সুঁই-সুতায় স্বপ্ন বোনেন ইলোরা

প্রকাশ | ৩০ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০ | আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২০, ১৫:৩০

মো. ফখরুল ইসলাম
ইলোরার হাতে সুঁই-সুতায় তৈরি বঙ্গবন্ধু পরিবারের ছবি

সুঁইয়ের ফোঁড়ে রঙ-বেরঙের সুতার নকশা কাপড়ে ফুটিয়ে তোলার ঐতিহ্য হাজার বছরের। সুঁই আর সুতার ছন্দময় গতিতে খুব সাধারণ জমিন অনায়াসেই হয়ে ওঠে অনন্য। কিন্তু এ সুঁই-সুতারই নিপুণ গাঁথুনিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের সদস্যসহ বিশ্ববরেণ্যদের দৃষ্টিনন্দন ছবি তৈরি করে এরই মধ্যে মানুষের নজর কেড়েছেন নড়াইলের মেয়ে ইলোরা পারভীন। রঙতুলি কিংবা দামি রেজুলেশনের ক্যামেরার পরিবর্তে তার আলপনাতেই সত্যিকার অর্থে জীবন্ত মানুষের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। স্বামী, সংসার ও মেয়েসহ পরিবারের সব কাজ সামলে সূচি-শিল্পী হিসেবে নিজেকে আলাদাভাবে পরিচিত করে চলেছেন তিনি। বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের বাড়ি নড়াইলের মাছিমদিয়া গ্রামে জন্ম ইলোরার। বাবা মরহুম আলহাজ হাবিবুর রহমান ছিলেন এসএম সুলতানের বাল্যবন্ধু। শৈশবকাল থেকে ইলোরার ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহ ছিল। সঙ্গত কারণেই তিনি এসএম সুলতানের অনুপ্রেরণায় ছবি আঁকার প্রতি ঝুঁকে পড়েন। এসএম সুলতানের সঙ্গে কাজ করা দুলাল চন্দ্র সাহা ছিলেন ইলোরার সেলাইয়ের গুরু। তিনিই বিভিন্ন পোর্ট্রেট সুঁই-সুতা দিয়ে ফুটিয়ে তোলার পরামর্শ এবং হাতে-কলমে শিখিয়ে দেন। সেই থেকেই তিনি চিত্রশিল্পের জগতে নতুন কিছু সৃষ্টির স্বপ্ন দেখতে থাকেন। ২০ বছরের সাধনায় তিনি তার লালিত স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করে সবাইকে অবাক করে দিয়েছেন। একটি বইয়ের কভারের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি দেখে দেখে ১৯৯৮ সালে সুঁই-সুতা দিয়ে বুননের মাধ্যমে ছবি আঁকার পথে হাঁটতে শুরু করেন। এক অসম্ভব বাস্তবতায় সুঁই-সুতা দিয়ে সেলাইয়ের মাধ্যমে অবিকলরূপে বঙ্গবন্ধুর ছবিটি জীবন্ত করে তৈরির সফলতায় তার স্বপ্নকে এগিয়ে নিতে শুরু করেন। ছবিটি পরিবারের লোকজন আত্মীয়স্বজনসহ সবার প্রশংসা কুড়ালে তার উৎসাহ শতগুণে বেড়ে যায়। রাজধানীর আজিমপুরের একটি সরকারি কোয়ার্টারের বাইরের ঘরের দেয়ালজুড়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের সদস্যদের ছবি। এ ছাড়া মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, মাদার তেরেসা, এসএম সুলতান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সাবিনা ইয়াসমীন, রুনা লায়লা, মাশরাফি বিন মুর্তজাকে দেখতে দেখতে মনে হবে ঘরে কে নেই? শুধু এ গুণীরাই নন, দেয়ালেই রয়েছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ দলিলে সই করছেন লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি ও লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। সবকিছু একদম জীবন্ত। ছবিগুলো কোনো ফটোগ্রাফারের ক্যামেরায় তোলা ছবি নয়, এগুলো সেলাইশিল্পী ইলোরা পারভীনের সেলাইকর্ম। সুঁই-সুতা দিয়েই ফুটিয়ে তুলেছেন সব অবয়ব। সেলাইশিল্পী ইলোরা পারভীন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একক ১৩টি ছবি সুঁই-সুতা দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একক সাতটি, বঙ্গবন্ধুর আরেক কন্যা শেখ রেহানার একটি, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি, মা-বাবার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু, মুজিববর্ষের লোগো তিনটি, বঙ্গবন্ধু পরিবারের একটি সাত ফুট লম্বা ছবিসহ মোট ৩৯টি মূল ছবিকে সুঁই-সুতায় ফুটিয়ে তুলেছেন এ শিল্পী। বঙ্গবন্ধু পরিবারের ছোট সদস্য শেখ রাসেলও বাদ যায়নি। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলাপ হয় ইলোরা পারভীনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ২০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি সেলাই করছেন। এ পর্যন্ত ৬০ জনের বেশি গুণীর পোর্ট্রেট বা অবয়বসহ অন্যান্য চিত্রকর্ম তৈরি করেছেন। আর এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের ছবি, মুজিব শতবর্ষের লোগোসহ মোট ৩৯টি শিল্পকর্ম তৈরি করেছেন। কাজটি ইলোরা পারভীন ভালোবেসেই করেন। তাই বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে নিয়ে করা শিল্পকর্মের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ইলোরা আক্ষেপ করে বললেন, সেলাই শুরু করার আগে একটি স্পষ্ট এবং সুন্দর ছবি সামনে রেখে কাজ করতে হয়। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সবার ছবি পাওয়াটাই কঠিন হয়ে যায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইলোরা পারভীনের সূচিকর্মের তিনটি ছবি কিনেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিনে হাসুমণির পাঠশালা জাতীয় জাদুঘরে ইলোরার সূচিকর্ম নিয়ে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করে। দৃক গ্যালারিতেও তার সূচিকর্মের একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইলোরা পারভীন বলেন, 'আমি বর্তমান সরকারকে খুশি করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কাজ করি না। সরকার বদলের সময়ও আমার কাজ থেমে থাকেনি। শুধু সরকারকে খুশি করতে চাইলে আমি মহাত্মা গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, মাদার তেরেসা, এসএম সুলতান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে অন্য বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করতাম না, শুধু বঙ্গবন্ধু বা তার পরিবার নিয়েই কাজ করতাম। আমার যা ভালো লাগে, তাই সুঁই-সুতায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করে, তাই তাকে নিয়ে কাজের সংখ্যা বেশি।' প্রচারবিমুখ ইলোরা পারভীন সাত ভাই-বোনের মধ্যে পঞ্চম। ১৯৯৮ সালে ইডেন মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে দর্শন বিষয়ে এমএ পাস করেন তিনি। ১৯৯৯ সালে তিনি কালিয়া উপজেলার খড়রিয়া গ্রামের মো. ফয়জুলস্নাহ বিশ্বাসের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। পারিবারিক জীবনে দুই কন্যাসন্তানের জননী ইলোরা। ইলোরা জানান, প্রথম প্রথম একেকটি সেলাই শেষ করতে সাত থেকে আট মাস সময় লেগে যেত। এখন সময়টা কমে এসেছে। একেকটি সেলাইয়ের শুরু থেকে শেষে বাঁধাই করা পর্যন্ত চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা লেগে যায়। ইলোরার স্বামী শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফয়জুলস্নাহ বিশ্বাস ইলোরার সেলাইকর্মে সার্বিকভাবে সহায়তা করেন। ইলোরা বলেন, 'বঙ্গবন্ধুর ছবি দিয়ে আমার শিল্পকর্মের হাতেখড়ি। আমি চারুকলার ছাত্রী নই। যে ছবিগুলো আঁকছি তা আমার শখ আর সাধনা দিয়েই সম্ভব হয়েছে। সবার সহযোগিতা পেলে একদিন বিশ্বকে জয় করতে পারবেন বলে তার প্রত্যাশা।' ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে জানতে চাইলে এ শিল্পী বলেন, শিল্পকলা একাডেমিতে বিভিন্ন শিল্পকর্মের ওপর আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করছি। দেখা যাক কী হয়।