বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা

দূর অতীতেও দেশগঠনে নারীদের ভূমিকা ছিল, বর্তমানেও আছে। ১৯৫২'র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যতগুলো আন্দোলন হয়েছে প্রতিটি আন্দোলনে নারীদের বিশেষ অবদান রয়েছে। আর এ অবদান রেখেছেন শিক্ষিত নারীরাই। পৃথিবীতে শিক্ষিত নারীদের সফলতার দৃষ্টান্তও কম নয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, আয়ারল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে প্রভৃতি দেশের নারীরা সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, শান্তি, আন্তর্জাতিক রাজনীতিসহ নানা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। বেনজির ভুট্টো, ইন্দিরা গান্ধী, সোনিয়া গান্ধী, শ্রীমাভো বন্দরনায়েক, মাদার তেরেসা, মার্গারেট থ্যাচার, হিলারি ক্লিনটন, কন্ডোলিসা রাইস প্রমুখ বিদ্যাচর্চা ও ধী-শক্তির কারণে নারী হয়েও পৃথিবীব্যাপী পরিচিত।
শেখ এ কে এম জাকারিয়া
  ২৫ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

সমাজ বা দেশ গঠনে নারী-পুরুষ উভয়ের সমান দায়িত্ব রয়েছে। এ দায়িত্ব সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে হলে পুরুষের পাশাপাশি নারীকেও কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে, যা তাদের জীবন ও কার্যপ্রণালির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কবি নজরুল তার নারী কবিতায় লেখেন- 'বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।' কবিতার পঙ্‌ক্তিতে পরিষ্কার বোঝা যায় মানবকল্যাণে নারীর ভূমিকা কতটা জরুরি ও তাৎপর্যবহ। পৃথিবীকে আরও সুন্দর-অমলিন করতে নারী-পুরুষ এমনকি কোনো ব্যক্তি বা বিষয়ের মধ্যে ভেদাভেদ না করে সবার জন্য পাঠ অনুশীলন অর্থাৎ শিক্ষা অর্জন একান্ত প্রয়োজন। কোনো জাতিকে বিদ্বান হতে হলে সে জাতির নারীদেরও বিদ্বান হতে হবে। কারণ নারীদের বাদ দিয়ে একটি জাতি কখনো পূর্ণ হতে পারে না।

আমাদের দেশে নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে পাঠ অনুশীলনের প্রয়োজনীয়তা কোনো সময়ই সমানভাবে দেখা হয়নি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এখনো পুরুষের জন্য বিদ্যাচর্চার অনুকূল পরিস্থিতি ও দৃষ্টিভঙ্গি যতটুকু আছে নারীদের জন্য ততটুকু নেই। নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে রয়েছে নানারকম প্রতিবন্ধকতা। যে কারণে একই পরিবারে পুরুষদের শিক্ষা গ্রহণের সুবিধা থাকলেও নারীর ক্ষেত্রে সে সুবিধা তেমন নেই। দুঃখের কথা, আমাদের দেশে আজও অর্ধেকের বেশি নারীদের সংসারে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। নারীদের গৃহকোণে অবরুদ্ধ করে রাখার এ অভিসম্পাত জাতীয়জীবনে সৃষ্টি করছে নানা জটিলতা। অথচ উন্নত দেশে নারীদের অবস্থান আজ পুরুষের মতোই। এর মূল কারণ হচ্ছে উন্নত দেশগুলো নারীশিক্ষার ওপর জোর দিয়েছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে সেসব দেশে নর-নারীতে কোনো বৈষম্য নেই। আমেরিকার সংযুক্ত রাষ্ট্রগুলো, গ্রেট ব্রিটেন ও উত্তর আয়ারল্যান্ড, জাপান, জার্মান, কানাডা প্রভৃতি দেশের নারীরা সবক্ষেত্রে খুবই বিচক্ষণ। এসব দেশের নারীরা আজ আর পুরুষের সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং তারা অনেকক্ষেত্রে পুরুষকে ছাড়িয়েছে।

বর্তমানে নারীরা বাংলাদেশের মোট লোকসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। নারীদের শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত রেখে দেশ বা জাতির কখনো অগ্রগতি হতে পারে না। তাই জাতিকে সামনের দিকে যেতে হলে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও বিদ্বান করে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের সমাজে নারীর প্রধান পরিচয় সন্তান জন্মদান ও প্রতিপালনকারী জননী হলেও রাষ্ট্রসংক্রান্ত যেমন রাজনীতি, অর্থনীতি কিংবা ব্যবসার ক্ষেত্রে নারীরা আজ জরুরি ও তাৎপর্যবহ ভূমিকা রাখছে। পুরুষের সঙ্গে নারী কল-কারখানায়, অফিস-আদালতে, মাঠ-ঘাটে কাজ করছে। নারীরা এখন সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান ব্যক্তি এবং মন্ত্রিসভার সভাপতির দায়িত্বসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে। আর এ কারণেই নারীশিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।

আমাদের দেশে এ সময়ে শিক্ষিত মায়ের খুবই প্রয়োজন। একজন শিক্ষিত মা-ই তৈরি করতে পারেন একজন শিক্ষিত সন্তান। গড়ে তুলতে পারেন একেবারে নিজের আদর্শে। কেননা, সন্তানের ওপর মায়ের প্রভাবটাই বেশি পড়ে। মায়ের কাছ থেকে তারা সামাজিক রীতিনীতি, শিষ্টাচার ইত্যাদি শিখে থাকে। শিক্ষাক্ষেত্রে নারীদের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে মহাবীর নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন, 'আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।' আত্মনির্ভরতা অর্জনে নারীশিক্ষার তাৎপর্য অপরিসীম। অনাধুনিক যুগে নারীরা সবকিছুর জন্য তাদের স্বামীদের মুখাপেক্ষী ছিল। তারা সেসময় সমাজ-সংসারে উপেক্ষিত ও উৎপীড়িত ছিল। ঘরের ভেতরেই তাদের বিধেয় ও অবিধেয় সব কাজ সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এ সময়ের নারীরা শিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, পুলিশ অফিসারসহ অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করছে। নারীরা আজ পুরোপুরি আত্মনির্ভর। কাজেই নারীদের আর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার কোনো সুযোগ নেই। কমবেশি সবাই অবগত শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। ঘরকন্নার কাজেও নারীশিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। এদিকে পর্যবেক্ষণ করলেও দেখা যাবে, শিক্ষিত নারীরা সন্তানের অসুস্থতায় যেভাবে স্বাস্থ্য বিধান মেনে যত্ন-আত্তি ও সংসারের নিত্য-নৈমিত্তিক জমা-খরচের খুঁটিনাটি হিসাব করতে পারে, অক্ষরজ্ঞানহীন নারীরা সেভাবে তা করতে পারে না। একজন শিক্ষিত নারীর কাছে যদি কোনো সংসারের দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে সে সংসারের উন্নতি হবেই। তাই নারীদের পুরুষদের মতো শিক্ষিত করে তোলা অতি প্রয়োজনীয়।

দূর অতীতেও দেশগঠনে নারীদের ভূমিকা ছিল, বর্তমানেও তা আছে। ১৯৫২'র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যতগুলো আন্দোলন হয়েছে প্রতিটি আন্দোলনে নারীদের বিশেষ অবদান রয়েছে। আর এ অবদান রেখেছে শিক্ষিত নারীরাই। পৃথিবীতে শিক্ষিত নারীদের সফলতার দৃষ্টান্তও কম নয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, আয়ারল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে প্রভৃতি দেশের নারীরা সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, শান্তি, আন্তর্জাতিক রাজনীতিসহ নানাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বেনজির ভুট্টো, ইন্দিরা গান্ধী, সোনিয়া গান্ধী, শ্রীমাভো বন্দরনায়েক, মাদার তেরেসা, মার্গারেট থ্যাচার, হিলারি ক্লিনটন, কন্ডোলিৎসা রাইস প্রমুখ বিদ্যাচর্চা ও ধী-শক্তির কারণে নারী হয়েও পৃথিবীব্যাপী পরিচিত। এছাড়া আমাদের দেশের নারীরাও নানাক্ষেত্রে তাদের কর্মদক্ষতা দেখিয়েছেন। যেমন সুফিয়া কামাল, বেগম রোকেয়া, জাহানারা ইমাম, সেলিনা হোসেন প্রমুখ। অন্যদিকে রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

সাফল্যের চূড়ায় অবস্থান করছেন।

বর্তমানে দেশে নারীশিক্ষার মূল প্রতিবন্ধকতাই হচ্ছে কুসংস্কার। আরেকটি বড় বাধা হচ্ছে নিরাপত্তার অভাব। নিরাপত্তার অভাবে অনেক অভিভাবকই তাদের কন্যাসন্তানকে শিক্ষাঙ্গনে পাঠাতে ভয় পান। এই ভয়ের সঙ্গে যুক্ত আছে আর্থিক অনটন। আর্থিক অনটনের দুঃখদায়ক প্রভাব থেকে রাষ্ট্র বা সমাজের সাধারণ লোককে মুক্ত করতে না পারলে শুধু শিক্ষাই নয় দেশের সর্ববিষয়সংক্রান্ত উন্নয়ন কর্মপ্রণালি প্রণয়ন ভেস্তে যাবে। তার ওপর, দেশের অর্ধেকের বেশি নারীকে প্রতিষ্ঠানগত শিক্ষার দিকে নিয়ে আসার জন্য যে বৃহৎ উদ্যোগ ও প্রতিষ্ঠানসংক্রান্ত কাঠামো প্রয়োজন তা আমাদের নেই। এ পরিস্থিতিতে সব শ্রেণির মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন না হলে নারীশিক্ষার অগ্রগতি কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। তাই আমাদের দেশে নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য কিছুসংখ্যক কাজের তালিকা বা নির্ঘণ্ট গ্রহণ করা আবশ্যক। যেমন- দেশে নারীশিক্ষা গ্রহণকারীর অনুপাতে দরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, নারীদের সামাজিক নিরাপদ অবস্থা নিশ্চিতকরণ, বয়স্ক-অক্ষরজ্ঞানহীন নারীদের শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য সামাজিক সচেতনতা তৈরি, সরকার ও সংশ্লিষ্টগোষ্ঠী বা মহলের সংকীর্ণতামুক্ত নীতি ইত্যাদি। এ সময়ে নারীশিক্ষা প্রসারে দেশীয় সরকারের গৃহীত ব্যবস্থাবলি অনেক প্রশংসার দাবি রাখে। বাংলাদেশ সরকার নারীশিক্ষা প্রসারে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ছাত্রীদের জন্য উপবৃত্তির ব্যবস্থা করেছে। অন্যদিকে বয়স্ক নারীদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য 'বয়স্ক নারীশিক্ষা কেন্দ্র' চালু করেছে। এছাড়া সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও নারীশিক্ষা প্রসারে বিভিন্নভাবে অবদান রাখছে।

সুতরাং বোধশক্তিসম্পন্ন নারীদের সংকীর্ণ গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ না রেখে, তাদের ভদ্রভাবে নির্বিঘ্নে যাতায়াত ও যথোপযুক্ত শিক্ষা-দীক্ষার সুযোগ করে দিতে হবে। নারীশিক্ষার অগ্রগতির জন্য প্রথমেই যা করতে হবে তা হলো, পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে নারী-পুরুষ উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। দেশের নারীরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হলে তাদের পুত্রকন্যারাও ঠিক শিক্ষা পাবে। নারীদের উপযোগী ও আলাদা কাজের সুযোগ সৃষ্টি হলে দেশ-জাতি আর্থিকভাবে সচ্ছল ও উপকৃত হবে। উপসংহারে কথা একটাই, কবি নজরুলের সেই অমর পঙক্তিমালা 'কোন কালে একা হয়নি ক' জয়ী পুরুষের তরবারি/প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়া-লক্ষ্ণী নারী।'

অতএব, নারীকে পেছনে রেখে উন্নতির আশা করা দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয়। এখনই উপযুক্ত সময় অ-বিদ্যার অশনিসংকেত থেকে নারীদের মুক্ত করার। একমাত্র বিদ্যাচর্চাই দেখাতে পারে নারীদের মুক্তির সুনিয়ন্ত্রিত উপায়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে