একুশের বইমেলা : লেখকদের মতামত

ভাষা আন্দোলনের চেতনাবাহী অমর একুশে বইমেলা। বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি, আবেগ ও প্রেরণা নতুনভাবে প্রাণসঞ্চার এই মেলাকে ঘিরে। এবারের মেলাকে নিয়ে কয়েকজন লেখকের মতামত তুলে ধরা হলো। গ্রন্থনা করেছেন- আশরাফ আহমেদ।

প্রকাশ | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
বইমেলা হোক আনন্দময় রেজাউদ্দিন স্টালিন, কবি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটা নিরানন্দ। শুধু মুখস্থবিদ্যা দিয়ে কেরানি তৈরির প্রক্রিয়া। জ্ঞানার্জনের যে বিস্তৃত পথ সেই পথ বর্তমান ব্যবস্থায় রুদ্ধ। রুদ্ধদ্বার ভাঙতে একটা সংগ্রাম আবশ্যক। সংগ্রাম হলো আনন্দময় শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার। পাঠ্যপুস্তকনির্ভর বা শিক্ষা তাতে অল্পবিস্তর জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়া থাকলেও নিরানন্দ ভীতিপ্রদ। স্বাধীন চিন্তা ও মুক্তবুদ্ধি প্রকাশের সুযোগ কম। এ জন্য বইমেলার মতো স্বাধীনচিন্তার ক্ষেত্র উন্মুক্ত করা দরকার। যেখানে শত শত বই থাকবে- পছন্দের এবং ভালোবাসার। বইগুলোতে হাত দিয়ে হাজার বছর আগের হোমার, সক্রেটিস, পেস্নটো, দান্তে কথা বলে উঠবেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ দেখা করবে পাঠকের সঙ্গে। কত রং রেখা কত চরিত্র কত কথা অভিজ্ঞতা দিয়ে সাজানো বইমেলা। শিশু-কিশোর তরুণ ও প্রাজ্ঞরা বই দেখবে কিনবে এবং পড়বে। জ্ঞানরাজ্যে যে কত বিচিত্র বিস্ময় কত অনুভবের অসীমতা তা বুঝিয়ে বলা যাবে না। একুশের বইমেলা বিস্তৃত পরিসরে পরিব্যাপ্ত। ৬০০০ বই প্রকাশ পায়। ৬০০ স্টল। কিন্তু বই কি আশানুরূপ বিক্রি হয়। পাঠক কি ভালো বই চিনতে পারে। এই জগতেও ঢুকে পড়েছে রাজনীতির নগ্ন আধিপত্য। সৎ ও মননশীল লেখকরা নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। অপন্যাস অকবিতা বিজ্ঞাপনের ডামাডোল- সব মিলিয়ে মাৎস্যন্যায়। এরই মধ্যে সৎ লোকরা ভালো লিখবেন- সৎ পাঠক বুঝবে কোন বই কিনতে হবে। এবারের বইমেলায় আমার ভালো বই এসেছে। কাব্যগ্রন্থ 'প্রতিবিদ্যা' প্রকাশ করেছে 'কবি প্রকাশনী', 'প্রশ্নের পুরাণ' জব্বার আল নাঈম গৃহীত সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে কবি প্রকাশনী। 'চিরশিশু' ছড়াগ্রন্থ প্রকাশ করেছে 'সরলরেখা' প্রকাশনী। এ ছাড়া একটি কাব্যগ্রন্থ ও ৫০টি প্রেমের কবিতার বই বেরিয়েছে। শুধু ঢাকা নয়- সারা দেশে বইমেলা হোক আনন্দের আধার। আমাদের বইমেলা একটি আন্দোলনের স্মারক শাহীন রেজা কবি ও সম্পাদক বিশ্বের বহুদেশেই বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়; কিন্তু বাংলাদেশের মতো ঐতিহ্যমন্ডিত হয়ে মেলা হওয়ার রেওয়াজ কোথাও নেই। আমাদের বইমেলা একটি আন্দোলনের স্মারক। ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় শহিদ দিবস এবং তারই অংশ হিসেবে বইমেলা অনুষ্ঠান আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশে পরিণত। এ দেশের সর্বজনীন দুটি উৎসবের একটি এই বইমেলা, অন্যটি বৈশাখী উৎসব। বইমেলা ঘিরে মাসব্যাপী বই প্রকাশ, সাহিত্য-আড্ডা, গানবাজনা- এ যেন, এক মহাযজ্ঞ। এরই মধ্যে প্রবেশ করে ফাগুন, অন্তর্ভুক্ত হয় ভালোবাসা দিবস। সবকিছু মিলিয়ে প্রাণের আনন্দে নেচে ওঠে বাঙালি, গেয়ে ওঠে বাংলাদেশ। বইমেলা নিয়ে অনেকেরই নানা মত, নানা উচ্চারণ। তবে বর্তমানে মেলার অবয়ব যতটা স্ফীত, ভেতরের ব্যবস্থাপনা যতটা সুন্দর তাতে কারও কোনো অভিযোগ আছে বলে মনে হয় না। স্টলবিন্যাসে প্যাভিলিয়ন নিয়ে কিছু্‌টা আপত্তি থাকলেও আর সবকিছুতে সন্তুষ্ট লেখক প্রকাশক দর্শক সকলেই। মেলা ঘিরে প্রতিদিন অসংখ্য বই বের হয়, এটা যদিও নতুন লেখকের জন্য সুখবর একটি বিষয়; কিন্তু বইয়ের মান নিয়ে হতাশ অনেকেই। যৌথভাবে লেখক, প্রকাশক এবং একাডেমি কর্তৃপক্ষ যদি মান নিয়ন্ত্রণে একটি কমিটি গঠন করে দিতেন এবং তাদের কাছে সম্পাদিত ও মূল্যায়িত হয়ে বই প্রকাশিত হয়ে মেলায় ঢুকতো তাহলে পাঠকদের মানোত্তীর্ণ বই খুঁজে নিতে এতটা বেগ পেতে হতো না। লেখকদের আত্মসম্মানবোধেরও চর্চা হওয়াও জরুরি আনোয়ারা আজাদ কথাসাহিত্যিক বইমেলাকে ঘিরে নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্মতা বোধ করে বাঙালি জাতি। এক কথায় বাঙালি জাতির সংস্কৃতির মিলনমেলাও এই উৎসব। যেখানে এসে মানুষ ভাষা নিয়ে, ভাষার মাস নিয়ে, জাতিসত্তার বৈশিষ্ট্য নিয়ে গর্ব করার মতো উপাদান সংগ্রহ করে। প্রচুর বই বের হওয়া নিয়ে, সাহিত্যের মান নিয়ে কিছু মানুষের কটাক্ষ উপেক্ষা করে সাহিত্যচর্চা করাকে আমি ইতিবাচক দেখি। যারা লেগে থাকবে তারা টিকে থাকবে, বাকিরা এমনিতেই ঝরে যাবে। কে না জানে, যে কোনো কাজে সাহস করে আগে পা বাড়াতে হয়। এরপর লেগে থাকতে হয়, সাধনা করতে হয়। অনেক বড় লেখককেও একসময় কটাক্ষ শুনতে হয়েছে। কিন্তু শুরুতেই যদি আপনি থেমে যান, তো সব শেষ। তবে একটা কথা সবচেয়ে বেশি মনে রাখতে হবে, লিখতে হলে পড়তে হবে প্রচুর। পড়ার সঙ্গেই লেখার বিষয়টা নির্ভর করে বেশি। বেশি বেশি না পড়লে ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত হবে কেমন করে? শব্দ বাক্য আর বিষয়ে পরিপক্বতাবান নতুনত্ব আসবে কেমন করে? থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড় মার্কা লেখা হলে শেষমেশ সেটাকে সাহিত্য বলতে দ্বিধা তো হবেই। এই সময়টাতে প্রচুর বই বের হলেও সাহিত্যচর্চাটা তেমন হচ্ছে না বলেই মানসম্মত গ্রন্থ রচিত হচ্ছে না বলে মনে করেন বিজ্ঞজনরা। তবে কে বলতে পারে আজ থেকে ২০ কি ৩০ বছর পর হাজার হাজার বের হওয়া এই বইয়ের স্তূপ থেকেই দু-চারটা মাস্টারপিস বের হয়ে আসবে না? সময়ের মূল্যায়ন বলে কথা। তবে শঙ্কার কারণ হলো রাতারাতি সাহিত্য তারকা বনে যাওয়ার প্রবণতাটা ঠেকাতে না পারলে সাহিত্য জগতের অশনিসংকেত উপেক্ষা করা যাবে না! শুধু তেল মেরে কিংবা চালাকি করে প্রিন্টিমিডিয়া কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় মুখ দেখালেই সে রাতারাতি বিখ্যাত কেউ হয়ে উঠবে না, এটা অনুধাবন করতে হবে। লেখালেখি চর্চার পাশাপাশি লেখকদের আত্মসম্মানবোধেরও চর্চা হওয়া অত্যন্ত জরুরি। প্রযুক্তির কারণে লেখক আর পাঠকের দূরত্ব কিন্তু খুব বেশি নয়। কথাটা অনুধাবন করতে হবে।