শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নারী নির্যাতন এবং বাংলাদেশের আইন

আইনুন্নাহার সিদ্দিকা
  ৩০ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

বাংলাদেশে নারী নির্যাতন মহামারি আকার ধারণ করেছে। এ নির্যাতন শুধু শারীরিক নয় মানসিকভাবেও করা হয়। বিভিন্ন কারণে নানাভাবে নারীরা আমার দেশে নির্যাতিত হয়ে আসছেন। ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য, অসম্মান প্রদর্শনের জন্য, আর্থিক স্বার্থের জন্য- সর্বোপরি নারীর অগ্রসরতাকে প্রতিহত করার জন্যই মূলত নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। আমাদের সমাজে নারীদের কোনো স্থান নেই, সম্মান নেই। যে কোনো নির্যাতন অত্যাচারকে জায়েজ করা হয় নারীটার চরিত্র খারাপ বলে। নারীদের চরিত্রটাই মূল বিষয়। চরিত্র ভালো-মন্দের মাপকাঠিটাও নির্ধারণ করে দেয় সেই নির্যাতনকারীই। যে কোনো সভ্য সমাজই নারীকে সম্মানিত করে বড় হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে এ নারীদের মানুষ হিসেবে গণ্যই করা হয় না।

নারী নির্যাতনের ভয়াবহতার কারণেই আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইন প্রণীত হয়েছে। প্রচলিত যে আইন ছিল তাতে বিশেষভাবে নারীদের ওপর নির্যাতন প্রতিরোধের মতো কিছু ছিল না। এ পরিস্থিতিতে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ২০০০ সালে প্রণীত হয় 'নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০'। পরে যা ২০০৩ সালে সংশোধন করা হয়।

নারী নির্যাতন শুরুই হয় পরিবার থেকে। যৌতুকের জন্য নির্যাতন, ভরণ-পোষণ না দেওয়া, নারী শিশুর লেখাপড়ার সুযোগ না দেওয়া ইত্যাদি নানা রকম নির্যাতন পারিবারিকভাবেই করা হয়ে থাকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে পারিবারিক 'সহিংসতা প্রতিরোধ আইন ২০১৩' নামে আইন প্রণীত হয়। এ আইন শুধু পারিবারিক নির্যাতনগুলো প্রতিরোধের নিমিত্তেই প্রণীত হয়েছে। কিন্তু আইনের দ্বারস্থ হওয়া মানেই পরিবার ভেঙে যাওয়া। যার ফলে পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইনটি সেভাবে এখনো ব্যবহৃত হয় না।

আদালতগুলোয় অধিক পরিমাণে মামলা দায়ের হয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আওতায়। বিশেষ এ আইনে নির্দিষ্ট কতগুলো বিষয়ে বিচার করা হয়। যেমন-

১. দহনকারী পদার্থ দ্বারা সংঘটিত অপরাধ, যেমন এসিড নিক্ষেপ, আগুন দেওয়া ইত্যাদি। এ অপরাধে সাত বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা মৃতু্যদন্ড দেওয়া যায়। অপরাধের ভয়াবহতা বিবেচনায় শাস্তির মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়। এসিড নিক্ষেপের ফলে কারও মৃতু্য হলে শাস্তি হবে মৃতু্যদন্ড।

২. নারী পাচার। কোনো নারীকে পাচারের উদ্দেশ্যে আনা-নেওয়া বা কাছে রাখলেও এ ধারায় সে অভিযুক্ত হবে। এ ধারায় কমপক্ষে ১০ বছর কারাদন্ড থেকে সর্বোচ্চ মৃতু্যদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

৩. শিশু পাচার- এ ধারাতেও মৃতু্যদন্ড সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান হিসাবে রাখা হয়েছে।

৪. নারী ও শিশু অপহরণ- এ অপরাধের শাস্তি সর্বনিম্ন চৌদ্দ বছর কারাদন্ড ও সর্বোচ্চ যাবজ্জীবনের বিধান রাখা হয়েছে।

৫. মুক্তিপণ আদায়- মুক্তিপণ আদায়ের জন্য কোনো নারীকে বা শিশুকে আটক করলে তার শাস্তি মৃতু্যদন্ড বা যাবজ্জীবন।

৬. ধর্ষণ- আমাদের দেশে ধর্ষণ একটি মহামারির আকার ধারণ করেছে এবং অপরাধীরা এ অপরাধকে অপরাধ হিসেবেই গণ্য করে না। ধর্ষণের ফলে কারও মৃতু্য হলেই কেবল মৃতু্যদন্ডের বিধান ছিল। বর্তমানে আইন সংশোধন করে মৃতু্যদন্ড রাখা হয়েছে।

৭. আত্মহত্যার প্ররোচনা- নারীর সম্মানহানির প্রত্যক্ষ কারণে যদি কোনো নারী আত্মহত্যা করে তার সেই আত্মহত্যার প্ররোচনার দায়ে দোষী ব্যক্তির শাস্তি হবে সর্বনিম্ন পাঁচ থেকে সর্বোচ্চ দশ বছর।

৮. যৌন পীড়নের জন্য সাজা আছে সর্বনিম্ন তিন বছর থেকে সর্বোচ্চ দশ বছর।

৯. যৌতুকের জন্য নির্যাতন বা যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ফলে মৃতু্য হলে সাজা হবে সর্বোচ্চ মৃতু্যদন্ড বা সর্বনিম্ন তিন বছরের কারাদন্ড।

মূলত এই হলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আওতায় অপরাধগুলো।

এ অপরাধগুলোর সংজ্ঞাও এ আইনে দেওয়া আছে। প্রচলিত ফৌজদারি রাখা হয়েছে। ধর্ষণের ক্ষেত্রে বৈবাহিক ধর্ষণকে আমলে নেওয়া হয়নি। শুধু নারী এবং নারী শিশুদের ক্ষেত্রেই এ আইন প্রযোজ্য। অন্য কোনো লিঙ্গের মানুষ এ আইনের সুবিধা নিতে পারবে না। তাদের যেতে হবে ফৌজদারি দন্ডবিধিতে। খুব সংক্ষিপ্তভাবে আইনগুলোর শুধু পরিচয় দিলাম। আরও একটি আইন আছে যৌতুক নিরোধ আইন। এ আইনে সাজার পরিমাণ খুবই সামান্য।

আইনগুলো বিস্তারিত বিশ্লেষণ করলে মনে হবে এ দেশে নারী নির্যাতন বন্ধ হয়ে গেছে। এ দেশে নারী নির্যাতন হতেই পারে না। তারপরও আমাদের দেশে নারী নির্যাতন ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে ধর্ষণের মতো অপরাধ অহরহ ঘটেই চলেছে। অপরাধীরা ঘোষণা দিয়ে অপরাধ করছে। অপরাধের সংখ্যা নিয়ে তা উদ্‌যাপন করছে। বরং যে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে সে আর তার পরিবার সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছে, অপমানিত হচ্ছে, অনেক সময় পৈতৃক ভিটেমাটি ছেড়ে উদ্বাস্তু হচ্ছে।

এ অপরাধগুলো ঘটার ও তা বাড়ার কারণগুলো হলো-

১. সামাজিকভাবে নারীদের মর্যাদা না দেওয়া। লিঙ্গ পরিচয়ে নারীর পরিচয় নির্ধারণ, নারীকে মানুষ না ভেবে শুধু নারী নামক জীব ভাবা। একটি ধর্ষণের শিকার মেয়ে সমাজে পতিত হিসেবে বিবেচিত হয়।

২. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ বিচারহীনতার সংস্কৃতি। আমাদের দেশ একটি বিচারহীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। কোনো অপরাধের বিচার হয় অপরাধীর সামাজিক পরিচয়ে অর্থাৎ সামাজিক অবস্থানের দ্বারা। যার ক্ষমতা আছে, যার প্রভাব আছে, যার ধন-সম্পদ আছে তাদের বেশিরভাগ অপরাধের কোনো বিচার হয় না। অপরাধী হিসেবে সাজা পায় যার ক্ষমতা প্রতিপত্তি নেই। প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে কি দেশের আদালতগুলো বিচার করে না? উত্তর হচ্ছে করে। ভালো বিচার করে। সেটা অপরাধীদের শ্রেণি বিবেচনায়।

ধর্ষণ অপরাধটি একটি বিশেষ আইনের আওতায় বিচার করা হয়। আইনটি 'নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন'। এখন এ ঘটনার পর মামলা করার জন্য প্রথমে যেতে হবে থানায়। থানায় গিয়ে অভিযোগ করার পর নির্যাতিতার ডাক্তারি পরীক্ষা হবে। পুলিশ তদন্ত করে চার্জশিট দেবে। আদালত মামলাটি বিচারের জন্য নিয়ে সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করবে। মামলার সাক্ষী, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র (ডাক্তারি সনদপত্র) দেখে বিচারক রায় দেবে। খুব সোজা। না, সোজা নয়। মামলা করতে গেলে পুলিশ আগে দেখবে অপরাধী কে? অপরাধী যদি ক্ষমতাসীন দলের হয় বা প্রভাবশালী কেউ হয় বা তথাকথিত ভিআইপি কেউ হয় তখন মামলা নিতে গড়িমসি করবে। ফলে ডাক্তারি পরীক্ষা দেরি হবে। অথবা হবে না। স্বাভাবিকভাবে মামলা হলো, তারপর অভিযুক্ত পক্ষ প্রথমেই সেই নির্যাতিতাকে প্রমাণ করার চেষ্টা করবে যে সে চরিত্রহীন। তারপর হুমকি-ধমকি। তারপর এলাকা ছাড়া। তারপর সাক্ষীদের কেনাবেচা। কিনতে না পারলে হুমকি। তারপর সাক্ষীর অভাবে বেকসুর খালাস।

যদিও নারী নির্যাতন দমন আইনে বিচার প্রক্রিয়া শেষ করার নির্দিষ্ট সময় বেধে দেওয়া আছে তারপরও এ মামলা শেষ হতে সময় লাগে বছরের পর বছর। কারণ আইনের ফাঁক। তদন্ত ঠিক সময় সম্পন্ন না করতে পারলে যথাযথ কারণ দেখিয়ে তদন্তের সময় বাড়ানো যায়। যথাযথ কারণের তো কোনো অভাব নেই। তারপর সাক্ষীরা সময়মতো হাজির হয় না। সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে সাক্ষ্য দেওয়া থেকে বিরত করলে সময়তো পার হবেই। তারপর ভিআইপি মামলার তাড়া। সর্বোপরি বিচারক সংকট। আমাদের এক বিচারককেই একই দিনে বিভিন্ন ধরনের মামলা পরিচালনা করতে হয়। ফলে মামলা জটের কারণেও বিশেষ মামলাগুলো বিচার করতে দেরি হয়। এভাবেই একটি ধর্ষণ মামলার বিচার হতে দীর্ঘ সময় পার হয়ে যায়।

নারী নির্যাতন বন্ধে শুধু আইন করলেই হবে না, প্রয়োজন আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ। দ্রম্নত বিচার নিষ্পত্তির মাধ্যমে দোষী ব্যক্তির সাজা নিশ্চিত করার মাধ্যমে নারী নির্যাতন কমানো সম্ভব। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীকে তার মানবিক মর্যাদা, অধিকার প্রদানের মাধ্যমে সমাজে নারীর অবস্থান পুরুষের সমান করার মাধ্যমেই নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করা সম্ভব।

সমাজ নারীকে নারী হিসেবে না দেখে মানুষ হিসেবে যতদিন না দেখবে ততদিন নারীর মুক্তি নেই। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হলেই সম্ভব নারীমুক্তি, সম্ভব নারী নির্যাতন বন্ধ করা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে