শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
উ দ্যো ক্তা র গ ল্প ক থা

কইন্যার জয়যাত্রা

২০১৪ সালে বন্ধু বাধনকে সঙ্গে নিয়ে 'দ্বৈত' নামে ফেসবুকে একটি পেজ খোলেন। মূলত দুইয়ে মিলে দ্বৈত, এরকম একটি ভাবনা থেকেই নামকরণটি। বিভিন্ন জায়গা থেকে কয়েন (মুদ্রা) সংগ্রহ করে বানানো শুরু করেন বিভিন্ন ধরনের জুয়েলারি পণ্য। স্বতন্ত্র ডিজাইনের কারণে খুব কম সময়ের মধ্যে ক্রেতার নজর কাড়তে সক্ষম হয় দ্বৈত। জুয়েলারির পাশাপাশি মাঝেমধ্যে কিছু কুর্তি, কাপ্তান, পাঞ্জাবিসহ আরও কিছু পণ্য তৈরি করতে থাকেন
জাহিদুল ইসলাম জিন্নাহ্‌
  ১১ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০
আপডেট  : ১১ জানুয়ারি ২০২১, ১২:১৮
উদ্যোক্তা তাসমিনা নিশাত

পরিবারের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সন্তান। স্বভাবতই ছিলেন সবার চোখের মণি। বেড়ে উঠেছেন সবার আদর ও স্নেহে। পরিবারের তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবাই পেশা হিসেবে চাকরিকে বেছে নিলেও তিনি তথাকথিত গৎবাঁধা জীবনকে বেছে নিতে চাননি। বাকি সবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই স্বতন্ত্র ব্যক্তি চেতনায় বিশ্বাসী তিনি নিজের মতো করে কিছু করতে চেয়েছেন সবসময়ই। সেই করতে চাওয়ার অদম্য মনোবল তাকে আজ দিয়েছে সম্পূর্ণ নিজস্ব এক পরিচয়। কথা বলছি অনলাইনভিত্তিক শপিং পস্নাটফর্ম 'কইন্যা'র স্বত্বাধিকারী তাসমিনা নিশাতকে নিয়ে। শুরুটা হয়েছিল বলতে গেলে হঠাৎ করেই। তাসমিনা নিশাত তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভাগের সহপাঠী ও বন্ধু আল মাহমুদ বাধনের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে হঠাৎ করেই মাথায় আসে নতুন করে নিজেদের মতো কিছু একটা করার। সেই চিন্তা থেকেই দুজনের সিদ্ধান্তে এক হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে চলে যান ঢাকার ইসলামপুরে। সেখান থেকে শাড়ি তৈরির জন্য কিনে আনেন কাপড়, লেইসসহ আনুষঙ্গিক আরও বেশকিছু জিনিস। কেনা তো হলো এবার বানাবেন কোথায়? কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেরই এক টেইলারের সঙ্গে। সেই টেইলার তাদের সময় দেন ভোর ৫ থেকে ৬টা। নতুন কিছু করার অদম্য এক ইচ্ছাশক্তিই পরদিন ভোর সাড়ে ৫টায় তাকে নিয়ে যায় সেই টেইলারিংয়ের দোকানে। সেখানে আরও ২০০ টাকা মজুরি দিয়ে নিজে বসে থেকে নির্দেশনা দিয়ে বানিয়ে ফেলেন নিজের ডিজাইনমতো একটা শাড়ি। শাড়িটি বানিয়ে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। পরিচিত এক বড় ভাইয়ের পছন্দ হয়ে যাওয়ায় তার সহধর্মিণীর জন্য শাড়িটি কিনে নেন তিনি। সেই বিক্রির টাকা দিয়েই বানিয়ে ফেলেন আরও দুটি শাড়ি, সেখান থেকে পাঁচটি। সেই থেকে শুরু, তারপরে আর কখনো পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। এর কিছু দিন পরে সেই বছরই, মানে ২০১৪ সালে বন্ধু বাধনকে সঙ্গে নিয়ে 'দ্বৈত' নামে ফেসবুকে একটি পেজ খোলেন। মূলত দুইয়ে মিলে দ্বৈত, এরকম একটি ভাবনা থেকেই নামকরণটি। বিভিন্ন জায়গা থেকে কয়েন (মুদ্রা) সংগ্রহ করে বানানো শুরু করেন বিভিন্ন ধরনের জুয়েলারি পণ্য। স্বতন্ত্র ডিজাইনের কারণে খুব কম সময়ের মধ্যে ক্রেতার নজর কাড়তে সক্ষম হয় দ্বৈত। জুয়েলারির পাশাপাশি মাঝেমধ্যে কিছু কুর্তি, কাপ্তান, পাঞ্জাবিসহ আরও কিছু পণ্য তৈরি করতে থাকেন। শুরুর দিকে পরিচিত আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ক্রেতা হলেও একটা সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনলাইনে অর্ডার আসা শুরু হয়। কাজের পরিধিও বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে। সবকিছু ভালোভাবেই এগোচ্ছিল। হঠাৎ করেই একটা ছন্দপতন হয়। সময়টা ২০১৫, মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ ততদিনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছেড়ে দিয়ে তাসমিনা নিশাত চলে এসেছেন ঢাকায় নিজের বাসায়। বন্ধু বাধন রয়ে গেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই ইসলামনগরে। কাজের ক্ষেত্রে দূরত্ব ও সময় একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু দমে যাওয়ার জন্য যে শুরুটা করেননি তারা। দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নেন তাঁতে বোনা শাড়ি নিয়ে কাজ শুরু করবেন। এরকম একটি ভাবনা থেকেই যাত্রা শুরু হয় 'কইন্যা'র। মূলত প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে নিজেদের মতো করে পণ্যকে উপস্থাপন করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন নিশাত। একটু ভিন্ন ডিজাইন ও আঙ্গিকে শাড়ি তৈরি করা শুরু করেন। আর ঠিক পথেই যে এগিয়ে যাচ্ছিলেন ক্রেতাদের মন্তব্য শুনে তা ঠিক বুঝতেও পারছিলেন। কাজের ক্ষেত্রে বরাবরই লোকজ মোটিফকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন নিশাত। লোকজ মোটিফের ডিজাইনে বস্নক, স্ক্রিন প্রিন্ট, হ্যান্ড পেইন্টের মাধ্যমে একেকটি শাড়ি ও পণ্যকে ফুটিয়ে তোলেন নিখুঁতভাবে। সেই সঙ্গে গুরুত্ব দেন ক্রেতার সন্তুষ্টির দিকে। নানান চড়াই-উতরাই পেরিয়ে নিশাত এতদিনে এটা বুঝতে পেরেছেন, ব্যবসায় দিনশেষে ক্রেতাই সব। কাজেই ক্রেতার ভালো লাগা, মন্দ লাগাকে সবার আগে প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করেন। আর এ কারণেই খুব দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে 'কইন্যা' আজ মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছে। কইন্যার ফেসবুক পেজে এ প্রতিবেদনটি লেখার সময় পর্যন্ত তিন লাখ দশ হাজার লাইকের মাইলফলক স্পর্শ করেছে। ব্যবসার ক্ষেত্রে আরও একটি বিষয়কে গুরুত্ব দেন নিশাত ও বাধন। ব্যবসা করে শুধু নিজেদের উন্নতি নয় সেই সঙ্গে ব্যবসার উৎপাদন ও আনুষঙ্গিক কাজের সঙ্গে জড়িত সব কর্মীর উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছেন তারা। জোর দিয়েছেন কর্মসংস্থান তৈরিতে। ২০১৭ সালে কইন্যা তাদের নিজেদের কারখানায় কাজ শুরু করে। সেখানে প্রত্যক্ষভাবে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় দশজন মানুষের। এর বাইরে প্রায় দশজন তাঁতির কর্মসংস্থান হয়েছে বিভিন্ন অঞ্চলে। একই সঙ্গে ২০২০ সালের ৭ ফেব্রম্নয়ারি কইন্যা ধানমন্ডি ২৭-এর জেনেটিক প্লাজা ২১৭ নাম্বার দোকানে শুরু করে নিজস্ব শোরুমের যাত্রা। সেখানেও কর্মসংস্থান হয়েছে কিছু মানুষের। এ করোনা মহামারির সংকটকালে কইন্যা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে তাদের কর্মীদের সার্বিক দেখভালের। নিশাত ও বাধন বিশ্বাস করে শুধু নিজেরা নয়, বরং সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার মধ্যেই জীবনের প্রকৃত সার্থকতা নিহিত। তাসমিনা নিশাত ২২ নভেম্বর ঢাকাতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মো. মহসিন ভূইয়া পেশায় ছিলেন একজন ব্যবসায়ী, বর্তমানে অবসরে রয়েছেন। মা জেবুন্নেসা বেগম একজন গৃহিণী। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তাসমিনা নিশাত সর্বকনিষ্ঠ। ব্যক্তিজীবনে তার দুই বোন ও এক ভাই সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। যেই বন্ধু ও সহপাঠী আল মাহমুদ বাধনকে নিয়ে নিশাত তার উদ্যোক্তা জীবন শুরু করেছিলেন, তার সঙ্গেই ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সংসারজীবন শুরু করেন। সংসারজীবনে রাইদ ফাইজান নির্বাণ নামে একটি পুত্র সন্তানের জননী তিনি। কর্মক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের পাশাপাশি সবসময় মানবিক আবেগ ও মূল্যবোধকে প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করেন তাসমিনা নিশাত। আর এই ক্ষেত্রে বরাবরই সহযোগিতা পেয়েছেন মা ও জীবনসঙ্গী আল মাহমুদ বাধনের। কইন্যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন আরও বহুদূর যাওয়ার। কইন্যার ফেসবুক পেজের লিংক িি.ভধপবনড়ড়শ.পড়স/শড়রহুধ.পড়স.নফ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে