নিজেকে উজাড় করে সংসার আগলে রাখেন নারী

প্রকাশ | ১৭ মে ২০২১, ০০:০০

মালা মিত্র
'কোন কালে একা হয়নিক জয়ী পুরুষের তরবারি, প্রেরণা দিয়াছে শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্ণী নারী'। পুরুষ ছাড়া পৃথিবী যেমন অসম্পূর্ণ, ঠিক একই ভাবে নারী ছাড়া সৃষ্টি অসম্ভব। তবু পৃথিবীজুড়ে স্ত্রী জাতির অপমানের শেষ নেই। একটু বয়োঃপ্রাপ্ত হলেই স্বজনদের ছেড়ে ঘর বাঁধে নারী। নিজের সর্বস্ব উজাড় করে একটি সংসারকে আগলে রাখে। অথচ নানা ছুতা-নাতায় অভিযোগের আঙুল ওঠে নারীর দিকেই। প্রশ্ন ওঠে তার সতীত্ব নিয়েও। আচ্ছা সতী কথাটার উৎপত্তি কোথায় বলতে পারেন? যতদূর মনে হয় খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে, মানে মহাভারতের আমল থেকেই। শ্রেষ্ঠ সতী অর্থাৎ পঞ্চসতী বলতে আমরা, কুন্তী, তারা, দ্রৌপদী, মন্দোদরী, অহল্যাকেই বুঝিয়ে থাকি। তারা যদি পরম সতী হয়ে থাকেন, ক্ষেত্রজ সন্তান পাওয়া যদি তাদের মৌলিক অধিকার হয়ে থাকে, তবে এ যুগের নীনা গুপ্তারা মাসাবা বাচ্চার মা হলেই কেন ছিছিক্কার পড়ে যায়? প্রকৃত সতীর সংজ্ঞা কি? সতীর বিপরীত শব্দ তো গোলমেলে, মশাই সেটা কিনা সৎ। ধরে নিলাম যদিতং হৃদয়ং তব টব করে স্বামীর প্রতি স্ত্রী, স্ত্রীর স্বামীর একগামিতাকেই বোঝায়, কাবিননামায় দুটো মনজুড়ে থাকার অঙ্গীকারপত্র মেলে। আচ্ছা বুকে হাত দিয়ে বলুন তো ১০০ ভাগ পুরুষ মানুষ সত্যিটা; আর আমরা তো আর ললিপপ খাওয়া বঙ্গলতিকাটি নই, আমরাও তো সৎ খুঁজতে যাচ্ছি না, গেলেই বা পাচ্ছি কোথায়? সে তো ঠক বাছতে গাঁ উজাড় হওয়ার খাপ। অজ্ঞানতা আর কুসংস্কার ভরা এই সতী নামটি পাল্টে রাখা যায় না? কারও চরিত্তির নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে লাভটা কি? কেউ কম আহার করে, কেউ বেশি, এটা নিয়ে তো কারও দ্বিমত থাকতে পারে না। বিদ্যাসাগরের চরিত্র ব্যতিক্রমী। ১৮৫২ সালে জন্ম হয়েও শিবমোহিনী দেবীর মতো মানুষও তো ছিলেন। বাংলাদেশের মহীয়সী নারী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন যেমন ছিলেন, কবি সুফিয়া কামালের মতো মহীয়সী নারীও তো ছিলেন। যারা মানুষের মনুষ্যত্ব নিয়ে যতটা ভাবতেন, ওই সতীপনা নিয়ে অত ঢং করতেন না। রসুন, আরও আছেন, অন্নপূর্ণা দাশগুপ্তার কথাই ধরুন, অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করা বিবাহ বিচ্ছিন্ন প্রথম মহিলা তিনি। আরে বাপু মনের সঙ্গে কোনো মিলই নেই, অথচ চওড়া সিঁদুর, ধ্যাবড়া আলতা, শাঁখা, পলা, মঙ্গলসূত্র, হিজাব বোরখায় দেখা কোনো সতীর চেয়ে, সব নীনা গুপ্তা, সুস্মিতাদের ঢের সহজ লাগে, মনেও যা মুখেও তা, কোনো ভন্ডামি নেই। কত সতী নারীকেই তো ঘোমটার আড়ালে খ্যামটা নাচতে দেখলাম। আপত্তি আছে, ঘোরতর আপত্তি আছে, ওই সতী কথাটার ওপর। ভাবুন তো একবার মহাভারতের মহা সতী নারী কুন্তীকেই। তার যখন যেমন ইচ্ছে হয়েছে, বিয়ের আগে বা পরে, কখনো সূর্য, কখনো বরুণ দেব, কখনো ধর্ম, কখনো পবন দেব, অশ্বিনীকুমারদ্বয়ও বাদ যাননি, ডেকে ডেকে গ্রহণ করেছেন, তা তিনি করতেই পারেন, তাতে আমাদের মাথাব্যথা নেই, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার দরুন পেয়েছেন মহাভারতের পরাক্রমী কুমারদের। এখনকার কার ঘাড়ে কটা মাথা থাকবে এমন 'খুলস্নাম খুলস্না' সন্তান লাভের কথা! তবে একেবারেই হচ্ছে না এমনটা নয়, আজকাল অনেক কিছুই হচ্ছে, লিভইন হচ্ছে, মতের না মিল হলে সরে যাওয়া যাচ্ছে, অসুবিধে অন্যকিছুতে নয়, কুন্তী পঞ্চসতীর এক সতী মানতে। গুণীজনে বলেন, পেছনে তাকিও না, এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলাতে যদি প্রগতি বিঘ্নিত হয়, আমি সে পথে হাঁটব না। দেওরালার রূপ জানোয়ারকে বীভৎসভাবে জোর করে সতী করার কথায় আজও প্রাণ থরথর করে কেঁপে ওঠে। এমন সতী না হয়ে আমি অসতী হবো বারবার। এবার পাঞ্চালী বা দ্রৌপদী, মহাভারতের নায়িকা তার কথায় আসা যাক তিনি একযোগে পাঁচ স্বামী নিয়ে পঞ্চসতীর এক সতী। এখনকার মেয়েরা তো বাবা ধঃ ধ :রসব পাঁচজনের ঘর করেন না, যখন যার সঙ্গে পোষালো আয় বাবা, না পোষালো তো যা বাবা পথে দেখগে। রামায়ণে তারার সতীত্বের কথাই যদি বলেন, না না ওসব বাঁদর হনুমানের সতীপনায় আমার বিশ্বাস নেই। আর সতী মন্দোদরী, পরম সতী, নিকুচি করেছে অমন সতীপনায়। স্বামী যার জবরদস্তি পরস্ত্রীকে তুলে আনছে, আর স্ত্রী গাইছেন, 'তোমারি পথ পানে চাহি, আমার এ পাখি গান গায়'। ঝাঁটা মারি অমন সতীত্বে। তাকে বড় সতী মানতাম যদি তার সোহাগের স্বামী টিকে সুমন্ত্রণা দিয়ে ঠিক পথে রাখতেন। আর করবেনই বা কেমন করে? এ সমাজে কেউ কখনো নারী জাতিকে মানুষ বলে জ্ঞান করেছে? 'বিষ নেই তায় আবার কুলোপনা চক্কর'। অহল্যার কথায় আসি, তিনিও সতীদের একজন, তার তিনি তো বেশির ভাগ সময়টাই পাষাণ হয়ে কাটিয়ে ছিলেন, প্রাণ ফিরে পান সেও তো পরপুরুষ রামের ছোঁয়ায়। আসলে হয়েছে কি জানেন, ওই কথায় বলে না, মেয়েদের এগারো হাত শাড়িতেও কাছা দেওয়া যায় না, কেন যাবে না শুনি? ভারতের মারাঠি মেয়েরা কি সুন্দর কাছা দিয়ে শাড়ি পড়ে, নোলক দুলিয়ে হংসী চলনে গমন করে! এখনও শুনেছি কেউ কেউ স্বামীর উন্নতির জন্য ওপরওলার সঙ্গে অমন করে থাকে, তাকে কি বুক বাজিয়ে সতীমাতা আখ্যা দেওয়া হচ্ছে? কলা বেচেও পয়সা পাওয়া যায়, আর এত চারুকলা ঈশ্বরের ললিত সৃষ্টি। আমি যে এবার ধান ভানতে শিবের গাজন গাইতে বসলুম। মোদ্দা কথা, শেষের কথায় বলি, সতী-টতী না বলে, ভালো মেয়ে হও! দেশের উপকার করো! দশের উপকার করো! সতীমাতার জয় না বলে আসুন সমস্বরে বলি, জয় মানুষের জয়, জয় মানবতার জয়, জয় মনুষ্যত্বের জয়, জয় সত্যের জয়।