বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
উ দ্যো ক্তা র গ ল্প ক থা

নন্দনকাননের নান্দনিকতা

কান্তা সরকার
  ১৮ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০
উদ্যোক্তা কান্তা সরকার

আমার জন্ম উত্তরবঙ্গের একটা অজপাড়াগাঁ মিঠাপুকুর উপজেলার কাফ্রিখাল গ্রামে। যেখানে বিদু্যৎই পৌঁছেছে বছর দুয়েক আগে। স্কুলের গন্ডি পেরোনো পর্যন্ত গ্রামেই বেড়ে উঠেছি, তারপর কলেজের জন্য জেলা শহর রংপুরে যাওয়া, উদ্ভিদবিজ্ঞান নিয়ে অনার্স রংপুরেই কারমাইকেল কলেজে। অনার্স শেষ করে মাস্টার্স ঢাকার ইডেন কলেজে। এরপর দেশের প্রথম সারির একটি আইটি কোম্পানিতে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগে কাজ করেছি বছর চারেক। সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২ বছরের একটা প্রফেশনাল মাস্টার্সও করে ফেলি মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার ওপর। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে আপনি পোশাক নিয়ে কাজ করা শুরু বা শিখলেন কীভাবে এর উত্তর দেওয়া সত্যি সত্যিই খুব কঠিন।

মধ্যবিত্ত পরিবারে প্রায় প্রত্যেক মেয়েই একটু বড় হলে মায়ের সেলাই মেশিনে হাত দেয় এক-আধটু, নিজের ফ্রকটায় তাই হয়তো একটু সুই-সুতো দিয়ে নকশা করে, এভাবেই এগুলো শিখেছি। প্রথম পোশাকে নকশার কাজ করেছি সম্ভবত সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় দাদির শাড়ির পাড় থেকে সুতো নিয়ে নিজের একটা ফ্রকে। কলেজ-ভার্সিটিতে পড়ার সময় ২০০২ সালের পরের কথা বলছি- চেষ্টা করেছি নিজের সব ড্রেস নিজেই ডিজাইন করার, কখনো হয়তো একটু রং দিয়ে আলপনা, আবার কখনো বা হয়তো সুতো দিয়ে একটু নকশা করা। আমাদের সময়ে নকশা করা ডিজাইনের ড্রেস সহজলভ্য না হওয়ায় মফস্বল শহরের প্রত্যেক মেয়েই কমবেশি এ কাজগুলো করত কিন্তু।

সূচিশিল্পের প্রতি সহজাত ওই আগ্রহ থেকেই এ বিষয়ে কাজ করেন এমন কয়েকজন তাঁতির সঙ্গে যোগাযোগ করি, খোঁজ-খবর রাখি, কাজ করতে গিয়ে তাদের ফেস করা সুবিধা-অসুবিধাগুলো বোঝার চেষ্টা করি। সেটাও আসলে এমনি এমনি, জানার আগ্রহ থেকেই, এ সেক্টরে কখনো কাজ করব এ ধরনের কোনো ভাবনা তখনো ছিল না। ২০১৫ সালের দিকে রাজশাহীতে একজনকে দিয়ে কিছু জামা করাই, ১৪ কি ১৫টা, সেগুলো বিক্রিও হয়ে যায় আমার বন্ধুদের মধ্যে, তারা পছন্দই করেছিল। এভাবে প্রায় অনেকদিন টুকটাক করে কাজ করতে থাকি এর-ওর জন্য, নিজের জন্য। এরমধ্যে 'নন্দনকানন' নামে ফেসবুকে একটা পেজও খুলে ফেলি। ২০১৬ সালের দিকে চাকরিটা ছেড়ে দিই, তারপর থেকেই আসলে পুরোদমে এটা নিয়ে ভাবতে থাকি, কাজ করতে থাকি নানাকিছু নিয়ে। মূলত মেয়েদের কুর্তি, শাড়ি, পালাজ্জো, ওড়না সর্বোপরি মেয়েদের সব পরিধেয় নিয়ে। সম্প্রতি বেডকাভার, শতরঞ্জি, টেবিলম্যাট, ব্যাগ, কুশনকাভার এগুলো নিয়েও কাজ শুরু করেছি। এছাড়া আমরা আমাদের দেশের বয়নশিল্পের সঙ্গে জড়িত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কিছু কাজও সংগ্রহ করে মূলধারায় যোগ করার চেষ্টা করছি। এই হলো মোটাদাগে আমাদের কর্মপরিধি। মোদ্দা কথা, একদিন দেশের সব কুটিরশিল্পকে নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখি আমিসহ পুরো নন্দনকানন টিম। সেই ভাবনাকে নিয়ে কাজও করছি আমরা। ডিজাইনিং, বস্নক, স্ক্রিনপ্রিন্ট, তাঁত, সূচির কাজ, অ্যাপিস্নকের কাজ, ডাই, দর্জি, ফটোগ্রাফি, প্রডাকশন, এমারজেন্সি প্রডাক্ট ডেলিভারি এরকম সব সেক্টর মিলে আমাদের সঙ্গে কাজ করে সারাদেশের প্রায় ৩০-৩২ জন যারা প্রত্যেকেই নন্দনকাননের সব ভালোমন্দ কাজের অংশীদার। আমাদের প্রডাক্ট সারাদেশেই ক্রেতার কাছে পৌঁছায় সুপরিচিত দুটি কুরিয়ারের মাধ্যমে।

আমার এই ভাবনার সঙ্গে সবচেয়ে পাশে থেকেছে আমার মামা ও ছোটভাই। গতানুগতিক ক্যারিয়ার এস্টাবলিশমেন্টের বাইরে গিয়ে নিজের পছন্দমতো ক্যারিয়ার গোছানোর যে সার্বিক চ্যালেঞ্জ, মামার সাপোর্ট না পেলে সেই কাজটা হয়তো এত আনন্দের সঙ্গে করে যেতে পারতাম না। আর আমার বাবা আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। বাবা বরাবর বলে আমি আমার মেয়ের পায়ের নিচের মাটিটা শক্ত দেখতে চাই। আব্বুকে অনেকদিন ভয়ে বলতে পারিনি চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে এসব কর্মযজ্ঞ নিয়ে পড়ে আছি। ওই যে মধ্যবিত্ত সামাজিক ট্যাবু। চারপাশের অনেককে, এমনকি বন্ধু-বান্ধবের মধ্যেও শুরুতে বলতেও শুনেছি 'চাকরি ছেড়ে হকারি করি', 'বাবা কলেজে পড়ায়, আর আমি এসব কি করি', এরকম নানা কথা। হয়তো মেয়ে বলে বেশি শুনেছি, এখনো শুনি। আজীবন ভালোর যে সংজ্ঞা শিখেছি, যা ভালো মনে করেছি, শ্রেফ মানুষের কথায় কখনোই সে পথ থেকে বিচু্যত হইনি। আমার কাজটা তাই আমি মন দিয়ে করে যাচ্ছি, অনেকটা ব্রতের মতো। আবার অনেক সিনিয়ার ভাই, আপা ভীষণ উৎসাহও দিয়েছেন, প্রশংসা করেছেন এগুলোর প্রত্যেকটাই আমার কাছে পাথেয়। তবে আব্বু যখন পেজে গিয়ে আমার কাজ দেখে আবার আমারই বন্ধুদের বলে ওর এসব দেখতে আনন্দই লাগে তখন সত্যিই মনে হয় এটাই আমার কাজের অন্যতম স্বীকৃতি। আর মা আমাদের দুই ভাই-বোনের মন থেকে করতে চাই এমন সব কাজের পূর্ণ সমর্থক। এভাবেই সবমিলিয়ে চলছে নন্দনকাননের যাত্রা। নন্দনকানন স্বপ্ন দেখে দেশের বুটিকশিল্পে মানসম্পন্ন কাজ দিয়ে ক্রেতাদের মনে জায়গা করে নেবে, একই সঙ্গে এদেশের প্রান্তিক মানুষকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করবে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখেছি, জেনেছি, বিশ্বাস করেছি- আমাদের চারপাশের সাধারণ মানুষই আসলে আমার দেশ। আমার দাদা, নানা, বাবা, বড় আব্বাদের দেখেছি চিরকাল দেশের সাধারণ মানুষের পাশে, সঙ্গে দাঁড়াতে। দাঁড়াতে হয়, এটাই তারা শিখিয়েছেন। করোনা মহামারির সময়, বন্যার সময় আমরা আমাদের কর্মীদের পাশে থেকেছি, দেশের অসহায় মানুষের পাশে আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী থাকার চেষ্টা করেছি সারাজীবন, এই একই মানসিকতা থেকেই নিজের জন্য, চারপাশের মানুষের জন্য সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু করতে চাই। আরও বড় কাজ করার জন্য নন্দনকাননের প্রাতিষ্ঠানিক রূপও আরও সব্লকরার চেষ্টা চলছে।

আমাদের এই ক'বছরের যাত্রায় নন্দনকাননের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ৬৫ হাজারের বেশি ফেসবুক পেজ ফলোয়ার। আমাদের পুরো টিমের পাশাপাশি এ ৬৫ হাজার জনও নন্দনকানন পরিবারের সদস্য, অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা প্রত্যাশা করি আমাদের এ পরিবার দিনকে দিন আরও বড় হবে, দেশের বুটিকশিল্পে মানুষ নন্দনকাননকে চিনবে, উৎকর্ষ বিবেচনায় আস্থা রাখবে, দেশজ পণ্যের প্রসারে, প্রান্তিক মানুষের জীবন উন্নয়নে নন্দনকানন কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখবে। আর একটা কথা আমরা সবসময় বলি এবং মানি- নন্দনকাননের প্রত্যেক ক্রেতাই আমাদের একেকজন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর, আপনাদের উৎসাহ আর ভালোবাসাই এগিয়ে নিয়ে যাবে নন্দনকাননকে।

নন্দনকাননের ফেইজ বুক লিংক :

যঃঃঢ়ং://িি.িভধপবনড়ড়শ.পড়স/হধহফড়হশধহড়হনফ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে