শিখÐীদের কথা

ক্রোমোজম বা হরমোনে ত্রæটি অথবা মানসিক কারণে কারও লিঙ্গ পরিচয় নিধার্রণে জটিলতা দেখা দিলে বা দৈহিক লিঙ্গ পরিচয়ের সঙ্গে আচরণগত মিল না থাকলে তাদের চিহ্নিত করা হয় ‘হিজড়া’ হিসেবে। খুব অমানবিকভাবে এই হিজড়াদের অধিকারগুলো অস্বীকার করে আমাদের সমাজ। শিউলির ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি...

প্রকাশ | ০৮ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

এম মামুন হোসেন
ক্রোমোজম বা হরমনে ত্রæটি অথবা মানসিক কারণে কারো লিঙ্গ পরিচয় নিধার্রণে জটিলতা দেখা দিলে বা দৈহিক লিঙ্গ পরিচয়ের সঙ্গে আচরণগত মিল না থাকলে তাদের চিহ্নিত করা হয় ‘হিজড়া’ হিসেবে। খুব অমানবিকভাবে এই হিজড়াদের অধিকারগুলো অস্বীকার করে আমাদের সমাজ। শিউলির ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। কেউ কেউ এ জনগোষ্ঠীর মানুষের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ বা ‘থাডর্ জেন্ডার’, কেউ আবার ‘বৃহন্নলা’ বলেও উপাধি দেন। তবে যে নামেই তাদের ডাকা হোক না কেন আচার-আচরণ, চালচলনের কারণে এই জনগোষ্ঠীর মানুষ সমাজে চরমভাবে নিগৃহীত। অনেকেই ‘হিজড়া’ হওয়ার কারণে পরিবার থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। কাউকে কাউকে আবার জোর করে বের করে দেয়া হচ্ছে। সে কারণে পরিবার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরও সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে মৌলিক অধিকার বঞ্চিত। নিয়তি লাঞ্ছিত, ভাগ্যবিড়ম্বিত এক জনগোষ্ঠীর নাম হিজড়া জনগোষ্ঠী। অনগ্রসর এই হিজড়া জনগোষ্ঠীর দুঃখ, দুদর্শা ও দুভোের্গর অন্ত নেই। সমাজের অংশ হয়েও এরা পিছিয়ে পড়ছে কেবলমাত্র লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে। সাংবিধানিক অধিকার এদের ক্ষেত্রে উপেক্ষিত। ফলে এরা নাগরিক হিসেবে শিক্ষা, চিকিৎসা ও চাকরিসহ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। অথচ হিজড়া জনগোষ্ঠী এ দেশ ও মাটির কোনো না কোনো বাবা-মায়ের সন্তান। হিজড়া জনগোষ্ঠী শুধু রাস্তায় অনেক সময় অবজ্ঞা কিংবা অবহেলা নয়, এই হিজড়া জনগোষ্ঠী তাদের পরিবার থেকেও বিচ্ছিন্ন। সমাজে লোকলজ্জার কারণে পরিবারগুলোও তাদের হিজড়া সন্তানকে ঠেলে দেন রাস্তার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। রাস্তাঘাটে হাত পেতে কিংবা বিভিন্ন দোকানে গিয়ে দু’এক টাকা আদায় করেই হিজড়াদের জীবন চলে। পরিবার কিংবা সমাজ কোথাও তাদের ঠঁাই নেই বলছিলেন হিজড়া জনগোষ্ঠীর কয়েকজন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিক্ষালাভের সুযোগও হিজড়ারা পাচ্ছে না। অথচ নাগরিক হিসেবে এটা তাদের অধিকার। সুস্থ জীবনের সদস্য হিজড়া ববি জানান, তিনি কষ্টেসৃষ্টে ষষ্ঠ শ্রেণি পযর্ন্ত পড়েছেন। এরপর পরিস্থিতির কারণে আর এগোনো সম্ভব হয়নি। ববি বলেন, একটু কাজের জন্য কোথায় না গেছি! কিন্তু কেউ কাজ দেয় না। বিনিময়ে শুধু ঠাট্টা আর বিদ্রƒপ করে। চিকিৎসার জন্য কোথাও গেলে কেউ চিকিৎসা দেয় না। জাতীয় পরিচয়পত্রও পাইনি। একই অবস্থা পিংকিরও। লিঙ্গীয় পরিচয় হিজড়া হওয়ায় তার অভিজ্ঞতাও অন্যদের থেকে ভিন্ন কিছু নয়। সমাজ ও পরিবার থেকে বঞ্চনা নিয়েই বেড়ে উঠেছেন তিনি। বঁাধন হিজড়া সংঘের নিবার্হী পরিচালক হিজড়া পিংকি শিকদার জানান, প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে তার পক্ষে স্কুলের আঙিনায় পা রাখাই সম্ভব হয়নি। এমনকি বাসা ভাড়া নিতে গেলেও তাদের প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে। হিজড়া গোপী জানান, ১২ বছর বয়সে তার মা-বাবা তাকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে হিজড়াদের কাছে ঠেলে দেয়। সমাজ তাদের মেনে নেয় না। অন্য ভাই-বোনরাও সমাজে মুখ দেখাতে পারে না। তাদের ভোটাধিকার নেই, সম্পত্তিতে কোনো অধিকার নেই, কোথাও গ্রহণযোগ্যতা নেই। তিনি বলেন, সমাজ তাদের মেনে নেয় না। অন্য ভাই-বোনরাও সমাজে মুখ দেখাতে পারে না। কেন তারা অন্যদের মতো আইনগত অধিকার পাবেন না? কেন তাদের জীবন অবজ্ঞা আর অবহেলায় কাটবে? নিজের বঞ্চনা আর অভিজ্ঞতার বণর্না করতে গিয়ে সাগরিকা হিজড়া বলেন, ‘আমাদের মূল সমস্যা, কাজ না পাওয়া। সিটি করপোরেশনে রাস্তা ঝাড়– দেয়ার কাজটাও পাই না। নিজের অধিকারটাও পাই না। বয়ঃসন্ধিকালে আমাদের পরিবার থেকে বের করে দেয়া হয়। এভাবে পারিবারিক সম্পত্তি থেকেও আমরা বঞ্চিত হচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘কেউ কেউ কাজ দিলেও যে টাকা দেয়ার কথা, তার অধের্কও দেয় না।’ সাগরিকা বলেন, ‘যানবাহনে আমাদের নিতে চায় না। আদমশুমারিতে ‘হিজড়া’ হিসেবে গণনা করা হচ্ছে না। আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, নেই পাসপোটর্ও। কাজ পেলেই তো আমাদের জীবন চালানো অনেকটা সহজ হয়ে যায়। টাকা যেদিকে, আইন চলে সেদিকে। আইনের আশ্রয় থেকেও আমরা বঞ্চিত। আমরা মানুষ হিসেবে অন্যদের মতো বঁাচতে চাই।’ বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির কমিউনিকেশন বিশেষজ্ঞ জাহিদ আল আমীন বলেন, সংবিধানের ২৭ নাম্বার ধারায় বলা হয়েছে ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ কিন্তু হিজড়া জনগোষ্ঠী মৌলিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি বলেন, সমাজের বিভিন্ন ধাপে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম ও সোস্যাল মিডিয়া বিশেষ ভ‚মিকা রাখতে পারে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, অপবাদ ও বৈষম্যের মধ্যেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের বীজ নিহিত। সংবিধান অনুসারে সকল নাগরিকের সমান অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো বৈষম্য না করে নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটি অংশ হিজড়ারা নানা বৈষম্যের শিকার। এ জন্য সরকারকে অবশ্যই কাযর্কর পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, হিজড়া জনগোষ্ঠী প্রকৃতিগত সৃষ্টি। এখানে কারও হাত নেই। যেহেতু প্রাকৃতিক কারণে তারা অধিকার বঞ্চিত এ জন্য প্রথমে তাদের অধিকারের আইনগত স্বীকৃতি দিতে হবে। সম্প্রতি হিজড়াদের ‘লিঙ্গ পরিচয়কে’ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। ফলে সরকারি নথিপত্র ও পাসপোটের্ তাদের লিঙ্গপরিচয় ‘হিজড়া’ হিসেবে উল্লেখ করা হবে। শিক্ষা, চিকিৎসা ও আবাসনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য ঘোচাতেও কাযর্কর হবে এই স্বীকৃতি। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় বিভিন্ন সময়ে তাদের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও তথ্য সংগ্রহের সময় তাদের চিহ্নিত করা কঠিন হয়। ফলে সরকারি সুবিধাও তাদের কাছে পেঁৗছায় না। এই সিদ্ধান্তের ফলে তথ্য সংগ্রহের সময় ব্যক্তির লিঙ্গ পরিচয় হিসেবে ‘নারী’ ও ‘পুরুষের’ পাশাপাশি ‘হিজড়া’ হিসেবে চিহ্নিত করার সুযোগ থাকবে। পাসপোটের্ও তাদের লিঙ্গ পরিচয় হবে ‘হিজড়া’। নথিপত্রে ইংরেজিতেও ‘হিজড়া’ শব্দটি ব্যবহার করতে হবে।