নজরুলের ‘মরু-ভাস্কর’ চিন্তা ও দশর্ন

প্রকাশ | ৩১ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

ফজলুল হক সৈকত
কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি জনগোষ্ঠীর জীবনে নতুনতর সাহিত্যবোধ, সাহিত্যদৃষ্টি এবং সাহিত্য-স্বরূপ-আদশর্ উপস্থাপন করেছেন। তিনি সত্যিকারভাবে বাঙালির চেতনার কবি। মানবতাবাদ, দেশপ্রেম ও নিবিড় ধমের্বাধের পরিচয় মেলে তার সমগ্র সৃষ্টিকমের্। বৃহৎ অথের্ নজরুল বিশ্বমানবতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য চিন্তা ও সমগ্র কমর্-পরিসরকে নিবেদন করেছেন। সমাজ ও রাষ্ট্রভূমির জন্য মানুষের যে ভাবনা, অধিকার ও ন্যায়বিচার সুনিÐিু করবার যে লড়াই, তাতে তিনি শামিল থেকেছেন নিরন্তর। ঐতিহ্য থেকে, ইতিহাস থেকে তথ্য-অনুসন্ধান এবং তার শৈল্পিক পরিবেশনা নজরুল-সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল প্রসঙ্গ। প্রাতিস্বিকতা আর পরিবেশনশৈলীর জন্য তিনি উত্তর-প্রজন্মের কাছে প্রেরণার বড় উৎস হয়ে আছেন। নবজাগ্রত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তশ্রেণির চৈতন্যের রূপকার এই রোমান্টিক কবি। তার সৃষ্টিতে বিষয়ের বৈচিত্র্য আর পরিবশেন-ভিন্নতা পাঠককে মোহিত করে। ব্যক্তিক অস্তিত্বের অব্যাহত প্রতিধ্বনি আর আত্ম-উপলব্ধির প্রখরতায় তিনি স্বতন্ত্র এক কণ্ঠস্বর। নজরুলের অবিভার্ব এমন এক সমাজ-প্রতিবেশে, যখন ইংরেজ সা¤্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-নিযার্তনে অস্থির ও অসহনীয় ভারতের সাধারণ মানুষ। তখন তিনি স্বভাবতই মানবতাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠেন। সমকালীন ভারতীয় মুসলমান সাহিত্যিকদের মতো, কাব্য-সাধনার প্রথম থেকেই নজরুল ইরান ও তুরস্কের প্রতি মনোযোগী ছিলেনÑ এটি তার চেতনার একটি বিশেষ দিক। সম্ভবত ইসলামী চেতনার প্রতি বিশ্বস্ততাই তার প্রধান কারণ। কাজেই তার কবিতায়, কথাসাহিত্যে, গানে ইসলামী ঐতিহ্য ও চিন্তা প্রতিফলিত হয়েছে অনিবাযর্ভাবে। কবি হিশেবে আত্মপ্রকাশের প্রায় শুরুতেই, ১৯২০ সালে নজরুল লেখেন ‘খেয়াপারের তরণী’। আর তখন থেকেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব-সন্তান মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি তার বিশেষ সম্মান ও নিভর্রতা প্রকাশ পায়। কবিতাটিতে তিনি লিখেছেনÑ ‘নহে এরা শঙ্কিত বজ্র নিপাতের;/কাÐারী আহমদ, তরী ভরা পাথেয়!/আবুবকর উস্মান উমর আলী হায়দর/দাড়ি যে এ তরণীর, নাই ওরে নাই ডর!/কাÐারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা./দাড়ি-মুখে সারি গানÑ লা শরীক আল্লাহ্!’Ñ এই যে অবিচল-অশেষ আস্থা মুহাম্মদের প্রতি, সৃষ্টিকতার্র প্রতি, তা সম্প্রসারিত হয়েছে নজরুলের পরবতীর্ চিন্তাধারায়। ১৯২০ এ ১৯২১-এ মহানবীর জন্ম ও মৃত্যু বিষয়ে লিখেছেন পূণার্ঙ্গ কবিতাÑ যথাক্রমে ‘ফাতেমা-ই-দোয়াজ দহম (আবিভার্ব)’ এবং ‘ফাতেমা-ই-দোয়াজ দহম (তিরোভাব)’। উপরিউক্ত ৩টি কবিতাই ছাপা হয় মোসলেম ভারত-এ। মরু-ভাস্কর (প্রথম প্রকাশ: ১৯৩০, প্রথম কবিতা ‘অবতরণিকা’ মাসিক সওগাত পত্রিকায় ‘মরু-ভাস্কর’ শিরোনামে বেরিয়েছিল; গ্রন্থাকারে প্রকাশ: ১৯৫০, প্রভিন্সিয়াল বুক ডিপো, ঢাকা) নামক কাব্যে আমরা পাই মহানবীর পূণার্ঙ্গ জীবনচরিত। গ্রন্থটির পাÐুলিপি সংরক্ষণ ও সরবরাহ করেছিলেন বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ। সওগাত-এ কবিতাটির পাশে তারকা-চিহ্ন দিয়ে পাদটীকায় সম্পাদক লিখেছেনÑ ‘কবি হজরত মোহাম্মদের (দ.) জীবনী কাব্যে লিখিতেছেন, এই কবিতাটি তাহার পূবার্ংশ’। ‘মরু-ভাস্কর’ ৪টি সগের্ বিভক্ত। কবিতা সংখ্যা সবের্মাট ১৮। প্রথম সগের্ নবীজির আবিভার্বকাল, ২য় সগের্ তার শৈশব, ৩য় সগের্ কৈশোর এবং ৪থর্ ও শেষ সগের্ সংসার-জীবন এবং বিশ্ব-মানবতার জন্য সংগ্রামের প্রারম্ভকথা স্থান পেয়েছে। গ্রন্থটি রচনার জন্য বিপুল প্রস্তুতি ও আয়োজন সত্তে¡ও শেষ পযর্ন্ত মহানবীর জীবনের মাত্র ২৫ বছরকাল কবি রূপায়িত করতে পেরেছেন। নজরুল-প্রকাশক ‘শরচ্চন্দ্র চক্রবতীর্ অ্যান্ড সন্স’-এর প্রধান নিবার্হী মনোরঞ্জন চক্রবতীর্র আগ্রহে নজরুল মরু-ভাস্কর লিখেছেন বলে জানা যায়। তিনি সেই সময়েÑ ১৯৩১ সালে, মনোরঞ্জনের আতিথেয়তায় কিছুকাল দাজিির্লং এবং শিলঙে অবস্থানও করেছিলেন। তখন, দাজিির্লংয়ে রবীন্দ্রনাথ এবং সাহিত্যিক জাহানারা বেগম চৌধুরীর সাথে নজরুলের সাক্ষাৎ হয়েছিল। যাই হোক, গ্রন্থটির প্রথম কবিতা ‘অবতরণিকা’ আরম্ভ-অংশ থেকে কিছতা পাঠ নিয়ে আমরা বতর্মান আলোচনার ভেতরে প্রবেশ করিÑ জেগে ওঠ তুই রে ভোরের পাখি, নিশি-প্রভাতের কবি! লোহিত সাগরে সিনান করিয়া উদিল আরব-রবি। ওরে ওঠ তুই, নূতন করিয়া বেঁধে তোল তোর বীণ! ঘন অঁাধারের মিনারে ফুকারে আজান মুয়াজ্জিন।... দখিনে ভারত-সাগরে বাজিছে শঙ্খ, আরতি-ধ্বনি, উদিল আরবে নূতন সূযর্Ñ মানব-মুকুট-মণি। সারা দুনিয়ার মানুষের জন্য নতুন বারতা নিয়ে হাজির হয়েছেন ‘আরবের রবি’ মুহাম্মদ। তার আগমন-বাতার্র আওয়াজ যেন সবর্ত্র-প্রসারিত। বিশ্বময় মানুষ যখন স্বপ্নঘোর, তখন শস্য-কুসুমের ডালি নিয়ে আবিভুর্ত হলেন তিনিÑ মহানবী সম্বন্ধে এই হলো নজরুলের পযের্বক্ষণ। কবি অনুভব করতে পেরেছেন, মহানবীর আবিভার্ব-আলোক পৃথিবী জ্যোতিমর্য় হয়ে উঠেছে। আরব দেশে ‘অনাচার মিথ্যা পাপের নিপীড়ন-উৎসবে’ সমাজ-রূপান্তরের সুরের বীণা আর আগুনের-আবেশ নিয়ে যে মহামানবের আগমন, তার প্রতি কবির শ্রদ্ধাঘর্্য নিবেদিত হয়েছে এভাবেÑ বাদলের নিশি অবসানে মেঘ-আবরণ অপসারি, ওঠে যে সূযর্Ñ প্রদীপ্ততর রূপ তার মনোহারী। সিক্তশাখায় মেঘ-বাদলের ফঁাকে ‘বৌ কথা কও’ পাপিয়া যখন ডাকেÑ সে গান শোনায় মধুরতর গো সজল জলদ-চারী! বষার্য়-ধোওয়া ফুলের সুষমা বণিের্ত নাহি পারি! কবি ও সাহিত্য-সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার মরু-ভাস্কর সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেনÑ ‘অলংকারের স্ফুলিঙ্গ-বৃষ্টি’। নিবিড় পযের্বক্ষণে দেখা যায়Ñ সাম্যবাদী কবি, সত্যনিষ্ঠ কবি নজরুল এখানে অনেকটা আবেগাপ্লুত হলেও সত্যের অপলাপ বা যুক্তিহীনতায় নিপতিত হননি। মহানবীর জীবনী বণর্নায় সত্যের প্রতি অবিচল ও নিষ্ঠাবান ছিলেন তিনি। আর তা পরিবেশনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত ভাবগম্ভীর ভঙ্গিকে আশ্রয় করেছেন। শৈল্পিক-সাহিত্যিক আভিজাত্য যেন নমিত না হয়, সেদিকে তার সচেতন দৃষ্টি ছিল। ইতিহাসের প্রসঙ্গতে, ঐহিত্যকে তিনি সাজিয়েছেন সাহিত্যের সাদা কাগজে। কল্পনার রঙÑ কবি-কল্পনা সেখানে প্রযুক্ত হলেও মিথ্যার আশ্রয় নেই। এ প্রসঙ্গে ছন্দ-বিশারদ আবদুল কাদিরের মন্তব্য তুলে দিচ্ছিÑ আমাদের পরম প্রিয় কবি নজরুল ইসলাম তার ‘মরু-ভাস্কর’ কাব্যে হজরতের আবিভার্ব থেকে নবুওত প্রাপ্তি পযর্ন্ত ঘটনাবলী ১৮টি খÐ কবিতায় বিবৃত করেছেন, কিন্তু তা-ও অসম্পূণর্। তবে নজরুলের কাব্যখানির সাথর্কতা এ জন্য যে, তাতে মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ও ছন্দের নানা বিচিত্র ভঙ্গি তার অসামান্য ভাবের উপযুক্ত বাহন হয়েছে।’ (‘হজরত মোহাম্মদ কাব্য’, মুসলিম সাহিত্য ও সংস্কৃতি, ১৯৮৯) হযরত মুহাম্মদের (সা.) জীবনী লেখার জন্য নজরুলের দীঘির্দনের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি ছিল। আর সমকালীন মুসলিম সাহিত্য সমাজের চিন্তার দিকেও মনোযোগী নজর ছিল তার। বিষয়ের কারণেই গ্রন্থটিতে আরবি-ফারসি শব্দের প্রয়োগ করেছেন বেশি। তবে সেগুলোর অধিকাংশই সাধারণ শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের পরিচিত শব্দ। তাই কাব্যটি পাঠের ক্ষেত্রে কোনোরকম দুবোর্ধ্যতা তৈরি হয়নি। লক্ষণীয় বিষয়Ñ নজরুল তার কবিতার মূল সুর ‘সবর্হারা’ এবং ‘সাম্যবাদী’ প্রবল সতকর্তার সাথে মরু-ভাস্কর-এও প্রয়োগ করেছেন। ২য় সগের্ ‘সবর্হারা’ আর ৪থর্ সগের্ ‘সাম্যবাদী’ শিরোনামের ২টি ভিন্ন কবিতা বিশেষ অভিনিবেশের কারণ। সবর্হারাদের যাতনা দূর করার যে প্রত্যয় নজরুলের কবিতায়, সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার যে লড়াই তিনি করে গেছেন সারাজীবন, তার সাথে মহানবীর জীবন ও সংগ্রামের এই যে অপূবর্ সাদৃশ্য-তুলনা, তা সত্যিই বিস্ময়কর। এমনকি মহানবীর ব্যক্তিগত মহান দারিদ্র্যের সাথে নজরুলের ‘দারিদ্র্য’ কবিতার অভিব্যক্তিরও সুন্দর সাদৃশ্য আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। তাহলে কি নজরুল এই মহামানবের জীবনদশর্ন ও বাণীকেই ধারণ করেছিলেন চিন্তা ও চচার্র সমস্ত প্রহর জুড়ে? তার সাহিত্য-সাধনা কি সত্যিই সত্য ও সুন্দরের পথে পরিচালিত হয়েছিল শ্রেষ্ঠ মানবের জীবনযুদ্ধ ও অজের্নর অনুপ্রেরণা থেকে? প্রসঙ্গত, আমরা কবিতা দুটি থেকে কিছতা পাঠ নিতে পারিÑ ১। সকলের তরে এসেছে যে জন, তার তরে পিতার মাতার ¯েœহ নাই, ঠঁাই নাই ঘরে। নিখিল ব্যথিত জনের বেদনা বুঝিবে সে, তাই তারে লীলা-রসিক পাঠাল দীন বেশে! আশ্রয়হারা সম্বলহীন জনগণে সে দেখিবে চির-আপন করিয়া কায়মনেÑ বেদনার পর বেদনা হানিয়া তাই তারে ভিখারি সাজায়ে পাঠাল বিশ্ব-দরবারে! (‘সবর্হারা’) ২। আদি উপাসনালয়Ñ উঠিল আবার নূতন করিয়াÑ ভূত প্রেত সমুদয় তিন শত ষাট বিগ্রহ আর মূতির্ নূতন করি’ বসিল সোনার বেদীতে রে হায় আল্লার ঘর ভরি। সহিতে না পারি এ-দৃশ্য, এই স্রষ্টার অপমান, ধেয়ানে মুক্তি-পথ খেঁাজে নবী, কঁাদিয়া ওঠে পরান। খদিজারে কনÑ “আল্লাতালার কসম, কাবার ঐ ‘লাৎ’ ‘ওজ্জা’র করিব না পূজা, জানি না আল্লা বই! নিজ হাতে যারে করিল সৃষ্টি খড় আর মাটি দিয়া কোন্ নিবোর্ধ পুঁজিবে তাহারে হায় স্রষ্টা বলিয়া।” সাধ্বী পতিব্রতা খদিজাও কহেন স্বামীর সনেÑ “দূর কর ঐ লাত্ মানাতেরে, পূজে যাহা সব-জনে। তব শুভ-বরে একেশ্বর সে জ্যোতিমের্য়র দিশা পাইয়াছি প্রভু, কাটিয়া গিয়াছে আমার অঁাধার নিশা।” (সাম্যবাদী) মূতির্পূজার বিরুদ্ধে একেশ্বরবাদে বিশ্বাস এবং সৃষ্টিকতার্র উপস্থিতি বিষয়ে নিঃসংশয়বাদ কবি-চেতনাকে আলোড়িত করেছে সব সময়। কবি নজরুলের সবচেয়ে আবেদন-সৃষ্টিকারী কবিতা ‘বিদ্রেহী’তেও আছে সেই অনুভবের স্বীকৃতি। ‘আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বঁাধ’ কিংবা ‘আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বঁাধ!’Ñ সম্ভবত সেই প্রত্যয় ও সত্যনিষ্টারই বহিপ্রর্কাশ। নজরুল-সাহিত্যে ধমর্-প্রসঙ্গ পযের্বক্ষণ করলে দেখা যায়, মানুষ আর ধমর্ তার কাছে একাথের্বাধক। মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ-প্রতিষ্ঠায় নজরুলের শ্রদ্ধা যেমন অপরিসীম, তেমনই তার স্রষ্টাভাবনাও মানবতাবাদের পরিপোষক। তার দৃষ্টিতে আল্লাহ্ হচ্ছেনÑ ‘আল গফুরুর ওদুদ’, ‘আল-ফাজালিল আজিম’। তবে ধমের্র নামে গেঁাড়ামিকে কখনোই তিনি স্বীকার করেননি। তার এই বিশ্বধমের্বাধ ও মানবতাবাদের চিত্র কেবল মরু-ভাস্কর রূপায়নের ভেতর দিয়েই নয়; বরং কবিতা-কথাসাহিত্য-প্রবন্ধ-গানÑ সমগ্র সাহিত্য-পরিসর জুড়েই প্রসারিত। নিজস্ব ধমির্চন্তার দশর্নকে আশ্রয় করে তিনি মরু-ভাস্কর-এর মাধ্যমে মহামানব মুহাম্মদ (স.)-এর বাতাের্কই কেবল মানুষের কাছে পেঁৗছে দিতে চেয়েছেন।