শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
শ্রদ্ধাঞ্জলি

সময়ের সাহসী সারথী আয়শা খানম

আয়েশা খানম বিশ্বাস করতেন, পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ক্রমাগত নারীকে পিছিয়ে থাকতে বাধ্য করে। নারীকে পেছন থেকে টেনে না ধরলে সে নিজ দক্ষতায় সব জায়গায় তার পদচারণা নিশ্চিত করতে পারে। বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থান এবং মহান মুক্তিযুদ্ধসহ স্বাধীন বাংলাদেশের সব প্রগতিশীল আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠক ছিলেন তিনি। আয়েশা খানম মনে করতেন, ''২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হয়, তবে পারিবারিক সচেতনতা বাড়াতে হবে ও দূর করতে হবে দরিদ্রতা। এর পাশাপাশি কিশোরীদের নিরাপত্তাহীনতাও দূর করতে হবে। এই নিরাপত্তাহীনতা গ্রামে এখনো অনেক বেশি। যদিও স্কুলে যাওয়া কিশোরীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
নন্দিনী ডেস্ক
  ০৪ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

নারীর অধিকার আদায়ে আয়শা খানমের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। তিনি ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি অধিকারবঞ্চিত নারীদের অধিকার আদায়ে সর্বদা নিয়োজিত ছিলেন। আয়েশা খানম বিশ্বাস করতেন, পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ক্রমাগত নারীকে পিছিয়ে থাকতে বাধ্য করে। নারীকে পেছন থেকে টেনে না ধরলে সে নিজ দক্ষতায় সব জায়গায় তার পদচারণা নিশ্চিত করতে পারে। বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থান এবং মহান মুক্তিযুদ্ধসহ স্বাধীন বাংলাদেশের সব প্রগতিশীল আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠক ছিলেন তিনি। ১৯৪৭ সালের ১৮ অক্টোবর আয়েশা খানম নেত্রকোনা ও দুর্গাপুরের মাঝামাঝিতে অবস্থিত গাবড়াগাতি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম গোলাম আলী খান এবং মা জামাতুন্নেসা খানম। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে তিনি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন। এছাড়া রোকেয়া হলের সাধারণ সম্পাদক ও সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৬২ সালে বিতর্কিত হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার মধ্যদিয়ে রাজনীতিতে পা রাখেন আয়শা খানম। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্র ইউনিয়নের সহসভাপতি হিসেবে স্বাধীনতার পক্ষে ঢাকায় শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করার কাজ করেন নিরলসভাবে। তিনি ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ডামি রাইফেল হাতে ঢাকায় নারী শিক্ষার্থীদের মিছিলের যে ছবি আলোচিত হয় তাতে আয়েশা খানম ছিলেন।

একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব ছাত্র নেতা মুক্তিসংগ্রামকে ত্বরান্বিত করতে নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন তাদেরই একজন আয়েশা খানম। তিনি আগরতলায় গিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। তিনি সেখানে কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ক্রাফটস হোস্টেলে ওঠেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে যারা ভারতে আসতেন, তাদের এক অংশের সাময়িক আবাসস্থল ছিল ক্রাফটস হোস্টেল। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থী শিবিরগুলোতে সশরীরে উপস্থিত হয়ে যোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখা, প্রণোদনা দান এবং শরণার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগাতে কাজ করেন আয়েশা খানম এবং তার সহকর্মীরা। তিনি আগরতলায় প্রাথমিক একটা প্রশিক্ষণ নেন চিকিৎসাসেবার ওপর। এরপর আগরতলার প্রতিটি ক্যাম্পে গিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সহায়তা দিতে আত্মনিয়োগ করেন নিজেকে। তিনি মনে করতেন, এটি দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য কাজ করা।

তিনি স্বাধীনতার পর নিজেকে প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যুক্ত করেন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের নির্যাতনের শিকার নারীদের পুনর্বাসন এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় কাজ করেন। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি বঞ্চিত, নিপীড়িত নারীদের অধিকার আদায়ে কাজ করে গেছেন।

১৯৭২ সালে তিনি মহিলা পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। ২০০৮ সাল থেকে তিনি সংগঠনটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

২০০২ সাল থেকে ৬৮টি সংগঠনের পস্নাটফর্ম সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির সেক্রেটারিয়েটের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ, আইন সংস্কার আন্দোলন, সিডও বাস্তবায়নসহ নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। বৈশ্বিক নারী আন্দোলনেও ছিল তার শক্ত অবস্থান। ১৯৯২ সালে ভিয়েনার মানবাধিকার সম্মেলন এবং ১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ের বিশ্ব নারী সম্মেলনে তিনি অংশ নেন। এছাড়া ২০১১ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত সিডও কমিটির এবং কমিশন অন দ্য স্ট্যাটাস অব উইমেনের বিভিন্ন অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেছেন।

আয়শা খানম আমৃতু্য বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। নারীর অধিকার আদায়ে তার ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয়। দীর্ঘ নারীবাদী লড়াইয়ে তিনি ছিলেন অগ্রণী। সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন প্রশ্নে তিনি ছিলেন সোচ্চার।

কিংবদন্তি এ নেত্রীর ৩ জানুয়ারি ভোরে মৃতু্য হয়। মৃতু্যকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। তিনি ক্যান্সারে ভুগছিলেন। তার মরদেহ যথাযোগ্য মর্যাদায় নেত্রকোনায় নিজ গ্রামে সমাধিস্থ করা হয়েছে। নারী আন্দোলনের এক অকৃত্রিম অভিভাবককে হারালো বাংলাদেশ। তার মৃতু্যতে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ৭ দিনের শোক ঘোষণা করেছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে