শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
শ্র দ্ধা ঞ্জ লি

রাবেয়া খাতুন প্রেরণা সঞ্চারী লেখক ও নারীর প্রতিকৃতি

রাবেয়া খাতুনের সাংবাদিকতা জীবন থেকে শুরু করে লেখক জীবন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভূমিকা রাখা, অসংখ্য পুরস্কার লাভ, অগণিত দেশ ভ্রমণ ইত্যাদি, তার এক কর্মচঞ্চল ও অনুকরণীয় জীবনের প্রতিভাস, যা থেকে উত্তর প্রজন্মের যে কেউ অনুপ্রেরণা, শক্তি ও সাহস পেতে পারেন
গোলাম কিবরিয়া পিনু
  ১১ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

রাবেয়া খাতুন এমন একজন লেখক, যার বিপুল ও বহুমুখী সাহিত্যের দিকে চোখ রাখলে আমরা অবাক হই, কৌতূহল জাগে, বিস্ময়াভূত হই। ক্লান্তিহীন ও ধারাবাহিকভাবে তিনি সৃষ্টি-সাধানায় মগ্ন থেকে এক তুলনারহিত উদাহরণ হয়ে আছেন।

তার মৃতু্য হলো ৩ জানুয়ারি ২০২১ সালে। জন্মেছিলেন ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর, তৎকালীন ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে মামার বাড়ি পাউসন্নে। পিতার বাড়ি শ্রীনগর থানার ষোলঘর গ্রামে। বাবা মৌলবি মোহাম্মদ মুলস্নুক চাঁদ, মা হামিদা খাতুন। বাবা ছিলেন সরকারি কর্মচারী আর দাদা ছিলেন শখের কবিরাজ।

রাবেয়া খাতুন ১২-১৩ বছর বয়স থেকেই লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম প্রগতিশীল সাপ্তাহিক 'যুগের দাবী'তে ছাপা হয় তার ছোটগল্প 'প্রশ্ন'। ১৯৬৩ সালের ১ জুলাই প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস 'মধুমতী'। লেখালেখি শুরু হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন- 'আমার লেখার হাতেখড়ি হয় উপন্যাস দিয়ে।' ঢাউস ঢাউস উপন্যাস (এখনো সংগ্রহে আছে কয়েকটা)। বাড়ির নিয়ম ছিল সপ্তাহে দুটো বায়োস্কোপ বা টকি সিনেমা দেখা। আমার কাহিনী তৈরি হতো সম্ভবত সেই মালমশলায়। ভেতরে আমারই আঁকা ক্যাপশন থাকত। প্রথমটার নাম ছিল 'নিরাশ্রয়া', পরে 'বিদায়', 'অশোক-বেরা' এ ধরনের আর কি? মা দুটো ব্যাপারে ভীষণ রেগে যেতেন। প্রায়ই তার কাছে ধরা পড়ে যেতাম পাঠ্যপুস্তকের তলায় গল্পের বই নিয়ে। কখনো গল্প লিখতে গিয়ে। সব মায়ের মতো তারও স্বপ্ন মেয়ে ক্লাসে ফার্স্ট হবে। আমাদের পড়াশোনা মূলত একটি ভালো বিয়ে দেওয়ার জন্যই করানো হতো। উঁচু গ্রেডে পাস দূরে থাক, আমি টায় টায় পাস করতাম। ছাত্রী হিসেবে মোটেই ভালো ছিলাম না। মা তার জন্য দায়ী করতেন বই পড়া ও গল্প শেখার নেশাকে।'

রাবেয়া খাতুন রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের সদস্য হওয়ায়, লেখাপড়ায় আগ্রহ থাকার পরও স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে যেতে পারেননি। সেই সময়কালে স্কুলেও মুসলমান ছাত্রীদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। মুসলমানদের সামাজিক অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মুসলমান মেয়েরা লেখাপড়ার জন্য স্কুলে প্রবেশ করতে পারেনি- সে সময়, উলেস্নখযোগ্যভাবে।

এক সময় শিক্ষকতা করেছেন। তিনি সাংবাদিকতাও করেছেন- ইত্তেফাক, সিনেমা ও খাওয়াতীন পত্রিকায়, এছাড়া পঞ্চাশ দশকে বের হতো তার সম্পাদনায় 'অঙ্গনা' নামের একটি মহিলা মাসিক পত্রিকা। সাংবাদিকতায় আসা প্রসঙ্গে রাবেয়া খাতুন বলেন, 'আমি যখন সাংবাদিকতায় আসি তখন পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন হাতেগোনা কয়েকজন। ফজলুল হক, কাইয়ুম চৌধুরী, জহির রায়হান ও আমি। তোমরা এখন যেমন সাক্ষাৎকার নিতে আসো, আমিও সে সময় সাক্ষাৎকার নিতে যেতাম লায়লা আরজুমান্দ বানু, আব্বাসউদ্দিনের, এখনতো সময় অনেক পরিবর্তন হয়েছে মেয়েরা ইচ্ছে করলেই আসতে পারছে। কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে।'

রাবেয়া খাতুনের বিয়ে হয় ১৯৫২ সালের ২৩ জুলাই, স্বামী- এটিএম ফজলুল হক, তিনি সাংবাদিকতার পাশাপাশি চিত্রপরিচালকও ছিলেন। চার সন্তানের জননী রাবেয়া খাতুন। রাবেয়া খাতুন নিজের চেষ্টায় অনেকটা নিজের স্বাধীনতা নিয়ে শুধু বেড়ে ওঠেননি, তৎকালীন মুসলিম সমাজের একজন নারী হিসেবে অগ্রসরমান থেকে শিল্প-সাহিত্যের জগতে প্রবেশ করেছেন বেশ আগ্রহ সহকারে। তার বিয়েও হয়ে উঠেছে লেখালেখির ক্ষেত্রে পরিপূরক।

রাবেয়া খাতুনের ১০০-এর বেশি বই রয়েছে। তার প্রকাশিত গ্রন্থ-উপন্যাস : মধুমতী (১৯৬৩), অনন্ত অন্বেষা (১৯৬৭), মন এক শ্বেত কপোতী (১৯৬৭), রাজবিনো শালিমার বাগ (১৯৬৯), সাহেব বাজার (১৯৬৯), ফেরারী সূর্য (১৯৭৪), অনেক জনের একজন (১৯৭৫), জীবনের আর এক নাম (১৯৭৬), দিবস রজনী (১৯৮১), নীল নিশীথ (১৯৮৩), বায়ান্ন গলির এক গলি (১৯৮৪), মোহর আলী (১৯৮৫), হানিফের ঘোড়া ও নীল পাহাড়ের কাছাকাছি (১৯৮৫), সেই এক বসন্তে (১৯৮৬) ইত্যাদি। ছোটগল্প গ্রন্থ : আমার এগারটি গল্প (১৯৮৬), মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী (১৯৮৬), সুমন ও মিঠুর গল্প (১৯৭৮), লাল সবুজ পাথরের মানুষ (১৯৮১), তিতুমীরের বাঁশের কেলস্না (১৯৮৪) ইত্যাদি। 'একাত্তরের নয় মাস' ও 'স্বপ্নের শহর ঢাকা' নামের দুটি স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ রয়েছে তার। রাবেয়া খাতুন অনেক ভ্রমণ কাহিনী লিখেছেন, এগুলো হলো- হে বিদেশী ভোর, মোহময়ী ব্যাংকক, টেমস থেকে নায়েগ্রা, কুমারী মাটির দেশে, হিমালয় থেকে আরব সাগরে, কিছুদিনের কানাডা, চেন্নি ফোঁটার দিনে জাপানে, মমি উপত্যকা, ভূস্বর্গ সুইজারল্যান্ড ইত্যাদি। তার গবেষণাধর্মী লেখা- জীবন ও সাহিত্য, পাবনা মানসিক হাসপাতাল, স্মৃতির জ্যোতির্ময় আলোকে যাদের দেখেছি। এছাড়া তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেছেন। রাবেয়া খাতুনের উপন্যাস অবলম্বনে বেশ কটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, এসব চলচ্চিত্রের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য- কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি ও মেঘের পর মেঘ, এছাড়া তার কাহিনী নিয়ে ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম কিশোর চলচ্চিত্র তৈরি করা হয়। রেডিও ও টিভি থেকে প্রচারিত হয়েছে তার রচিত অসংখ্য নাটক।

রাবেয়া খাতুনের ছোটগল্প রচনার সংখ্যা এক হাজারের বেশি। বাংলা ভাষায় এক হাজারের অধিক ছোটগল্প লেখার রেকর্ড কম। শুধু সংখ্যায়

নয়, রাবেয়া খাতুন তার দীর্ঘ লেখকজীবনে এ গল্পগুলো যত্নসহযোগে লিখেছেন; গল্পে এসেছে- কত রকমের বিষয়, কত রকমের চরিত্র, কত রকমের জীবনের দ্বন্দ্ব ও বিভিন্ন সময়ের অভিঘাত।

রাবেয়া খাতুনের প্রতিভার সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় হচ্ছে উপন্যাসগুলো। রাবেয়া খাতুনের উপন্যাসসমূহ কয়েকটি বিভাগে শনাক্ত করা যায়। ইতিহাসনির্ভর কাহিনী প্রধান উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে- মধুমতি, প্রথম প্রকাশেই যে উপন্যাসটি বিশেষভাবে আলোচিত হয়। সাহেব বাজার, বায়ান্ন গলির এক গলি, শালিমার বাগ এসব উপন্যাসে উঠে এসেছে পুরানো ঢাকার বিচিত্র জীবনযাপন প্রণালি। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাসটিও রাবেয়া খাতুন রচনা করেন- ফেরারী সূর্য। এছাড়া, বাগানের নাম মালনীছাড়া, ঘাতক রাত্রি, মেঘের পর মেঘ--মুক্তিযুদ্ধের বিস্তৃত পটভূমিকায় লেখা তার উপন্যাস। আর প্রেমের উপন্যাসে নর-নারীর সম্পর্ক ও নানা টানাপড়েন তো আছে, আছে যৌনতা, আছে সে সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। প্রেমের উপন্যাস : মন এক শ্বেত কপোতী, সেই এক বসন্তে, রঙিন কাচের জানালা, কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি, শঙ্খ সকাল প্রকৃতি, সাকিন ও মায়াতরু, আকাশে এখনো অনেক রাত, সৌন্দর্য সংবাদ, ছায়া হরিণী, শুধু তোমার জন্য ইত্যাদি।

রাবেয়া খাতুন ভ্রমণ করেছেন বহুদেশ, এগুলো হলো- ইংল্যান্ড,

আমেরিকা, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, সুইডেন, জাপান, নেপাল, ভারত, সিকিম, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মিশর, দুবাই, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, তাসখন্দ, মরিশাস ও মালদ্বীপ। এছাড়া টরেন্টো ইউনিভার্সিটি বাংলা বিভাগের আমন্ত্রণে ঘুরে এসেছেন কানাডা।

তিনি শিল্প সাহিত্যের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বাংলা একডেমির কাউন্সিল মেম্বার, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের গঠনতন্ত্র পরিচালনা পরিষদের সদস্য, জাতীয় চলচ্চিত্র জুরি বোর্ডের বিচারক, শিশু একাডেমির কাউন্সিল মেম্বার ও টেলিভিশনের 'নতুন কুঁড়ির বিচারক' হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যুক্ত ছিলেন কয়েকটি সাহিত্য পুরস্কার সংস্থার সঙ্গে। তিনি মহিলা সমিতি, কথা শিল্পী সংসদ, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ, ঢাকা লেডিজ ক্লাব, বাংলাদেশ লেখক শিবিরসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।

কথাসাহিত্যিক ও লেখক হিসেবে রাবেয়া খাতুন বহু পুরস্কার অর্জন করেন, এসব পুরস্কার হচ্ছে- স্বাধীনতা পুরস্কার, বাংলা একডেমি পুরস্কার (১৯৭৩), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৯), একুশে পদক (১৯৯৩), নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯৫), জসীমউদ্দিন পুরস্কার (১৯৯৬), শেরে বাংলা পুরস্কার স্বর্ণপদক (১৯৯৬), শাপলা দোয়েল পুরস্কার (১৯৯৬), টেনাশিনাস পুরস্কার (১৯৯৭), ঋষিজ সাহিত্য পদক (১৯৯৮), অতীশ দীপঙ্কর পুরস্কার (১৯৯৮), লায়লা সামাদ পুরস্কার (১৯৯৯), অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৯), মিলেনিয়াম অ্যাওয়ার্ড (২০০০), টেলিভিশিন রিপোর্টার্স অ্যাওয়ার্ড (২০০১), বাংলাদেশ কালচারাল রিপোর্টার্স অ্যাওয়ার্ড (২০০২), শেলটক পদক (২০০২), মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার (২০০৫) ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার (২০০৫)। ৬ রাবেয়া খাতুনের গল্প ইংরেজি, উর্দু, হিন্দি ও ইরানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

তার সময়ে মুসলিম নারী লেখকদের একেবারেই হাতেগোনা যায়। গল্প-উপন্যাসের মতো কঠিন সৃজনশীল কাজে তার সাধনা শুধু উলেস্নখযোগ্য নয়, তিনি একাকী সৃজনশীল কর্মকান্ডে আত্মমগ্ন হয়ে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে এক তুলনারহিত অভিযাত্রী হয়ে উঠেছেন। নারী লেখক হিসেবে তিনি কখনো বিচ্ছিন্ন ভূভাগে বিবেচিত হননি। তার লেখক জীবনের সূচনাপর্বে তার সহযাত্রী ছিলেন লেখক-শিল্পী শামসুদ্দীন আবুল কালাম, আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান, আহসান হাবীব, কাইয়ুম চৌধুরী, মির্জা আবদুল হাই, সৈয়দ শামসুল হক, জহির রায়হান প্রমুখ।

রাবেয়া খাতুনের সাংবাদিকতা জীবন থেকে শুরু করে লেখক জীবন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভূমিকা রাখা, অসংখ্য পুরস্কার লাভ, অগণিত দেশ ভ্রমণ ইত্যাদি, তার এক কর্মচঞ্চল ও অনুকরণীয় জীবনের প্রতিভাস, যা থেকে উত্তর প্রজন্মের যে কেউ অনুপ্রেরণা, শক্তি ও সাহস পেতে পারেন, বিশেষত নারীরা। তিনি একজন প্রেরণা সঞ্চারী লেখক ও নারীর প্রতিকৃতি হিসেবে বিশেষভাবে বিবেচিত হবেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে