নারীদের করোনাকাল

প্রকাশ | ৩০ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

জাকিয়া সুলতানা
বর্তমান সময়ে মহামারি করোনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারীরা। কারণ তাকে পরিবারের সবার স্বাস্থ্যের কথা সর্বক্ষণ মাথায় রাখতে হয়। তাই তার নিজের কথা ভাবার আর সময় কোথায়? চাকরিজীবী বা গৃহিণী এমন কোনো মা নেই যে এ চাপ থেকে রেহাই পান। যখন একজন মা এমনিতেই সন্তানের কথা ভেবে সারাক্ষণ বিচলিত থাকেন, সেখানে করোনার মতো মহামারি এসে একজন মায়ের মনকে শতগুণ বিচলিত করে তুলছে। এমন পরিস্থিতিতে কর্মজীবী কয়েকজন মায়ের সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে জানা গেল তাদের উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠার কথা। রোনাক চৌধুরী- ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তার। যার দশ বছরের নিচে দুটি সন্তান আছে। তিনি বলেন, গত মার্চে করোনা যখন বাংলাদেশের মানুষকে আক্রান্ত করল তখন হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়লাম বাচ্চাদের কথা ভেবে। কারণ হাসপাতালে আমাকে যেতেই হবে। যেহেতু আমরা দুজনেই ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তার তাই আমাদের প্রধান দায়িত্ব হলো রোগীর সেবা দেওয়া। সে ক্ষেত্রে কেমন করে সুস্থ থাকব নিজে এবং কেমন করে বাচ্চাদের সুস্থ রাখব। মনে হলো যেন হঠাৎ আমাদের জীবনে চলে এলো এক অমানিশার ঝড়। সেই ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে গেল সব পরিকল্পনা। এমন অজানা-অচেনা অদৃশ্য দানবের সঙ্গে লড়াই করতে হবে তা ছিল চিন্তারও অতীত। এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেল মৃতু্যর মিছিল। আজ পরিচিত একজন মারা গেল তো কালকে আরেকজন। চারদিক থেকে আসতে লাগল দুঃসংবাদের পর দুঃসংবাদ। আপনজনদের সঙ্গে যোগাযোগ শুধু ফোনে। কারও বাসায় যাওয়া হয় না। মানসিক প্রশান্তি বলতে কিছু নেই, শুধু বেঁচে থাকার অদম্য লড়াই। যেন চেনা পৃথিবীটা মুহূর্তেই অচেনা হয়ে গেল। কেউ কাউকে দেখলে আবেগে আগের মতো আর জড়িয়ে ধরে না। কথা বলে দূরে দাঁড়িয়ে! রুবিনা হায়দার- ব্যাংকে কর্মরত এক মা। তার একটাই কথা, প্রতিদিন ঘর থেকে বের হতে হয় এমন চিন্তা নিয়ে যে, সুস্থভাবে ফিরব তো বাসায়? বাসায় তার ৭০ বছরের শাশুড়ি এবং দুটি যমজ সন্তান। তিনি বলেন, আছি মহাদুশ্চিন্তায়। কারণ আমার একটি মেয়ের জ্বর এলে দেখা যায় কিছুক্ষণ পরে অন্য মেয়েটিও আক্রান্ত হয়ে গেল। একদিকে চাকরি অন্যদিকে সংসার সারাক্ষণ একটা বাড়তি চাপে থাকতে হয়। তার ওপর করোনার চাপে যেন অস্থির হয়ে গেলাম। সামান্য সর্দি-জ্বর বা কাশিও অস্থির করে তোলে আমাকে। যেটা আমাদের দেশের সিজোনাল রোগ হিসেবেই পরিচিত। যা সামান্য ওষুধ বা এমনিতেই সেরে যেত। এখন আর তা নিয়ে কেউ অবহেলা করে না। এখন সেই অসুখের নাম মরণঘাতী করোনা। কিন্তু ডাক্তারের চিকিৎসা পাওয়াও যেন দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে। তারা ঠিকমতো চেম্বারে বসেন না। অজুহাত সরকার তাদের জীবন রক্ষাকারী প্রটেকশন দিচ্ছে না। ব্যাপারটা আরও জটিল হলো যখন পর পর কয়েকজন ডাক্তার মারা গেলেন। আবার রোগীরও ভয় যদি ডাক্তারের চেম্বারে করোনা রোগী থাকে। তাই দমবন্ধ করা এক অবস্থা। সকালে ঘুম থেকে জেগে বাচ্চাদের গরম পানি-লেবুর রস খাইয়ে আবার ফ্ল্যাক্সে গরম পানি রেখে অফিসে যেতে হয়। খাওয়া-দাওয়া মেনে চলতে হয় বাড়তি যত্ন। প্রতিদিন টাটকা শাক-সবজি ফলমূল খাওয়াতে হবে। কিন্তু অফিস সামলিয়ে এমন বাড়তি চাপে যেন দম বের হয়ে যাওয়ার অবস্থা। এ তো গেল এক শ্রেণির উচ্চবিত্তের কথা। কিন্তু ভাবছি স্বল্পআয়ের মানুষের কথা। ওরা কেমন করে এমন বাড়তি চাপ নিচ্ছে। আমেনা আক্তার গৃহিণী। যার সংসারে আয় কমে গেছে অর্ধেক। স্বামী একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। কিন্তু করোনার অজুহাতে বেতন অর্ধেক হয়ে গেছে। আটকে গেছে বাড়ি ভাড়া। পুরো বেতনেই চলা মুশকিল হতো। এখন অর্ধেক বেতনে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। কারণ স্কুল এবং কলেজ পড়ুয়া তার দুই সন্তান রয়েছে। এখন তার নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। তাই এমন পরিবারের মায়েরা আছেন ভীষণ কষ্টে। কারণ সংসারটা তাকেই সামলাতে হয়। অর্ধেক বেতন এনে স্বামী হাতে দিচ্ছেন। যা দিয়ে তাকে সংসার চলানো কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। তাই তিনি বাধ্য হয়েই অন্য কাজের চেষ্টায় ছিলেন। ভালো কিছু ড্রেস উঠিয়ে যদি বিক্রি করা যায়। কিন্তু দেখা গেল, সবাই এখন হিসাব-নিকাশ করেই পা বাড়াচ্ছে। আগের মতো আর কেউ এখন কাপড় কেনে না। ভবিষ্যতের চিন্তায় সবাই অস্থির। এ তো গেল সমাজের উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্তের কথা। যারা মানুষের বাসায় ঝিয়ের কাজ বা ছোট-খাটো কাজ করে সংসার চালাতো আজ তারা সম্পূর্ণ বেকার। কারণ বিত্তবানরা তাদের জীবনের ঝুঁকির কথা ভেবে পরিবারের কাজের লোকদের দিয়েছেন অনির্দিষ্টকালের ছুটি। যারা গ্রামে গিয়ে সারাদিনে একবেলা খেতে পাচ্ছে না। আর যারা রাস্তায় পিঠা বা চা বিক্রি করে সংসার চালাতো তাদের ব্যবসাও বন্ধ। কারণ এখন আর মানুষ আগের মতো রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা-পান খাচ্ছেন না জীবনের ঝুঁকির কথা ভেবে। এখন আসি হতদরিদ্রের কথায়। যাদের চাল-চুলো বলতে কিছুই নেই। রাস্তায় থাকা রাস্তায় ঘুমানো। অনাহারে-অর্ধাহারে ওদের চলছে দিন। যেনতেনভাবে বেঁচে থাকা ওদের। স্বাস্থ্য সচেতনতা বলতে নেই কিছু। ওদের বেশির ভাগেরই পিতার ঠিকানা নেই। ভরসা শুধু মায়ের ওপর। কোনো রকমে মা খাবার জোগাড় করে শুধু বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা। আসছে শীত, ওদের যদি আলস্নাহতায়ালা নিজ হাতে রক্ষা করেন হয়তো রক্ষা পাবে। কিন্তু মা তার স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবার ফুসরতটুকুও পাচ্ছেন না। পরিশেষে বলব, সমাজের কোনো শ্রেণির মা আজ ভালো নেই। তাই পরিবারের আপনজনরা যত্ন নেবে মায়ের। মা সুস্থ থাকলেই পরিবারটি সুস্থ থাকবে- এটা বুঝতে হবে সবাইকে।