শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
সা ক্ষা ৎ কা র

সামাজিক অবক্ষয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী : প্রফেসর দিলারা চৌধুরী

প্রফেসর দিলারা চৌধুরী একজন রাষ্ট্রচিন্তক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, এক আলোকিত নারী। যায়যায়দিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে নারীর উন্নয়ন, সংকট ও তার সুরক্ষাসহ সমসাময়িক বিষয়ে তার গুরুত্বপূর্ণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবদুর রহমান মলিস্নক
নতুনধারা
  ১০ মে ২০২১, ০০:০০

যাযাদি : আপনি একজন শিক্ষাবিদ, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। আপনার শৈশব এবং বেড়ে ওঠা সম্পর্কে কিছু বলুন।

দিলারা চৌধুরী : সবার যেমন শৈশব থাকে আমারও তেমনি ছিল, তবে সেটি খুব আনন্দময় ছিল। পুরান ঢাকার মানুষ ছিলাম। বকশীবাজার এলাকার। ওই সময় আমাদের এলাকায় পাড়াভিত্তিক কিছু ব্যাপার ছিল। এই পাড়ায় আমরা ওই পাড়ার তারা। আমরা পাড়ার ছেলে আমরা পাড়ার মেয়ে। পলাশীবাজার মাঠ ছিল এক বিশাল মাঠ। যেখানে ইঞ্জিনিয়ারিং ডরমেটরি হয়েছে। আমরা বিকেলে হই হই করে সেই মাঠে যেতাম। ৪টায় বেরিয়ে আবার সন্ধ্যার মধ্যে বাসায় ফিরতে হতো। তখন এতটা সিকিউরিটি সমস্যা ছিল না। আমাদের সময়ে ফেসবুক ছিল না, টিভি ছিল না, কিচ্ছু ছিল না। আমরা তখন খেলাধুলা, অবসর সময়ে আড্ডা দেওয়া, গল্পের বই পড়া এইসব করতাম। আমি মুসলিম গার্লস স্কুলে পড়েছি। এখন আনোয়ার মুসলিম গার্লস হাইস্কুল বলে পরিচিত, নাজিম উদ্দিন রোডে। সেখান থেকে ম্যাট্রিক পাস করেছি। তখন মেয়েদের মধ্যে আমি ফার্স্ট হয়েছি আর ঢাকা বোর্ডে থার্ড হয়েছি, তখন একটাই বোর্ড ছিল। ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনে আমি তখন স্কুলে পড়ি। আমার মনে পড়ে ইউনিভার্সিটি থেকে ছেলেরা এসেছিল আমাদের প্রসেশনে নিয়ে যেতে। টিচারটা যেতে দিতে চাননি। দেখা গেল আপারা কেউ কেউ যাবেন তখন আমরাও তাদের সঙ্গে মিছিলে যোগ দিয়েছিলাম। আপাদের বাঘের মতো ভয় করতাম; কিন্তু তারা খুব স্নেহ করতেন। গেটে তালা দেওয়া ছিল, তালা খুলে দেওয়া হলো, আমরা তাদের পিছু পিছু গেলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়াশোনা করেছি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার আগেই দেশের বাইরে চলে যাই। লন্ডন ইউনিভার্সিটিতে এমএস করি। পরে আমেরিকাতে থেকেছি, সেখানে চাকরি করেছি ১৯৯৫ পর্যন্ত। আমার দুই ছেলে ওখানেই রয়ে গেল। তারপর দেশে এসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় পঁচিশ বছর চাকরি করলাম। সেখানে রিটায়ার্ড করার পর নর্থ সাউথে চার বছর চাকরি করেছি। প্রথম আলো, ডেইলি স্টারে কলাম লিখতাম। ডেমোক্রেসির ওপরই লিখতাম বেশি। যখন কেয়ারটেকারের দাবি উচ্চকিত হয়ে উঠেছিল, তখন আমি লিখেছিলাম, দিস ইজ নট অ্যা গুড আইডিয়া। আমি মনে করি ইলেকশন কমিশনকে স্ট্রেইনদেইন করতে হবে। আমি বলেছি কেয়ারটেকার গভর্র্নমেন্ট যেভাবে সাজানো হচ্ছে তাতে বিচার বিভাগ একটা কনট্রোভার্সির মধ্যে পড়বে।

যাযাদি : আপনি দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। সেমিনার, আলোচনা সভা, টকশোসহ বিভিন্নভাবে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য ও মতামত দিয়ে থাকেন। সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে আপনি কি তৃপ্ত?

দিলারা চৌধুরী : আমার ব্যক্তিগত সাবস্ট্র্রাকশন অনেক। আমার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এত খারাপ অবস্থা ছিল না। তখন ছাত্ররা খুব সম্মান করত। কোনো দলাদলিতে আমি পড়িনি। আমার ছাত্র যারা বিভিন্ন স্থানে পোস্টেট আছে, আমি যদি তাদের কোনো হেল্প চাই তারা তা করে দেয়। এটা আমার একটা বড় স্যাটিসফেকশন। আমি একবার মাদারীপুর গেলাম এসপি সাহেবের অফিসে। এসপি সাহেব বললেন তিনি নাকি আমার ছাত্র ছিলেন। তবে তিনি ছিলেন ইংরেজি বিভাগের। তিনি আমার কথা রাখলেন, সব ধরনের সহযোগিতা করলেন। এটা একটা স্যাটিসফেকশনের বিরাট দিক।

যাযাদি : বর্তমানে নারীর অগ্রযাত্রাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

দিলারা চৌধুরী : সোশ্যাল ইন্ডিকেটরে নারীর উন্নতি হয়েছে। সেটা বেসিক্যালি এনজিওদের জন্য হয়েছে। সেখানে সরকারেরও কো-অপারেশন আছে। নারী অগ্রসর হয়েছে, তবে পলিটিক্যাল ইম্পাওয়ারমেন্ট না হলে মেয়েদের সুরক্ষা, মেয়েদের বিশেষ যে প্রয়োজন প্রকৃত অর্থে হবে না। কাক্সিক্ষত অগ্রযাত্রা দেখতে পাচ্ছি না। এখন তো বিভিন্ন ইস্যু চলছে, রেপ হচ্ছে, অধিকাংশ নারী সাংসদ এর জন্য কি কোথাও কিছু বলেছেন? একটি বর্ণও কি তারা উচ্চারণ করেছেন? তারা তো রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। আগে তো জাসদের শিরীন আখতারকে রাস্তায় ঝাটা মিছিল করতে দেখেছি, এখন তো তিনি সংসদে চুপ করে আছেন। তবে বেশ ভালো ভালো কিছু আইন পাস করা হয়েছে। ধর্ষণের প্রতিবাদে দেশব্যাপী আন্দোলন হয়েছিল, ফাঁসি হওয়ারও নজির রয়েছে। ধর্ষণের ঘটনার ২০% রিপোর্ট হয়। ৮০% দুঃখ বেদনা লজ্জায় চেপে যায়। মুনিয়া হত্যার ব্যাপারে মেয়েরা কোথায় ভূমিকা রাখছে? একটা স্টেইটমেন্টও শুনি না। নারীর অধিকার রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়া উচিত।

যাযাদি : নারী সহিংসতার শিকার হয়েও বিচার পাচ্ছে না। আপনি কী বলবেন?

দিলারা চৌধুরী : দেখা গেলো সম্প্রতি অপমৃত্যুর পরে আলোচিত মুনিয়ার চরিত্র হননের কাজ শুরু করেছিল একটি পত্রিকা, ফেসবুকে ঝড় ওঠার কারণে তারা সেটা বন্ধ করেছে। আমরা এখন ফেসবুকের ওপর নির্ভরশীল, কাগজে তো সব পাওয়া যায় না।

যাযাদি : নারীর সুরক্ষায় রাষ্ট্র বা সরকার কী ব্যবস্থা নিতে পারে বলে মনে করেন?

দিলারা চৌধুরী : নারীর সুরক্ষার ব্যাপারে সুপারিশ তো অনেক আছে। সেদিন একটা আর্টিকেল পড়লাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সালেহ উদ্দিন লিখেছেন। দেখলাম সুন্দর সুন্দর সাজেশন দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধবে কে? মেয়েদের সুরক্ষায় স্ট্রং একটা উইমেন মুভমেন্ট থাকা প্রয়োজন। সেই অপজিশন নেই যারা গভর্নমেন্টকে চেপে ধরতে পারে, বিচারে বাধ্য করতে পারে। ঝুড়ি ঝুড়ি রিকমেন্ডেশন আমাদের কাছে আছে কিন্তু বাস্তবায়ন করবে কে? ফাঁসির আইন করেছে একটাও কি ফাঁসি হয়েছে? কিন্তু ধর্ষণ নির্যাতন তো অব্যাহত আছে। অভয়ার জন্য ইন্ডিয়াতে যে মুভমেন্ট হয়েছিল, যে মুভমেন্টে ধর্ষকের ফাঁসি হয়েছে। তখন মানুষ ভরসা পায়, বুঝতে পারে মুভমেন্টরও শক্তি আছে।

যাযাদি : সমাজে, পরিবারে এক ধরনের অসহিষ্ণু মনোভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। এর কারণ কী হতে পারে?

দিলারা চৌধুরী : হঠাৎ করে একজন আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাচ্ছে। তখন পরিবারের সবাই একেক দিকে ঝুঁকে পড়ে। কেউ তার পক্ষে কেউ বিপক্ষে। এখন শুধু একটাই কথাÑ কী করে টাকা বানাব। ভাইবোনকে ঠকানোর চেষ্টা করছে। এ সবই অসহিষ্ণুতার জন্ম দেয়। মানুষ যখন মনে করে আল্লাহ যা দিয়েছেন তাই নিয়ে আমি হ্যাপি, তখন কিন্তু অসহিষ্ণুতাটা তৈরি হয় না। সামাজিক সৌহার্দ না হলে তো উন্নতি কিছুই হবে না। একটা কাজ তো একা করা যায় না, সবাই মিলেই করতে হয়। সেখানে সম্প্রীতি তো থাকতেই হবে। সেই সম্প্রীতিটাই তো নাই। অনেক দুঃখের কথা আছে; তনু হত্যার বিচার হয়নি, সাগর-রুনির বিচার হয়নি, নুসরাতের বিচার হয়নি।

যাযাদি : নারীর গৃহকর্মের পারিশ্রমিকের জন্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও চীনে আইন পাস হয়েছে সে বিষয়ে কিছু বলবেন?

দিলারা চৌধুরী :এটা আইওয়াশমূলক একটা আইন। এটা কখনোই বাস্তবায়িত হবে না। কারো অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে আইন লাগে,সচেতনতা লাগে, সরকারের আন্তরিকতা লাগে। মনে রাখতে হবে, দেশে রাজনৈতিক অবক্ষয় হলে সবাই সাফার করে, মেয়েরা বেশি করে।

যাযাদি : একজন আলোকিত নারী হিসেবে দেশের সব নারীর প্রতি আপনার বার্তা কী?

দিলারা চৌধুরী : নারীকে সচেতন হতে হবে। সে যদি সচেতন নারী হয় তবে নিজের জীবনকে চালানোর সক্ষমতা অর্জন করবে। সবারই দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। আমাদের দেশে রান্নাঘরটা ছোট করে বানায়, ঘুপচি ঘরের মতো। অথচ ওয়েস্টার্ন কান্ট্রিতে রান্নাঘর কত বিশাল। হাইওয়ে রোড যে করেছে, মাওয়া পার হয়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত যাওয়া যায়। রাস্তার পাশে কোনো রেস্টরুমের ব্যবস্থা নেই। যেখানে একটু বসবে, ফ্রেশ হবে, বাথরুমে যাবে। যখন বগুড়া যাই সারা পথে কোনো টয়লেট নেই। কোনো একজন পুরুষ লোক চিৎকার দিয়ে ওঠে বলে, যেতে হবে যেতে হবে। বলে হুড়হুড় করে নেমে যাচ্ছে, মেয়েরা ওভাবে হুড়হুড় করে নামতে পারছে না। ডিসিশন মেকিংয়ে যদি মেয়েদের ইনপুট না থাকে তবে তাদের বেসিক নিডটা ওভারলুকড হয়ে যায়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে