'জলধি'-কথা এক সন্নিহিত ভাব-সঞ্চয়ন

প্রকাশ | ১৩ মার্চ ২০২০, ০০:০০

ড. সন্দীপক মলিস্নক
১. 'জলধি'র ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা (আগস্ট-অক্টোবর, ২০১৭ খ্রি.)-তে সাহিত্যশৈলী-সংবিধি, 'সৃজনশীলতা'-অভিক্ষেপী লৈখিক মমতা গ্রাহ্য হয়েছে। মুক্তগদ্য অধ্যায়ে সচকিত হয়েছে প্রাণময় মগ্নতার স্থিতি। মাসুদ মুস্তাফিজ তার 'জলবাসরে সূর্যের বৈভব - শব্দভানে শ্রীচরণেষু' গদ্যায়োজনে উলেস্নখ করেছেন- 'কবিতা বোধ ও অনুভবের সম্মিলন-সাহস'-সম্পৃক্ততায় সঞ্জীব হয়। তার প্রাণনায় এ বাণী সত্যমগ্ন যে, 'অদৃশ্যের মন্তাজে পরপর সংযোগপ্রাণে বোধের দৃশ্য নির্মাণ করে একটি কবিতা।' তিনি কবিতার বাক্যগঠন-প্রক্রিয়ায় শৈলী-অনুধ্যান-অনুগ 'দার্শনিকতা'র স্পর্শকেই উপলব্ধি করেন। মাহবুবুল আলমের মুক্তগদ্য 'কবিতার স্বরূপ ও বিবিধ প্রসঙ্গ'-এ শব্দাহরণ, গীতময়তা, চিত্রায়োজিত উপমা ও 'অনুভূতির নিবিড়তা'কে সংবৃত করতেই আত্মদীপ্ত হয়েছে। 'সৌন্দর্যের চরম উৎকর্ষ সৃষ্টির মাধ্যমে' তিনি 'চিত্তশুদ্ধি'-বিধানের পক্ষেই। তার সার্বভৌম বিশ্বাস- বেদনার বৈভব, বাস্তবের সঙ্গে কল্পনা, নিজের সঙ্গে অন্যের, বর্তমানের সঙ্গে অবর্তমানের, সমকালের সঙ্গে মহাকালের নিরন্তর মিশ্রণ ঘটে চলেছে কবিসত্তায়। এলিজা খাতুন তার 'সাহিত্যগ্রন্থে পাঠ্যাভ্যাস এবং আত্মশুদ্ধি' মুক্তগদ্যে শ্রেয়োবোধব্যাপ্তির প্রায়োগিক কৌশলকে সংবদ্ধ করেছেন। প্রবন্ধ অধ্যায়ে হোসেনউদ্দীন হোসেন তার 'আমেরিকান সাহিত্য ও সিনক্লেয়ার লুইস' রচনায় আমেরিকার বঞ্চিত, অবহেলিত বাণীসাধনায় নিমগ্ন লুইসের সাহিত্যসিদ্ধির কথা উলেস্নখ করেছেন। লুইস স্বদেশের 'গগনচুম্বী প্রাসাদের অভ্যন্তরে মানবতার শক্তিহরণের' বার্তা উপস্থাপন করেছেন। শহীদ ইকবালের 'শহীদুল জহিরের চাঁদ-বদনী' প্রবন্ধে আঞ্চলিক ভাষা-অভিসন্ধির আলপনা অঙ্কিত হয়েছে। শ্রীমগ্ন প্রাবন্ধিক শহীদ কথাশিল্পী শহীদুলের সার্বভৌম শৈল্পিক অভিযাত্রাকে চিত্রিত করেছেন। প্রত্যক্ষ জীবন-যাপনা - 'সংসার, দাম্পত্য, কাচ্চা-বাচ্চা বা বিয়ে, জন্ম-সঙ্গম'-সমুদ্ধৃতির নির্ণায়ক ভঙ্গি, যা শহীদুলের মর্মায়ত, তা শহীদের সমালোচনায় বিশ্বস্ত-স্বারূপ্য লাভ করেছে। শহীদ সমান্তরাল সমানুভূতিরই অন্বেষক। শহীদুলের রচনা-আভরণের মৌল পরাগ অন্বেষণ করতে গিয়ে তিনি 'নারীগণের ন্যায়রূপ পুরুষকাঠামোতে আটকানো'র কৌশলকে, 'পৌরাণিক ঐতিহ্যে নারীর কামরূপ পর্যবেক্ষণ আর সে মতে তাকে চর্ব্য-চুষ্য-লেহ্যরূপে গ্রহণ' করার সনিষ্ঠ রূপায়ণাকে অন্তরতর করেছেন। তিনি নিরীক্ষণ করেছেন- 'মানুষের চিন্তাস্রোত, বিশ্বাস বা মূল্যবোধসমূহ গড়ে ওঠে' নৈসর্গিক আবহেই- এমন সত্যও শহীদুলের 'অন্যরূপ' কথাসাহিত্য-সংস্রবে। বাবলু ভট্টাচার্য তার 'রাণু সোম থেকে প্রতিভা বসু : শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি' প্রবন্ধে প্রতিভা বসুর সম্ভ্রান্ত-সুন্দর সৃজনশীল স্বকীয়তার জয়-কীর্তন করেছেন। সাহিত্য ও সংগীত-প্রতিভায় আত্মোজ্জ্বল হয়েছিলেন তিনি। স্বনামখ্যাত কৃষ্টিবোদ্ধা স্বামী বুদ্ধদেব বসুর সহায়ক গুণ-সমৃদ্ধির সংবাহক ছিলেন রানু সোম তথা প্রতিভা বসু। তিনি 'অন্ধকারের একাধিপত্যকে' জয় করতে প্রয়াসী ছিলেন। 'বিধবা বিবাহ ও বিদ্যাসাগর' নিবন্ধে নূরুজ্জামান হালিমও নারীসত্তার পূর্ণায়ত প্রকাশ ও বিকাশ-সম্পর্কিত সত্যকে উদ্ভাসিত করেছেন। স্বভাবজ শরীরী-মানস অভিব্যক্তি- নর-নারীর পারস্পরিক যথাযথ তৃষ্ণাপূরণী আয়োজন- যুক্তি-সচ্ছল বিবাহ-সংঘটনই অভীষ্ট। কিন্তু নারী বিধবা হলেই জীবন হয় কষ্টদীর্ণ! পিতৃ-মাতৃহৃদয়ের শোণিত-ক্ষরণ স্থায়ী হয়। কিন্তু 'পুরুষ'-সত্তা অনেক ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে অপভোগ-মুগ্ধ! সামাজিক বিধান তো নৈর্ব্যক্তিক পুরুষেরই বিনির্মাণ। হালিম উলেস্নখ করেছেন- বঙ্গভারতবর্ষীয় উপমহাদেশে 'আনুমানিক ১৭৪০-এর দশকে রাজা রাজবলস্নভের হাতে' বিধবাবিবাহ আন্দোলন শুরু হয়। ২. 'সময়ের গল্পস্বর' 'জলধি'র ২য় বর্ষ, ১ম সংখ্যা (জানুয়ারি, ২০১৮ খ্রি.)-র মূল ভাব-বিভা। অতিথি-সম্পাদক আশরাফ জুয়েল তার 'সময়ের গল্পস্বর' : জলের আয়নায় উত্থানপর্বের ছোটগল্প প্রবন্ধে গবেষণা-সমুৎকর্ষণার আর্তিকে প্রজ্ঞাপিত করেছেন। সত্যসন্ধানী আশরাফ ন্যায়তই উলেস্নখ করেছেন, গল্পের ইতিহাস সুপ্রাচীন। কারণ, 'গল্প শোনা' এবং 'গল্প করা' মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত একটি প্রক্রিয়া। তাই 'লেখার অক্ষর আবিষ্কৃত হওয়ার আগেই গল্পের ক্রমবিকাশ শুরু হয়ে গিয়েছিল'। তিনি উলেস্নখ করেছেন যে, খ্রি.পূ. ৪০০০ বছর আগের মিশরের 'ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজের নাবিক'-ই প্রথম গল্প। আর ভারতবর্ষের প্রথম গল্পসংকলন বিষ্ণুশর্মা-লিখিত 'পঞ্চতন্ত্র' (খ্রি.পূ.১০০-৫০০)। আশরাফের ইতিহাস-চেতনা, বাস্তবতা ও কল্পনা-সম্বোধি সত্যায়ত অভিনিবেশকেই লালন করেছে। ৩. ২য় বর্ষ, ২য় সংখ্যা (জুলাই, ২০১৮ খ্রি.)-র 'জলধিকথা'য় সম্পাদকের নির্মেদ সত্যোচ্চারণ শিল্প-সমীক্ষণের পরাবর্তনকেই প্রপন্ন করেছে। তিনি পাঠক-সত্তার অর্বাচিনতা, 'পাঠ-বিমুখতা', 'পড়ার চেয়ে লেখার আগ্রহ, সমকালীন সাহিত্যচর্চার প্রতি অজ্ঞতা, দলীয়করণ, বিভাজন, নবীন-প্রবীণ সংঘাত, সাহিত্যের প্রতি দায়বদ্ধতার অভাব'-এর কথা উলেস্নখ করেছেন, যা ধৃতিমান প্রগতি-প্রোজ্জ্বল মানবগোষ্ঠীরও বোধি-বৈপরীত্যের প্রামাণ্যস্বরূপ। চৈতন্যশিল্পী সম্পাদকের ন্যায়বান বক্তব্য এমন - প্রক্রিয়াটি 'আমাদের সাহিত্যের নান্দনিক রূপের সাথে পরিচিত হতে বিঘ্ন ঘটায়। আর এ কারণেই সাহিত্যজননীর কোলজুড়ে অজস্র রুগ্ন ছানার আনাগোনা।' মূলত 'জলধি'র মর্মজ্যোতিরই প্রামাণ্য এ কথকতা। ৪. 'জলধি'র ৩য় বর্ষ ২য় সংখ্যা (আগস্ট, ২০১৯ খ্রি.)-য় উচ্চকিত হয়েছে- 'ছোটকাগজ'-সম্পাদনার ক্ষেত্রে আলোচনা ও পর্যালোচনাপর্বে 'দুর্বলতম দিক' প্রকটিত হয়। এমন ভাবনায় সায় থাকা অস্বাভাবিক নয়। 'জলধি'র এ সংখ্যায় প্রভুত্ব-সত্ত্বের বিভাকে লালন করেছেন সম্পাদক। তার উজ্জ্বল উক্তিতে আলোচক ও পর্যালোচকদের নিম্নোক্ত সত্যায়ত দুর্বলতাগুলো প্রকাশিত হয়েছে : ক. পাঠ-বিশ্লেষণী জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব, খ. পাঠ-অভিজ্ঞতার সুচারু ও সাবলীল প্রকাশে অক্ষমতা. গ. পাঠ-পর্যালোচনার উপযোগী ও প্রয়োজনীয় ভাষাজ্ঞানের অভাব. ঘ. বিশ্বসাহিত্যের প্রতি পাঠ-পর্যালোচকদের উদাসীনতা, যা তাদের পঠিত গ্রন্থের মান ও সৌসাম্য-বিচারে রাশিদ আশকারীর 'বাংলাদেশ ; সমকালীন সমাজ রাজনীতি' গ্রন্থের সহজ-সমালোচনায় প্রদীপ্ত হয়েছেন কুমকুম চট্টোপাধ্যায়। কুমকুম সমান্তরাল অনুভবের মুগ্ধতাকে লালন করেছেন তার লৈখিক বলয়ে। গ্রন্থকারের সদ্ভাবনা আর প্রেরণা-প্রেষণার সূত্রকে অবলীলায় প্রাণায়ত করেছেন কুমকুম। ৫. প্রবন্ধে কলকাতা অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে তিনটি প্রবন্ধ। মনস্বিতার দ্রবণ আর সংসিদ্ধ গদ্যগঠন-সহযোগে বিন্যস্ত হয়েছে প্রথম প্রবন্ধ মুহিম মনিরের 'দেশভাগ' : কয়েক টুকরো কবিতা'। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের 'দেশভাগের দায়ভাগ' প্রবন্ধগ্রন্থের পর্যালোচনা- ঐকান্তিক ভাব-সন্নিহিত সম্বেগ প্রকৃতিস্থ হয়েছে মুহিমের চৈতন্যের আলপনায়। বঙ্গভারতবর্ষীয় বিভাজন এক অপ্রিয়, 'বেদনাবিধুর', অমানবিক এবং তিক্ত সন্দেশ হলেও 'অনেক কবিই মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলেন।.. চলিস্নশের সাহিত্য স্বীয় বিমূঢ়তার প্রতিবাদ করেনি।' কল্যাণ মন্ডলের প্রবন্ধগ্রন্থ 'সজনীকান্তের দপ্তর'-এর মর্ম-মগ্ন সমালোচনা 'আলোচিত গ্রন্থ 'সজনীকান্তের দপ্তর'-এ মোস্তফা তোফায়েল হোসেন সমালোচনা-সত্যের আয়তনকে আলোকিত করেছেন। তিনি বোধায়ত করেছেন যে, 'প্যারোডি রচয়িতা পদ্যকার' সজনীকান্তের উচ্চারণবলয় 'নেতিবাচক অপচয়'-এ ভরা। গৌতম রায়-রচিত 'সাম্প্রদায়িকতা ও বর্তমান ভারত' গ্রন্থের সম্যক ভাব-বিশ্লেষণী রূপমা রাশিদ আসকারীর 'সাম্প্রদায়িকতা ও বর্তমান ভারত : একটি নিবিড় পাঠ' প্রবন্ধটি।