হুমায়ুন আজাদের 'সব কিছু ভেঙে পড়ে'

প্রকাশ | ১৩ মার্চ ২০২০, ০০:০০

রাহিমা আক্তার
হুমায়ুন আজাদ (জন্ম: ২৮ এপ্রিল, ১৯৪৭; মৃতু্য: ১২ আগস্ট, ২০০৪) বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও তিনি একাধারে কবি, সমালোচক, প্রাবন্ধিক, কিশোর সাহিত্যিক এবং ঔপন্যাসিক। তিনি বাংলাদেশের প্রধান প্রথাবিরোধী এবং বহুমাত্রিক লেখক হিসেবে সবার কাছে পরিচিতি লাভ করেন। তার বাংলা ভাষাবিষয়ক বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা বা ভাষাবিজ্ঞান ভাবনা, ভাষাবিষয়ক গবেষণায় আধুনিক ভাষাবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ ও রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণ রচনায় পথিকৃৎ ভূমিকা পালন করে। ভাষাবিজ্ঞানের জ্ঞানপিপাসুর কাছে তিনি পুরোধা ব্যক্তিত্ব ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষাবিজ্ঞানীর মর্যাদাসম্পন্ন। তার গবেষণা, অধ্যাপনা, সম্পাদনা এবং অপূর্ণ স্বপ্নের প্রায় পুরোটা জুড়ে আছে বাংলা ভাষাবিষয়ক তার বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা বা ভাষাবিজ্ঞান ভাবনা। 'ভাষাতাত্ত্বিক প্রবন্ধাবলি' (১৯৯৮) গ্রন্থে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম মন্তব্য করেছেন, "বাংলাদেশে চমস্কি প্রবর্তিত 'রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল' ভাষাতত্ত্বের সবচেয়ে উৎসাহী প্রবক্তা ও অন্যতম পথিকৃৎ হুমায়ুন আজাদ।" হুমায়ুন আজাদ মূলত গবেষক ও প্রাবন্ধিক হলেও ১৯৯০-এর দশকে একজন প্রতিভাবান, বাস্তববাদী, স্পষ্টভাষী, জীবনবাদী ঔপন্যাসিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে মৃতু্য অবধি তার প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা ১২। তার ভাষা দৃঢ়, কাহিনির গঠন সংহতিপূর্ণ এবং জীবনঘনিষ্ঠ। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন প্রথম উপন্যাস 'ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল' প্রকাশের মধ্য দিয়ে। ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় 'সব কিছু ভেঙে পড়ে' উপন্যাসটি। সব কিছু ভেঙে পড়ে উপন্যাসে লেখক জীবনঘনিষ্ঠ নানা ঘটনা ও বাস্তবতার আড়ালে যে পরাবাস্তববাদ রয়েছে সেটা তুলে আনার সফল প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। জাগতিক বিষয় ও পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের টিকে থাকার ক্ষেত্রে সম্পর্ক বা সম্বন্ধ বা বন্ধন প্রয়োজন। এই সম্পর্ক বা বন্ধনের ফ্রেমে আবদ্ধ হয়ে পরস্পরের টিকে থাকা সম্ভব হয়। লেখকের ভাবনায়- ব্রিজ একটি কাঠামো; সব কিছুই আমার কাছে কাঠামো- বিশতলা টাওয়ার, জানালার গ্রিলে বৃষ্টির ফোঁটা, রাষ্ট্র, শিশির বিন্দু, সভ্যতা, বুড়িগঙ্গার ব্রিজ, সমাজ, সংসার, বিবাহ, পনেরো বছরের বালিকা, তার বুক, দুপুরের গোলাপ, দীর্ঘশ্বাস, ধর্ম আর একটির পর একটি মানুষ- পুরুষ, নারী, তরুণী, যুবকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক, অন্যদের সম্পর্ক, সব কিছুই আমার কাছে কাঠামো। সৃষ্টির আদিকাল থেকে সবকিছু টিকে থাকার পেছনে রয়েছে সম্পর্ক। মানবিক ও আত্মিক সম্পর্কই সৃষ্টির রহস্য ভেদ করে দু্যতি ছড়ায় ভূলোকে। কিন্তু সবকিছুরই সৃষ্টি, প্রকাশ ও ধ্বংস রয়েছে; সম্পর্কেরও তাই। প্রাণিকুলের মধ্যে সম্পর্কের সৃষ্টি হয়, প্রকাশ পায় এবং এক সময় নিঃশেষ হয়ে যায়।সবকিছু ভেঙে পড়ে উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই তেমনি সম্পর্ক বর্ণিত হয়েছে। একটা সময় যখন জোয়ার আসে, জোয়ারে সবকিছু উজ্জীবিত করে, মানুষের ক্ষেত্রেও তাই। যৌবন জোয়ারে মানুষ উজ্জীবিত হয়ে সম্পর্কের বাঁধনে আবদ্ধ হয়। সৃষ্টির উলস্নাসে মেতে উঠে, অজানা উলস্নাসে ভাসতে থাকে। কিন্তু একটা সময় পর ভাটা পরতে থাকে। ভাটার টানে জীবন নদী শুকিয়ে যেন ঘাটের নৌকা দূরে সরে যায়। নিজের সম্পর্ক থেকে মানুষও দূরে যাওয়ার বাসনায় লিপ্ত হয়। উপন্যাসের চরিত্রের ক্ষেত্রেও এমনটা লক্ষ্য করা যায়। উপন্যাসে রফিকের, সিরাজের, রোকেয়ার মা ও বাবার ক্ষেত্রে এরূপ আভাস পাওয়া যায়। উপন্যাসটিতে লেখক নারী-পুরুষের সম্পর্কের চিত্র তুলে ধরেছেন। মানুষ সম্পর্কে এ উপন্যাসে লেখক বলেছেন-''মানুষ দুই প্রকার- পুরুষ আর মেয়ে মানুষ।''লেখক ধন্যবাদ পাওয়ার দাবিদার এই কারণে যে, তিনি মেয়ে মানুষ বলে মানুষের একটি শ্রেণিকরণ করেছেন। কেননা, লোকমুখে শুনা যায় 'মন' ও 'হুশ' থাকলে তবেই তো হয় মানুষ। যেখানে মন থাকবে এবং মন চলার ক্ষেত্রে হুশ বা সচেতনতা থাকবে, যার কোনোটাই মেয়ে মানুষ প্রকাশ করতে পারেনি। লেখকের জবানিতে- বাবার সঙ্গে মায়েরও কোনো ব্রিজ ছিল না, কিন্তু ছোটো খালার সঙ্গে বাবার একটা ব্রিজ ছিল, তা দুজনের মুখ দেখলেই বোঝা যেত। মাও তা বুঝতো ব'লেই মনে হয়, তবে মায়ের তাতে কোনো আপত্তি ছিল বলে মনে হয় না। নারীর মন প্রতিবাদ বা প্রতিশোধ কোনোটাই প্রকাশ করেনি। অনায়াসে মেনে নিয়েছে নানা অপকর্ম। অবশ্য বনফুলের ভাষায় এরকমও হতে পারে-"মাটির নিচে শিকড় অনেক দূর চলে গেছে।" চাইলেও সে কিছু করতে পারে না। এমনও হতে পারে প্রতিবাদ করে সংসারে অশান্তি ডেকে আনার চেয়ে নীরব থেকে শান্তিতে থাকাই শ্রেয় মনে করেছে। পুরুষশাসিত সমাজে নারীর প্রতি অবজ্ঞা, অবহেলা, হেয় মানসিকতাই প্রকাশ পেয়েছে। শুধু সমাজ নয়, রাষ্ট্রও এ ব্যাপারে কম দায়ী নয়- একথা বলা চলে। সুষ্ঠু, সুন্দর পরিবেশ ও সুস্থ মানসিকতা সৃষ্টির ব্যর্থতার কারণে এ দায়মুক্ত হওয়া সম্ভবপর হচ্ছে না। অবশ্য এ কারণে যে পুরুষরা দায়ী সেটা নাও হতে পারে; থাকতে পারে নারীর মানসিকতা, হীনম্মন্যতা, অসচতেনতা। আমরা নারীরা নিজেদের নারী হিসেবে মহিলা হিসেবে পরিচয় দিয়ে সুবিধা ভোগের আশ্বাসে উপস্থাপন করতে চাই। তা ছাড়া যারা এ ব্যাপারে সোচ্চার, তাদের সংখ্যাও নগণ্য। কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন- "জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা।" নারীকে অগ্নিশিখার মতো জ্বলে উঠতে বলেছেন। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসেও ক্ষেত্রবিশেষ ছাড়া নারীর অবস্থান সুদৃঢ় পরিলক্ষিত হয় না। তবে এই উপন্যাসে সোনামতি ও তার মায়ের প্রতু্যত্তরের মাধ্যমে প্রতিবাদী ভাব প্রকাশ পেয়েছে। ইদ্রিস ও সোনামতির অবুঝ সম্পর্কের ফলে পেট বানানোর বিচার থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো-"তোতা খাঁ যখন চিৎকার করে বলে যে খানকির ঘরে খানকিই হবে, সোনামতির বাপ বছরের পর বছর জাহাজে কাজ করেছে। আর খানকিটা বছরের পর বছর যারে তারে দিয়ে পেট বানিয়েছে; তার মেয়ে তো খানকিই হবে।" এরপর সোনামতির মা আস্তে আস্তে উত্তর দিতে চেষ্টা করেছে; বলেছে- "আমি যদি বছর বছর সোনামতির বাপ ছাড়া অন্যের লগে পেট বানাইয়া থাকি, তয় ত আমি বিদাশ থিকা মরদ ভাড়া কর্ইযা আনি নাই, আপনাগো কারো লগেই পেট বানাইছি।" লেখক হুমায়ুন আজাদ এই উপন্যাসটি অনেকটা সিনেমার ভঙ্গিতেই উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন; যেখানে আছে ঘটনার অন্তরালের ঘটনা। সত্যের আড়ালে আরেক সত্য। মানুষের ভিতর ও বাহির এই দুটো দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। জীবনানন্দ যেমন প্রকৃতির বিচিত্র রূপের বর্ণনা করেছেন। তেমনি মানুষের বিচিত্র রূপ তিনি ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে কাহিনির রূপায়ণ করেছেন। তিনি একথা নির্দ্বিধায় বলেছেন- মনে হয় মানুষ বাইরে এক রকম, তার বাইরেরটা সত্য নয়; মানুষ ভেতরে অন্য রকম, তার ভেতরেরটাই সত্য; কিন্তু ভেতরেরটা কেউ দেখতে দেয় না। বাবার ভেতরেরটা কেউ জানে না, বাইরেরটা জানে; তার বাইরেরটা দেখে কেউ তার সামনে কথা বলতে পারে না। সত্য-মিথ্যা, ভুল-শুদ্ধ, নিয়ম-অনিয়ম, ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় এ সমস্ত ফ্রেমে মানুষের মনকে বেঁধে রাখা যায় না। মন উড়ন্ত পাখির মতো মহাসমুদ্রের উপরে মহাকাশে উড়ে উড়ে আপন মতিতে আপন গতিতে চলে আপন নীড়ে স্থির হয়। লেখকের ভাবনা এরকম- "মানুষ এমন প্রাণী যা কোনো ছক অনুসারে চলতে পারে না। কিন্তু মানুষ ছকের কথা বলতে, আর ছক তৈরি করতে খুব পছন্দ করে।" অসাধারণ ভালোবাসা ও প্রেমের উপন্যাস এটি। যৌবনের প্রেম মনের, আত্মার, শরীরের, প্রকৃতির প্রেমের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। ভাবনায় ও বাস্তবের সঙ্গে যথেষ্ট মিল ও গভীর সম্পর্ক রয়েছে। রওশনকে ভালোবেসে চিঠি লেখে সকালে, দুপুরে। ভালোবাসার গভীরতা যে কতদূর তা কল্পনার অতীত। চিঠিতে সে লেখেছে "তুমিই পান করবে আমার যৌবন সুধা।'' ''তুমিই আমার সব।'' সবকিছু উজাড় করে দেয়া ভালোবাসার প্রকাশ পেয়েছে। হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা, চোখেমুখে, হাসিতে ভালোবাসা, ভালোবাসার মানুষের ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকতে চায় দুটি মন। তার চোখের সামনে পেছনে ভালোবাসার মানুষের পদচারণা অনুভব করে। কাছে, দূর-বহুদূরে, স্বপ্নে, অলীকে সেই ভালোবাসার মানুষের ছবিই চোখের সামনে ভেসে উঠে, মনের মধ্যে একই ছবি খেলা করে। ভালোবাসা যত গভীর, ভয় তত নিকট। ভালোবাসার মানুষকে হারানোর ভয় মনে কাজ করে। এক মুহূর্তের জন্যও সে চোখের আড়াল, মনের আড়াল হতে দিতে চায় না ভালোবাসার মানুষকে। ভালোবাসার মানুষকে কেউ কোনো দিনই হারাতে চায় না। কিন্তু হারানোর বেদনাই ভালোবাসাকে বড় ও মহৎ করে তোলে। শরৎচন্দ্রের দেবদাস পার্বতীকে হারিয়ে যেমন দিশেহারা, ঠিক তেমনি উপন্যাসের নায়কের পরিণতি- আমি নদীর দিকে হাঁটতে থাকি, আমি বুঝতে পারি না কোন দিকে হাঁটছি, নদীর দিকে না অন্ধকারের দিকে, আমার খুব কষ্ট হয়, কাঁদতে ইচ্ছে হয়, সূর্য ডুবছে নদীতে, আমার ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়, আর কি সূর্য উঠবে, আমি কিছু দেখতে পাই না। সবুজ গাছগুলোকে কালো মনে হয়, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। ভাঙাগড়ার পৃথিবীতে মানুষের জীবনও ভাঙাগড়ার মাঝে অতিবাহিত হয়। "এ-কূল ভাঙে ও-কূল গড়ে এই তো নদীর খেলা।" তবু মানুষ এই নিয়ে বেঁচে থাকে। নতুন আশায় বুক বাঁধে। নতুনভাবে বাঁচার পথ খুঁজে বেড়ায়। ভালোবাসা হলো আবেগ। আবেগের বশেই ভালোবাসার জন্ম হয়। নারীরা আবেগপ্রবণ, পুরুষেরাও তাই। আবেগ থেকে ভালোবাসা, প্রেমের, সম্পর্কের সৃষ্টি। প্রেম, ভালোবাসা চিরস্থায়ী মনে করলেও আবেগ দীর্ঘস্থায়ী নয়। হিমালয় থেকে পানি ঝর্ণার বেগে প্রবল স্রোতে নেমে এলেও নির্দিষ্ট সময় পরে বঙ্গোপসাগরে মিশে যাওয়ার মতো আবেগ মিলে যায় হাওয়ায়। ততক্ষণে সবকিছু ভেঙে দিয়ে সম্পর্ক হাওয়ায় বিলীন। উপন্যাসের ভাষা সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল। উপন্যাসটি গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে লেখায় শব্দচয়নে আঞ্চলিকতা, কথ্য ভাষার বহুল শব্দ প্রয়োগ, বাক্য গঠনে আপন বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে। চরিত্রের বিনির্মাণে, ঘটনার বর্ণনায় লেখকের নিপুণতা ও প্রাতিস্বিকতা উপন্যাসের শিল্পগুণ বিচারে প্রশংসার দাবিদার। আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল উপন্যাসটিতে আত্মানুসন্ধান ও জীবন বাস্তবতার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। জীবনব্যাপী সম্পর্ক, সময়, আকাঙ্ক্ষা, প্রেম, ভালোবাসার বিচিত্র রূপের রঙিন আভা বিচ্ছুরণ ঘটেছে উপন্যাসটিতে। বিচিত্র কল্পনা, স্বপ্ন, আশা, আশাভঙ্গের হতাশা, ক্লান্তি, যৌবন, বার্ধক্যের আলো-আঁধারি খেলা চলছে- চলবে।