পদকমলে যার স্বাধিকারের ইতিহাস

মুক্তিযুদ্ধ আমার কঁাধে ঝোলা দিয়েছে। আমার খালি পা, দুঃসহ একাকীত্ব মুক্তিযুদ্ধেরই অবদান। আমার ভেতর অনেক জ্বালা, অনেক দুঃখ। আমি মুখে বলতে না পারি, কালি দিয়ে লিখে যাব। আমি নিজেই একাত্তরের জননী। Ñরমা চৌধুরী

প্রকাশ | ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

রুম্পা রুমানা
রমা চৌধুরী
রমা চৌধুরীর জন্ম ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার পোপাদিয়া গ্রামে। শিক্ষাজীবন শুরু করেন নিজ বিভাগেই। তারপর প্রাচ্যের অক্সফোডর্খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর করেছেন ১৯৬১ সালে। সম্ভবত তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী স্নাতকোত্তর। কমর্জীবন শুরু করেন কক্সবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে। ১৯৭১ সাল। শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। রমা চৌধুরী তখন পোপাদিয়ায়। পৈতৃক ভিটায়। সাথে তিন পুত্র সন্তান ও বৃদ্ধা মা। স্বামী তখন ভারতে। ১৯৭১-এর ১৩ মে। এই দিনটা রমা চৌধুরীর জীবনে কালো এক অধ্যায়ের জন্ম দেয়। এই দিন ভোরে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা হামলা করে তার বাড়িতে। অবণর্নীয় নিযার্তন চালায় রমা চৌধুরীর ওপর। তিন শিশুপুত্র তখন ঘরে। নিযার্তনের এক পযাের্য় তিনি জীবন বঁাচাতে ঝঁাপ দেন পুকুরের জলে। প্রাণে বেঁচে যান। সেদিনই গানপাউডার ছিটিয়ে রমা চৌধুরীর বাড়িটি পুড়িয়ে দেয় রাজাকার ও পাকিস্তানিরা। তারপর থেকে শুরু হয় দুঃসহ যন্ত্রণার জীবন। রমা চৌধুরীর লেখা ‘একাত্তরের জননী’ গ্রন্থে সেইসব দুঃসহ দিনের কথা এভাবেই ফুটে উঠেছে, ‘আমাদের দেখতে বা সহানুভূতি জানাতে যারাই আসছেন তাদের কাছে আমার নিযাির্তত হবার ঘটনাটা ফলাও করে প্রচার করছে অশ্রাব্য ভাষায়। আমাদের বাড়ির উত্তর দিকে খোন্দকারের বাড়ি। সে বাড়ির দু’তিনজন শিক্ষিত ছেলে আমাদের তখনকার অবস্থা সম্পকের্ জানতে এলে আমার আপন মেজো কাকা এমন সব বিশ্রী কথা বলেন যে, তারা কানে আঙ্গুল দিতে বাধ্য হয়। আমি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছি না, দোকানে গিয়ে কিছু খাবারও সংগ্রহ করতে পারলাম না মা ও ছেলেদের মুখে দেবার।’ তারপরের আট মাস কাটে জঙ্গলে লুকিয়ে। রাতের বেলা পোড়া ভিটেতে খড়-পলিথিন বিছিয়ে ঘুমিয়ে। বষার্ কিংবা শীত, কোন ঋতুতেই নিজেদের রক্ষা করার সম্বলটুকুও তখন অবশিষ্ট নেই। অনাহার-অধার্হারে সন্তানরা নানান অসুখে ভুগতে থাকে। ১৫ ডিসেম্বর রাত। বিজয়ের পূবর্ দিন। শ্বাসকষ্ট শুরু হয় ছেলে সাগরের। ডাক্তার-ওষুধ-পথ্য কিছুই নেই। চারদিন এভাবে থেকে ২০ ডিসেম্বর মারা যায় সাগর। শোকে তিনি তখন অধর্ পাগলিনী। ১৯৭২-এর ১৫ ফেব্রæয়ারিতে আরেক ছেলে টগরও একই অসুখে ভোগে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। তিনি তখন পাগলপ্রায় হয়ে ওঠেন পুত্রদের শোকে। এই সন্তানদের জন্যই তিনি আত্মহনন থেকে নিজেকে বঁাচিয়ে রেখেছিলেন। সন্তানদের মৃত্যুর পর প্রথম সংসার ভেঙে গেলে দ্বিতীয় সংসার করতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হন। এই দুঃখিনী জননী সনাতন ধমের্র রীতি অনুযায়ী দুই পুত্রকে না পুড়িয়ে কবর দেন। পুত্রদের হারিয়ে তিনি একটানা চার বছর পায়ে জুতা পরেননি। যে পুত্রদের তিনি মাটিতে শুইয়েছেন সেই মাটির ওপর জুতা পায়ে হঁাটতে নারাজ ছিলেন তিনি। দীঘর্ চার বছর এভাবে হঁাটার পর প্রতিবেশীদের অনুরোধে জুতা পায়ে তোলেন। তাও শারীরিক অসুস্থতায়। কিছুদিন জুতা পায়ে রাখলেও গত ষোল বছর ধরে তিনি খালি পায়েই হেঁটে চলেন সবখানে। রমা চৌধুরীকে চিনতে চান? প্রখর রোদ কিংবা বৃষ্টি- বাদল। চট্টগ্রামের অলি-গলিতে যে বৃদ্ধা কঁাধে বইয়ের ঝোলা নিয়ে খালি পায়ে হেঁটে বই বিক্রি করছেন, তিনিই আমাদের মা রমা চৌধুরী। এভাবেই তিনি এখন পরিচিত। নিজের লেখা বই বিক্রি করেই নিজের যাবতীয় খরচ বহন করেন। এ যাবতকালে ১৮টি মৌলিক গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। ব্যক্তিত্ববোধের অনন্য এক উদাহরণ রমা চৌধুরী! তিনি একজন বিস্ময় মহিলাও। গত বছর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন রমা চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণেই। দু’জন ভাগ করে নেন নিজেদের কষ্টকে। এক পযাের্য় প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে সহযোগিতার কথা বলা হলে তিনি বিনয়ের সঙ্গে তা গ্রহণ না করার কথা জানান। মূলত তিনি দুঃখের উপাখ্যান শোনাতেই দেখা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যার সঙ্গে। রমা চৌধুরীর সেই পুড়িয়ে দেয়া বাড়িতে ‘দীপঙ্কর স্মৃতি অনাথালয়’ নামে একটি অনাথ আশ্রম গড়ে তুলেছেন নিজের প্রচেষ্টায়। বেঞ্জামিন পাকাের্রর বিখ্যাত একটা উক্তি মনে পড়ছেÑ ‘ডরঃয মৎবধঃ ঢ়ড়বিৎ পড়সবং মৎবধঃ ৎবংঢ়ড়হংরনরষরঃু.’ স্বাধীন দেশে আমাদের একাত্তরের জননী রমা চৌধুরী সেই মহৎ দায়িত্বের ভার একাই বহন করছেন! মুক্তিযুদ্ধ আমাদের লাল-সবুজ পতাকা দিয়েছে, বিশ্বমানচিত্রে একটা স্বাধীন দেশ দিয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ কেড়েও নিয়েছে অনেক। সম্ভ্রম হারানো মায়েরা দেহে বয়ে বেড়াচ্ছেন হায়েনাদের নিযার্তনের দিনগুলোকে। এমন দুঃখগঁাথা উপাখ্যানেরই এক নাম রমা চৌধুরী। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই; কিন্তু তার স্মৃতির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রইবে আজীবন।