মারা যান জ্যোতিষচন্দ্র পাল। এসব সংবাদ পত্রিকায় আগেই পড়েছে শেখ মুজিব। এখনো বেঁচে আছেন পূর্ণচন্দ্র দাস। নেতাজী সুবাসচন্দ্রের ফরওয়ার্ড বস্নকের সঙ্গে যুক্ত। এমন একজন স্বদেশি বিপস্নবীকে সরাসরি খুব কাছে থেকে দেখতে পাওয়াও কম কথা নয়। একদিন হাঁটতে হাঁটতে শেখ মুজিব বন্ধুর সঙ্গে চলে যায় সেই গুপ্ত সভায়। পূর্ণচন্দ্র দাস বক্তৃতা করছেন। এই দেশ, এই মাটি আমাদের। ইংরেজরা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। আমাদের শাসন করছে। আমি বলি শাসন নয় শোষণ করছে। ওরা আমাদের শাসন করার কে? আমাদের ধন-সম্পদ ওরা লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা ডাকাত। প্রায় দুশো বছর হতে চললো, ওরা আমাদের গোলাম বানিয়ে রেখেছে। আমরা আর ওদের অধীনে থাকতে চাই না। আজ হোক, কাল হোক আমরা ওদের এ দেশ থেকে তাড়াবই। এ জন্য আপনাদের এগিয়ে আসতে হবে। মনোরঞ্জন, নীরেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিষচন্দ্রের মতো স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য আপনাদের জীবনও উৎসর্গ করতে হবে। এ দেশ ও দেশের মানুষকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে হবে।... কী সুন্দর করে কথা বলছেন পূর্ণচন্দ্র দাস। শেখ মুজিব তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার প্রতিটি কথাই তো যৌক্তিক। এমন একজন দেশপ্রেমিককে কি না ইংরেজরা বলে সন্ত্রাসী! বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে কয়েকবার পূর্ণচন্দ্র দাসও তাকিয়ে থাকেন শেখ মুজিবের দিকে। হ্যাঙলাপাতলা, রোগা, চোখে ভারী চশমা; এ ছেলেটি তো আগে কখনো আসেনি সভায়। বক্তৃতা শেষে তিনি তার কয়েকজন কর্মীর কাছে শেখ মুজিব সম্পর্কে জানতে চান। তারা তাকে বলে, ও সেরেস্তাদার শেখ লুৎফর রহমান সাহেবের ছেলে। পূর্ণচন্দ্র দাস বলেন, ছেলেটা খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনছিল। হাত ইশারায় তিনি তাকে কাছে ডেকে আনেন। জিজ্ঞেস করেন, এই সভায় কেন এসেছো? শেখ মুজিব বলে, আমার খুব জানতে ইচ্ছে করতো, আপনারা ইংরেজদের তাড়াতে চান কেন? তা ছাড়া আপনাকে দেখতেও ইচ্ছে করতো। আজ আপনার বক্তৃতা শুনে মনে হলো আমি আমার জবাব পেয়ে গেছি। এ দেশ থেকে ইংরেজদের তাড়ানো দরকার। পূর্ণচন্দ্র দাস খুব খুশি হলেন। প্রশ্ন করলেন, তোমার কী মনে হয় মুজিব, আমরা পারব? শেখ মুজিব বলে, অবশ্যই পারব। যে মাটি মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত, নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ও জ্যোতিষচন্দ্র পাল এবং আপনার মতো বিপস্নবীদের জন্ম দিয়েছে, সে মাটি ইংরেজরা আর বেশিদিন দখল করে রাখতে পারবে না। এ দেশ থেকে তারা চলে যেতে বাধ্য হবেই। পূর্ণচন্দ্র দাস বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন শেখ মুজিবের দিকে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, একদিন তুমি অনেক বড় হবে খোকা। ধন্যবাদ। আশীর্বাদ করবেন। সভায় এসো। এ দেশ ও মানুষের মুক্তির জন্য তোমার মতো ছেলের খুব দরকার।