পোশাকশিল্পে নারীর শ্রম শোষণ

প্রকাশ | ১৮ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

মৈত্রী ঘোষ
বিশ্বজুড়ে সর্বোচ্চ উচ্চারিত শব্দের নাম কোভিড-১৯। চীনের উহান শহর থেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া আতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস। এই মহামারি বিভিন্ন দেশের বর্ডার পার করে মার্চ মাসে বঙ্গদেশের সীমানায় বসায় ভয়ানক মহামারির থাবা। মানুষ এ মরণব্যাধির ভয়ে জর্জরিত হয়ে একমাত্র ভরসা হিসেবে খুঁজে নেয় নিজের ঘর। বিশ্বের অনেক দেশ এ ভাইরাসের থাবায় 'লকডাউন'' জারি করে নিরাপত্তা বিধানের চেষ্টা করছে। কোনো ওষুধ বা নির্দিষ্ট চিকিৎসাপদ্ধতি জানা নেই কারও কিন্তু শুধু সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা সাবান, স্যানিটাইজার মাস্ক ব্যবহার করে নিরাপদ থাকার চেষ্টা, আর কোনোভাবে এ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে অনিবার্য মৃতু্য। শুরু হলো বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে স্বরূপ দর্শন। হুহু করে দাম বাড়লো মাস্কসহ সব সম্ভাব্য করোনা প্রতিরোধ সামগ্রীর। চাকরি, ব্যবসা ও গণপরিবহণসহ সব বন্ধ, ঘর থেকে বের হওয়াই নিষেধ। এসব বাতাস গায়ে না লাগার একদল মানুষ তখনো নির্বিবাদে চাকা ঘুরিয়ে চলছিলেন-অর্থনীতির। বর্তমানে গার্মেন্টশিল্প কৃষি ক্ষেত্রকে ছাড়িয়ে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। আর সেই গার্মেন্টশিল্পের মূল চালিকাশক্তির প্রায় ৮০ শতাংশই নারী শ্রমিক। গার্মেন্টশিল্প আমাদের অর্থনীতিতে নিঃসন্দেহে একটি অন্যতম উৎস। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আমাদের দেশ গার্মেন্টশিল্পে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। যে শিল্প দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম পদ। সেই শিল্পের মূল চালিকাশক্তিই আবার নারী শ্রমিক। তাও তারা সংখ্যায় নগণ্য নয়। বরং প্রায় ৮০ ভাগ। বাইরে থেকে মনে হতে পারে নারীদের এ শিল্প অগ্রগণ্য করা হচ্ছে, সুযোগ-সুবিধা এবং সম্মানে তারা সমুন্নত। কিন্তু বাস্তব অবস্থায় এমন যে সম্মান তো দুরূহ বেঁচে থাকার নূ্যনতম প্রয়োজনগুলো পূরণ হয় না। এ শ্রমিকের নেই সামান্য নিরাপত্তা, হোক সেটা স্বাস্থ্য ঝুঁকির নিরাপত্তা, অথবা নারী হিসেবে তার সম্ভ্রম, সম্মান রক্ষার নিরাপত্তা। বাংলাদেশে বর্তমানে নারীর প্রতি যে বৈরিতামূলক আচরণ চলছে তার অন্যতম কারণ অর্থনীতি। আর নারী শ্রমিকের দুর্দশার কারণ হচ্ছে শ্রম শোষণ। অভাব অনটনে জর্জরিত নারীরা গার্মেন্টশিল্পে নিয়োজিত হয় তার জীবন-জীবিকার রক্ষার তাগিদে। সামাজিকভাবেই নারী অবমূল্যায়নের স্বীকার বলে এ ক্ষেত্রেও নারীর শ্রমবাজার সস্তা। বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকের যে মজুরি তা জীবনধারণের জন্য অপ্রতুল। শিল্প বিকাশের নামে প্রতিনিয়ত চলছে শ্রমিক নির্যাতন। আর সঙ্গে জড়িত সহস্র শ্রমিকের রক্ত ও জীবনের অগ্নিদগ্ধ চিত্র। মালিকের এ নির্মমতা আরও নগ্ন ও নির্মম হয় নারী শ্রমিকের বেলায়। দেশের প্রচলিত শ্রম আইনে শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে যাই কিছু বলা হয়ে থাকুক না কেন সেই সুযোগ লাভের পরিবেশ বাংলাদেশের গার্মেন্টশিল্পে বর্তমান নয়। মাতৃত্বকালীন নিজ বেতনে ছুটির বিধান থাকলেও যখন কারখানা কর্তৃপক্ষ জানতে পারেন যে, কোনো নারী শ্রমিক অন্তঃসত্ত্বা সুকৌশলে তাকে চাকরিচু্যত করা হয়। তাই নারী শ্রমিকের পক্ষে ছুটি দাবি করা তো দুরস্ত বরং যতদিন সম্ভব গর্ভধারণের সত্যতা গোপন করে কাজ চালিয়ে যেতে হয়। ওভারটাইম বিনা পারিশ্রমিকে অথবা অর্ধপারিশ্রমিকে চলছে নির্বিচারে। গার্মেন্টশিল্প শ্রমিকদের এগুলো নিত্য সংকট অথবা এটাই স্বাভাবিক জীবন বলে তাদের কাছে বিবেচিত হয়। কিন্তু এই করোনা মাহামারির নতুন দুর্যোগের সঙ্গে মোকাবিলা করতে তারা অভ্যস্ত নয়। এটা শুধু অসুখ নয় বরং মরণব্যাধি। বিগত মার্চে যখন করোনা মহামারির বিশ্বগ্রাসী আক্রমণে সবাই দিশাহারা তখনো আমাদের দেশের গার্মেন্টশিল্প চলমান। শ্রমিকরা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন অব্যাহত রেখেছেন। সরকার সারাদেশের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলেও গার্মেন্টশিল্প শ্রমিকরা এর আওতাভুক্ত হয়নি। পরে শ্রমিক সংগঠনগুলো, চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবী বিশিষ্ট জনের মতামত ও আন্দোলনের চাপে অনির্দিষ্টকালের জন্য বেতন-ভাতা ছাড়াই ঘোষণা করা হলো সব গার্মেন্ট শ্রমিকদের ছুটি। এবার দলে দলে শ্রমিক ভাই-বোনেরা ছুটলেন নিজের গ্রামে। বেতন-ভাতা কিছুই নেই কিন্তু তখন রোগের ভয়টাই সবচেয়ে বেশি। করোনাভাইরাস পিছু নিল শ্রমিক ভাইদের দেশজুড়ে সংক্রমণ আরও ব্যাপক-ভয়াবহ হলো। মালিকরা যখন শ্রমিকদের ছুটি মঞ্জুর করলেন তখন সারাদেশের গণপরিবহণ বন্ধ। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হেঁটে, রিকশা, ভ্যান গাড়ি, ট্রাক ও মাছের ড্রামে লুকিয়ে যে যেভাবে পেরেছেন পাড়ি দিয়েছেন বাড়ির পথ। অসংখ্য শিল্প শ্রমিক পরিণিত হয়েছে রিকশা শ্রমিক দিনমজুরে, কারও কারও উপার্জনের পথ ভিক্ষা। এখানেই শেষ নয়- সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই জারি হলো নতুন আদেশ, আবার খুলে দেওয়া হবে কলকারখানা। আবার হেঁটে লাখ লাখ মানুষ ঢাকার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন পথ। গ্রামের বাড়িতে ঋণ করে সংসার চালিয়ে গাড়ি ভাড়ার জন্য টাকা নিয়ে পাড়ি জমালেন ঢাকায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গার্মেন্ট শ্রমিক মা-বোনেরা সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়া বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে ভিড় করলেন। এবার নতুন সংকট কারখানায় যোগ না দিলে চাকরি থাকবে না, আর শহরের কোনো বাড়ির মালিক এই শ্রমিকদের বাসা-ভাড়া দিতে রাজি নন। করোনায় রোজ মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, কোলে শিশুবাচ্চা নিয়ে শহরের বস্তিগুলোতে অথবা খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিতে হয় এ শ্রমিকদের। আবার এ সময় যদি কোনো শ্রমিকের জ্বর, সর্দিজনিত অসুখের চিহ্ন পাওয়া যায় তাহলে কারখানায় প্রবেশ নিষেধ। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার প্রাসঙ্গে ভাবাও বাহুল্য। তারপরই শ্রমিক সংগঠনগুলোর আন্দোলনের মুখে সরকার শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের উদ্দেশ্যে শিল্প মালিকদের ১% হারে নামমাত্র সুদে অর্থ সহযোগিতা দেন হাজার হাজার কোটি টাকা। কিন্তু শ্রমিকরা সেই অনুদানের অর্থ তো পায়ইনি বরং নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সারা মাস কাজ করেও তারা পান মূল বেতনের মাত্র ৬৫ ভাগ। এই করুন অবস্থায় সবচেয়ে বেশি অসহায়ত্বের স্বীকার হন নারী শ্রমিকরাই। এ মহামারিতে কাজের পাশাপাশি বেঁচে থাকার নূ্যনতম পরিবেশ, ন্যায্য বেতন আর সাক্ষ্য সুরক্ষার দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে সহস্র শ্রমিক ভাই-বোন। করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে, মৃতের সংখ্যাও প্রতিদিন রেকর্ড ভাঙছে। কিন্তু কোনো স্বাস্থ্য সুরক্ষা, চিকিৎসাব্যবস্থা শ্রমিকদের জন্য নেই। পরিস্থিতি এমন হয় অনাহারে মৃতু্য অথবা করোনায় আক্রান্ত হয়ে। এ সময় অসংখ্য শ্রমিক করোনার লক্ষ্য নিয়ে অসুস্থ হয়ে সেরে উঠছেন কেউ মৃতু্যবরণ করছেন। এর হিসাব কারও কাছে নেই। কিন্তু তাদের করোনা পরীক্ষা করে চিকিৎসা দেওয়ার উদ্যোগ মালিকপক্ষের নেই। এভাবেই করোনার বিরুদ্ধে প্রচন্ড যুদ্ধ করে যারা বেঁচে আছেন তারাই প্রতিনিয়ত ঘুরাচ্ছেন অর্থনীতির চাকা। সারাবিশ্বে যখন অর্থনৈতিক মন্দা তখন বাংলাদেশের সূচকে প্রবৃদ্ধি! এ প্রবৃদ্ধি শ্রমিকের রক্ত ঘামের সূচক। তবুও শিল্প মালিকরা বলতে চান করোনার অজুহাতে ব্যবসায়ে মন্দা চলছে। তাই এবার নতুন শ্রম শোষণের অস্ত্র হিসেবে চলছে শ্রমিকদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট না দেওয়ার অসাধু প্রচেষ্টা। আবার শ্রমিক রাজপথে নেমেছে, আবার বিজয় আসবে- এ যুদ্ধ শেষহীন।