চিরসবুজ মহানায়িকা সুচিত্রা সেন

প্রকাশ | ১৮ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

সালমা আক্তার
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কলকাতা, ঢাকার বাঙালি সমাজে আভিজাত্য এবং ফ্যাশন সচেতনতার প্রতীক মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। সময়ের থেকে এগিয়ে ছিলেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেন, যার বাঁকা ঠোঁটের হাসি এখনো মন কেড়ে নেয় বাঙালি দর্শকের। সুচিত্রা ঘাড় ঘুরে তাকালে যেন সময়ও একটু করে থমকে যায়। পর্দায় সুচিত্রার চোখ টলমল করে উঠলে ছলছল হয়ে ওঠে পর্দার বাইরে দর্শকের চোখও। তার মুগ্ধতাকে আকণ্ঠ গ্রহণ করেছে দর্শকসমাজ। সুচিত্রা এক চিরসবুজ প্রেয়সী, যার বয়স ওই পর্দার ছবিতেই আজও স্থির হয়ে আছেন। ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল, করুণাময় ও ইন্দিরা দাশগুপ্তের সংসারে আলো ছড়াতে আসে ছোট্ট সদস্য, মেজো মেয়ে কৃষ্ণা। গায়ের রঙ ছিল একটু চাপা, তাই প্রথমে ঠাকুরদাদা মেয়ের নাম রাখলেন কৃষ্ণা। কিন্তু মা করুণাময় মেয়ের নাম রাখলেন, 'রমা'। পাটনা থেকে বদলি হয়ে বাংলাদেশের পাবনায় চলে আসেন রমার বাবা-মা। পাবনাতেই কাটে শৈশব-কৈশোর। ১৯৪৭ সাল। সতেরো বছর বয়সে ফ্রক ছেড়ে কেবলই শাড়ি পরতে শুরু করেছেন, ঠিক তখনই বিয়ের পিঁড়িতে বসল রমা মানে সুচিত্রা। স্বামী শিল্পপতি দিবানাথ সেন। বিয়ের পরে 'নটীর পূজা' নাটকে প্রথম অভিনয় করলেন এবং সেই খ্যাতি পৌঁছলো টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়ায়। স্বামী ও শ্বশুরের উৎসাহেই সিনেমায় নামলেন রমা সেন। স্টুডিওতে প্রথমে গিয়েছিলেন নেপথ্য গায়িকা হওয়ার জন্য, কিন্তু মোহময় সেই রূপসীকে পর্দার পেছনে রাখার মতো ভুল করেননি রুপালি পর্দার লোকেরা। রমা সহসা রাজি না হলেও, পরে স্বামী দিবানাথ সেনের অনুরোধ রাখেন। ১৯৫২ সাল, প্রথম ছবি 'শেষ কোথায়'। কিন্তু কিছুদিন অভিনয়ের পর অর্থাভাবে তা বন্ধ হয়ে গেলে আর কখনো মুক্তি পেল না সিনেমাটি। এরপর সুকুমার দাশগুপ্তর 'সাত নম্বর কয়েদি' সিনেমা থেকে চলচ্চিত্রে নিয়মিত হলেন রমা। এসময় সুকুমার দাশগুপ্তর সহকারী নীতিশ রায় তার নাম দিলেন সুচিত্রা। এর পরে নীরেন লাহিড়ীর 'কাজরী' ছবির মাধ্যমে 'সুচিত্রা সেন' নামে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। নিজস্ব চলন-বলন আর স্টাইলে যেন ক্রমেই অনুকরণীয় হয়ে উঠেছিল সুচিত্রা সেন। তার শাড়ি পরা বা চুল বাঁধার স্টাইল ছিল তখনকার আধুনিক মেয়েদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। তার অভিনীত বাংলা সিনেমা ৫২টি আর হিন্দি সিনেমা মোট ৭টি। বাংলা সিনেমার পাশাপাশি হিন্দি চলচ্চিত্রের পর্দাও কাঁপিয়েছেন তিনি। চরিত্রের সীমাবদ্ধতাতেও আটকে থাকেননি মহানায়িকা। নিজেকে চ্যালেঞ্জ করেছেন বারবার। যখনই যে চরিত্রে পর্দায় এসেছেন, চোখ আটকে যাওয়ার মতন কিছু একটা সবসময়ই থাকত তার মধ্যে। সেটা ভক্তিরসে টইটম্বুর 'ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চেতন্য'তে বিষ্ণুপ্রিয়া কিংবা 'সপ্তপদী'তে আধুনিকা 'রিনা ব্রাউন'ই হোন- সুচিত্রার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি কখনো, সুচিত্রার মোহনীয় রূপ কমেনি একবিন্দু। হিন্দি চলচ্চিত্রে তার ক্যারিয়ার সম্পর্কে বলতে গেলে সামনে আসে দুটি নাম- 'দেবদাস' ও 'আন্ধি'। স্বপ্নের চরিত্র 'পার্বতী' হয়ে দিলীপ কুমারের বিপরীতে তার অভিনয় দিয়ে মুগ্ধতা ছড়িয়েছিলেন সুচিত্রা। গুলজারের পরিচালনায় তার অভিনয় ক্যারিয়ারের শেষ দিকে আসে 'আন্ধি'। এ ছবিতে তার বিপরীতে ছিলেন সঞ্জীব কুমার। সুচিত্রা সেনের নামের সঙ্গে যে নামটি স্মৃতির পর্দায় ভেসে ওঠে, তিনি মহানায়ক উত্তম কুমার। উত্তম-সুচিত্রার পর্দার রসায়ন কার না মন কেড়েছে! ১৯৫৪ সালের ২৬ জুন থেকে শুরু করে বহু সিনেমায় একসঙ্গে আবির্ভূত হলেও, ১৯৫৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বর পরিচালক অগ্রদূতের 'অগ্নিপরীক্ষা' সিনেমাটিতেই তাদের জুটি সাফল্য পায় প্রথম। টানা ১৫ সপ্তাহ হলে চলেছিল এ সিনেমা। রুপালি পর্দার পাশাপাশি ব্যক্তিজীবনেও খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিল তাদের মধ্য। উত্তম কুমারের মৃতু্য সুচিত্রার মনোজগতে এক আলোড়ন তুলেছিল। ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই হঠাৎ মারা গেলেন উত্তম কুমার। গভীর রাতে সবাই যখন প্রিয় নায়ককে শেষ বিদায় জানিয়ে ঘরে ফিরে এসেছে, তখন নিভৃতে দেখা করতে গেলেন সুচিত্রা। ভবানীপুরে উত্তম কুমারের পৈতৃক বাড়িতে গিয়ে ছবিতে মালা পরিয়ে শেষ সাক্ষাৎটুকু করলেন। কেউ কেউ উত্তমের মৃতু্যকেও সুচিত্রার অন্তরালের কারণ বলে দাবি করলেও তিনি পুরোপুরি লোকচক্ষুর আড়ালে যান তার দীক্ষাগুরুর মৃতু্যর পর। শোনা যায়, মহান পরিচালক সত্যজিৎ রায় একবার সুচিত্রাকে তার 'দেবী চৌধুরানী' চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন, কিন্তু তারিখের সঙ্গে মিলছিল না বলে সুচিত্রা সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি কোথায় অভিনয় করবেন, কোন ব্যানারে তার নাম আসবে, তা শুধু তিনিই নির্ধারণ করতেন। তার সময়ে সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক নিতেন তিনি। 'সপ্তপদী' সিনেমাটির কথাই ধরা যাক, তাতে সুচিত্রা সেনের পারিশ্রমিক ছিল দুই লাখ টাকা, যা সে সময়ের যে কোনো অভিনেতার চেয়ে বেশি। ১৯৬৩ সালে 'সাত পাকে বাঁধা' চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সুচিত্রা সেন 'সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস' জয় করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি কোনো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী সম্মান প্রদান করে। ২০০৫ সালে তাকে 'দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার' দেওয়ার কথা উঠলেও তিনি এ পুরস্কার গ্রহণ করতে আরও একবার পেছনে ফেলে আসা ওই চাকচিক্যের দুনিয়ায় পা ফেলতে চাননি। তিনি পুরস্কারটি ঘরে পাঠিয়ে দিতে বলেছিলেন এবং পুরস্কারটি তিনি আর পাননি। ২০১৩ সালে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ার পর আবার আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠেন একসময়ের পর্দা কাঁপানো এ অভিনেত্রী। ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি সকালে কলকাতার বেল ভিউ হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সুচিত্রা সেনের মৃতু্য হয়।