দাসত্বের নয় শৃঙ্খলমুক্তির ইতিহাস

দেশের সমাজ বাস্তবতায় যেসব সামাজিক অপরাধ ক্রমেই নারীকে অনিরাপদ করে চলেছে তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে 'ধর্ষণ-গণধর্ষণ'। নারী নির্যাতনের সবচেয়ে বর্বর রূপ এটি। নারী আজ বাংলাদেশের কোথাও নিরাপদ নয়। গ্রাম থেকে নগর, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস, আদালত, থানা, গণপরিবহণ, লঞ্চ-ঘাট, বাস-ট্রেন স্টেশন, খেলার মাঠ, এমনকি গৃহাভ্যন্তরেও নারী নিরাপদ নয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে রাষ্ট্রের কাছেও নারী প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা পাচ্ছেন না।

প্রকাশ | ০৪ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

সুতপা বেদজ্ঞ
দেশের সমাজ বাস্তবতায় যেসব সামাজিক অপরাধ ক্রমেই নারীকে অনিরাপদ করে চলেছে তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অপরাধ হচ্ছে 'ধর্ষণ-গণধর্ষণ'। নারী নির্যাতনের সবচেয়ে বর্বর রূপ হচ্ছে এই 'ধর্ষণ-গণধর্ষণ'। নারী আজ বাংলাদেশের কোথাও নিরাপদ নয়। গ্রাম থেকে নগর, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস, আদালত, থানা, গণপরিবহণ, লঞ্চ-ঘাট, বাস-ট্রেন স্টেশন, খেলার মাঠ, এমনকি গৃহাভ্যন্তরেও নারী নিরাপদ নয়। রাষ্ট্রের কাছেও নারী নিরাপদ বোধ করতে পারছে না। ধর্ষণসহ নারীর ওপর অন্যান্য সহিংসতা আসলে নারীর অধস্তন তারই বহিঃপ্রকাশ। পুঁজিবাদ-পুরুষতান্ত্রিকতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি নানাভাবে এ সহিংসতাকে অনুমোদন ও বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে। 'পাঁচ হাজার বছরের শ্রেণিবিভক্ত সমাজ পুরুষ প্রাধান্যের যে অর্থনীতি-রাজনীতি-সংস্কৃতি নির্মাণ করেছে এবং সেই ভিত্তিতে নারীর শ্রমের মূল্যায়ন না করে নারী-পুরুষের যে অসম-সামাজিক ওফবহঃরঃু প্রচলিত আছে- সেটা নারীকে শুধু শোষিত-বঞ্চিতই করে না, তার ওপর যৌন সহিংস আচরণের ভিত্তিও তৈরি করে দেয়।' তাই কোনো নারীর ওপর এই সহিংসতাকে শুধুমাত্র একক কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে নয়, তাকে দেখতে হবে সমাজ ও রাষ্ট্রের চরিত্রের মধ্যে, তার সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভিত্তির মধ্যে। প্রত্যেকটি নারী নির্যাতনকে তার সুনির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে যেমন দেখতে হবে, তেমনি তার সাধারণ ভিত্তি খুঁজতে হবে বাংলাদেশের বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রের লুটেরা অর্থনীতি, দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি এবং পশ্চাদপদ সংস্কৃতির মধ্যে। বাংলাদেশে বর্তমান পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্র ও সমাজ নারীকে সহজে ঘায়েল করার কৌশল হিসেবে সমাজের মধ্যে এক ধরনের এসেন্স ছড়িয়ে দেয়। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হওয়া কিছু বিষয়কে কারণে-অকারণে সামনে এনে নারীকে সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রবণতা কিছুতেই যেন কমছে না। পুরুষ ও ক্ষমতাবানদের মনস্তত্ত্বে এমন হিংসাত্মক মনোভাব প্রথিত হয়েছে যে সংখ্যালঘু দমন, জমি দখল, নারীদের পথে-ঘাটে চলাচল বন্ধ, আদিবাসীদের আবাস থেকে উৎখাত, প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান, বখাটেপনা সব ক্ষেত্রেই নারীকে ধর্ষণ ও নির্যাতনের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। এমনকি নারীর প্রতি সহিংসতা এমনভাবে বাংলাদেশের লুটেরা পুঁজিবাদী সংস্কৃতি ও রাজনীতির অংশ হয়ে উঠেছে যা প্রতিটি স্তরে নারী নির্যাতনকে বৈধতা প্রদান করছে। অনেকেই নারীর পোশাককে যৌন সহিংসতার একটি কারণ হিসেবে উলেস্নখ করেন। বাস্তবতার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। যখন একজন মাদ্রাসার ছাত্রী, কন্যাশিশু ও প্রতিবন্ধী নারী ধর্ষিতা হয় তখন পোশাকের যুক্তি তার ভিত্তি হারিয়ে ফেলে। এদেশে শাসনব্যবস্থায় যারাই এসেছে তাদেরই আশ্রয়-প্রশ্রয় ও আনুকূল্যে অপরাধীরা, ধর্ষকরা সমাজে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারাই এ অবস্থার জন্য দায়ী। আমাদের দেশের নারীরা এখন শিক্ষাকে যে মাত্রায় গুরুত্ব দেয় চাকরি বা আয়-রোজগার করাকে সে মাত্রায় গুরুত্ব দেয় না। যেসব নারী আয়-উপার্জন করে অনেক ক্ষেত্রে নিজের উপার্জনেও তাদের অধিকার থাকে না। সমাজে নারীদের প্রতি রয়েছে পক্ষপাতমূলক সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। নারী সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা অবস্থাকে আরও জটিল করে তুলেছে। একজন নারী ধর্ষিত হলে আগে জানতে চাওয়া হয় তার পোশাক কেমন ছিল। এরপর সে কোন সম্প্রদায়ের-হিন্দু-মুসলিম না আদিবাসী। ধর্ষণ পরবর্তী সামাজিক ও আইনি হয়রানি আরও ভয়ঙ্কর। যিনি ধর্ষণের শিকার হন ঘটনার বিবরণ দিতে তাকে কয়েকবার মানসিক ধর্ষণের শিকার হতে হয়। সামাজিক হেনস্তা চলে সারাজীবন। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের (ইনএনএফপি) অর্থায়নে আইসিসিডিআরবি ২০১১ সালে একটি জরিপ চালায়। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৪০ শতাংশ পুরুষ বলেছেন তাদের বয়স ১৯ বছর হওয়ার আগে তারা নারী ধর্ষণ করেছেন। ৫৭-৬৭ শতাংশ পুরুষ বলেছেন, শুধু মজা করার জন্যই নারীদের যৌন হয়রানি করেছেন। ৪৩ থেকে ৫১ শতাংশ পুরুষ জানিয়েছেন, নারীদের যৌন হয়রানি করার পর তাদের কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়নি। এ চিত্র গত নয় বছরে একটুও পাল্টেনি বরং আরও বিপজ্জনক আকার ধারণ করেছে। সমাজের মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কোন পর্যায়ে গেলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয় তা সহজেই অনুমেয়। সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা আমাদের কী বার্তা দেয়! এসব ঘটনার পরিণতি কী! নারী ও কন্যাশিশুরা কোথায় নিরাপদ! নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো যে বার্তাই দিক না কেন তার চেয়েও অধিক আতঙ্কিত হওয়ার বিষয় হলো- এসব অন্যায়-অমানবিক-মধ্যযুগীয়-বর্বরোচিত অধিকাংশ ঘটনারই সঠিক তদন্ত ও বিচার তো হয়ই না বরং অপরাধীরা সদর্পে দাপিয়ে বেড়ায় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায়। কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে আনতে নানা বিধি নিধেষ আরোপ করায় সহিংসতা থেকে মুক্তির সেবাগুলো সঙ্কুচিত হয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়েছে অপরাধীরা। বিচারব্যবস্থা ও অন্যান্য সামাজিক কাঠামো সক্রিয় না থাকায় অবস্থা আরও নাজুক হয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী এদেশের মেয়েদের ওপর নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেসব ঘটনার মর্মস্পর্শী বিবরণ পাঠে এখনো শিউরে উঠতে হয়। আমরা তাদের ধিক্কার জানাই। ইতিহাস তাদের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছে। এখন স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে দেশে নারীদের ওপর যা ঘটছে তা যদি ইতিহাসে লেখা থাকে তাহলে কী হবে তার উত্তর। আমরা কী কোনোভাবে এর দায় এড়াতে পারব। প্রতি বছর নারী ধর্ষণ-নির্যাতন-হত্যা-আত্মহত্যার পরিসংখ্যান দীর্ঘ হচ্ছে। এ লজ্জা আমরা কোথায় রাখব? অবস্থার পরিবর্তন এত সহজ নয়। আশার দিক হলো, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতনতা ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। বর্তমানে সমাজের বিবেকসম্পন্ন মানুষ ও সংগঠন ক্রমেই উপলব্ধি করছে যে নারী নির্যাতনের প্রভাব কেবল নির্যাতিতার ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনেই সীমাবদ্ধ থাকে না, সামগ্রিকভাবে তার সামাজিক-রাজনৈতিক কুফলও মারাত্মক। বহু মানুষ উপলব্ধি করতে শুরু করেছে ধর্ষণ প্রতিরোধ ছাড়া কোনো পরিবারই এ থেকে রেহাই পাবে না। নারীমুক্তিসহ মানুষকে সবধরনের শোষণ-ৈ বৈষম্য-বঞ্চনা-নির্যাতন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণ আমাদের মূল কর্তব্য হলেও, যৌন সহিংসতার বর্তমান প্রেক্ষাপটে অর্জনযোগ্য আমাদের কিছু আশু দাবি ও কর্তব্য রয়েছে। সমাজে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে সচেতনতা ও প্রতিরোধ গড়ে উঠছে তাকে আরও সংগঠিত ও প্রসারিত করে নারী-পুরুষের সম্মিলিত আন্দোলনের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদের এখনই বাস্তবায়নের জন্য কিছু জরুরি দাবি তুলতে হবে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, সব ধর্ষণ মামলা দ্রম্নত বিচারের আওতায় এনে নিষ্পত্তি করতে হবে। সব প্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতন বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হবে। রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে গণতন্ত্র আনতে হবে, রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে গণতন্ত্রায়নের লক্ষ্যে সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর কার্যকর ক্ষমতায়ন করতে হবে। সময়ের বাঁকে বাঁকে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। ইতিহাসের নানা অর্জনে যে ইতিহাস রচিত হয়েছে তা পুরুষের গল্পে ঠাসা। পৃথিবীতে এখনো পর্যন্ত নারীদের যে ইতিহাস লেখা হয়েছে তা গৌণ, অক্রিয়; ইতিবাচক অর্থে ধরলে নারীকে দেখানো হয়েছে সর্বংসহা আশ্রয়দাত্রী হিসেবে। নারীর বিরুদ্ধে যতই প্রচার প্রচারণা থাকুক না কেন এ কথাও ঠিক বাস্তবের অনেক অনুষঙ্গই নারীকে পুরুষতন্ত্র ও পুঁজিবাদের যুগল চাপ থেকে মুক্তির প্রেরণা জোগাচ্ছে। তাই বাংলাদেশে ধর্ষণসহ নারী নিপীড়নের যে ক্রমবর্ধমান ভয়াবহতা, তার কাছে প্রতিরোধহীন অসহায় আত্মসমর্পণ নয়। সময়টাকে এখন সাহসের সঙ্গে দৃঢ়তার সাথে কাজে লাগাতে হবে। লাখ লাখ নারীকে ঘরের বাইরে এসে প্রগতিশীল পুরুষের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে, নারীমুক্তির সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে। নারীকে নিজের ইতিহাস রচনায় নিজেকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। নারীর ইতিহাস সেদিন সত্য ভাষণে প্রকাশিত হবে, দাসত্বের ইতিহাস নয় বরং এ ইতিহাস হবে সংগ্রাম করে শৃঙ্খলমুক্তির ইতিহাস।