শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

'দুর্যোগে দুর্ভোগে সংগ্রামে উন্নয়নে নারী'

ওয়াহিদা আক্তার
  ১৭ মে ২০২১, ০০:০০

যে কোনো দুর্যোগের শিকার হয় নারী ও শিশু। সেই দুর্যোগ যদি হয় প্রাকৃতিক ঝড়ঝঞ্ঝা, সাইক্লোন, ভূমিকম্প, বন্যা, পস্নাবন ইত্যাদি সেখানেও দেখা যায় নির্দোষ শিকার হচ্ছে নারী ও শিশু। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে ৯ মাসজুড়ে প্রসব বেদনার মতো অসহনীয় ও ভয়াবহ বেদনার মধ্যদিয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলার নারীদের জীবন। যারা দেশ ত্যাগ করতে পারেনি, যে নারীর বাবা, ভাই, স্বামী, পুত্র মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে তাদের বিপদ ছিল সবচেয়ে বেশি। সেই বেদনার ইতিহাসে সবার নাম হয়তো লেখা নেই। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বগাথা আমরা গর্বের সঙ্গে প্রচার করি, কিন্তু প্রচার করি না লাখ লাখ মা বোনের সম্ভ্রম হারানোর সেই বেদনার ইতিহাস। বেঁচে থেকে যারা জীবনমৃত হয়ে ভুলতে পারেনি তাদের সম্ভ্রমহানির অত্যাচারের সেই নির্মম ভয়াবহতা, ভুলতে পারেনি সেই অপমান। কত স্বপ্ন, কত ঘর, কত পরিবার যে অসহায় অবস্থায় তাদের স্বপ্ন ভেঙে যেতে দেখেছেন তার পরিসংখ্যান হয়তো কোথাও পাওয়া যাবে না। পরিবারের মা-বাবার সামনে মেয়ের অপমান, ভাইয়ের সামনে বোনের অপমান, ছেলের সামনে মায়ের অপমান ও নির্যাতন বাংলার মুক্তিপাগল দামাল ছেলেদের বুকে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। কতশত মানুষ জীবন দিয়েছে, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ ভয়ংকর বিপদ জেনেও বাংলাদেশের নারী আঁচলের মধ্যে অস্ত্র রেখে মুক্তিযোদ্ধাকে দিয়েছে, ভাত রান্না করে খাইয়েছে, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের নার্স হিসেবে সেবা করেছে, স্বামী-পুত্রের দুঃখ ভুলে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের আপন করে প্রেরণা জুগিয়ে যুদ্ধে সহযোগিতা করেছে। দীর্ঘ নয় মাস ক্ষুধায় কাতর হয়ে, না ঘুমিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তার দেশ-মাতৃকাকে অপমানের প্রতিশোধ নিতে পেরেছে। আমাদের সময় এসেছে মুক্তিযুদ্ধকালীন নারীর প্রতি অবমাননার সেই ভয়াবহতার চিত্র তুলে ধরার। আজ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। দেশের নারীরা সরাসরি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে। আমরা যারা নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে ভাবছি, কাজ করছি, তাদের প্রতি মুহূর্তে মনে রাখা দরকার বা ভুলে যাওয়া উচিত হবে না, এ দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে লাখ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির বেদনা জড়িয়ে আছে। আমরা দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশ পেয়েছি' কথাটা একটা লাইনের মধ্যে উচ্চারণ করে আমাদের দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলছি।

সঠিকভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারছি না। কথাটি বলতে গেলে কত সহজ মনে হয় কিন্তু বিষয়টি এত সহজ ছিল না। এই বিস্মৃতি আমাদের ভবিষ্যৎ নারী জাতিকে বিপদগ্রস্ত করছে। আমাদের ভবিষ্যৎ তরুণ প্রজন্ম যদি আমাদের মা-বোনদের সম্ভ্রম হারানোর বেদনা হৃদয়ঙ্গম করত তাহলে তারা মায়ের জাতি, বোনের জাতি নারীকে ধর্ষণ, নির্যাতন করতে পারত না। মানুষ ও পশুর মধ্যে পার্থক্যই শুধু যে মানুষের ভিতরে বিবেকবোধ আছে যা সেই মানুষকে কখনো অন্যায় কাজে প্ররোচিত করতে সায় দেয় না। বাংলাদেশ তথা বাঙালি জাতির সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ। ১৯৭১ সালের পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলার মানুষের লড়াই ছিল অসাম্প্রদায়িক ও অসাধারণ। যা ছিল সমগ্র জাতির একতাবদ্ধ ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সংগ্রাম। বাঙালির এই সংগ্রামের ইতিহাস পূর্ব-পুরুষের বীরত্বগাথা, আমাদের বর্তমান প্রজন্মের গর্ব এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রেরণা। বাঙালির বীরত্বগাথা ও মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির গৌরবগাথার সঙ্গে বাংলার মা-বোন মেয়েদের ওপর ঘটে যাওয়া ভয়াবহ নির্যাতন কাহিনী প্রকাশ হওয়া প্রয়োজন। ঘরে ঘরে পাকিস্তানি বাহিনীর লুটপাট হত্যা-নির্যাতন শেষে তাদের প্রশ্ন ছিল 'আওরাত কাহা?' বাবা, ভাইয়ের সম্মুখ থেকে সে সব মেয়েকে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার সময় তারা ছোট সন্তান, বাবা, ছোট ভাইদের গুলি করে মেরে রেখে যেত। তখন পাকিস্তানি জওয়ানদের বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে 'ধর্ম যুদ্ধ', 'কাফের খতম' ইত্যাদি মন্ত্রে উদ্দীপ্ত করা হয়। বাংলার নারীকে তারা চরম ঘৃণাভরে 'গনিমতের মাল' গণ্য করে নির্বিচারে নির্যাতন চালায়। সেনাপতি টিক্কা খান আদেশ দিয়েছিল 'বাঙালিদের তোমরা হত্যা করে তাদের দোকানপাট লুট করো, বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দাও, তাদের মেয়েদের ধর্ষণ করো'। দুঃখের বিষয় যে এই কাজে সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশের ধর্মান্ধ, উগ্র ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাসী কুলাঙ্গার কিছু দালাল। ২৫ মার্চ কালরাতে ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আচমকা 'অপারেশন সার্চলাইট' নামে পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। ঢাকা শহরের সম্ভ্রান্ত মহিলাদের ধরে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে দিনের পর দিন নির্যাতন চালানো হয়। অপমানের জ্বালা মেটাতে পাঞ্জাবি অফিসারকে খুন করে পরে বুকে মাইন বেঁধে মিলিটারি ভর্তি ট্রাকের নিচে আত্মাহুতি দিয়েছেন এমন ঘটনাও ঘটিয়েছেন বাংলার সম্ভ্রমহারা সাহসী নারীরা।

বাঙালির অস্ত্রের শক্তি সীমিত ছিল; কিন্তু ক্ষোভের শক্তির কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না। তাদের ভালোবাসার সম্পদ ছিল অফুরন্ত এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভালোবাসা ও আস্থা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি। ৭ মার্চের ভাষণ তাদের প্রতিমুহূর্তে উজ্জীবিত রেখে মুক্তিযুদ্ধে শক্তি জোগাতো। বাঙালির সেই প্রীতি ভালোবাসার সঙ্গে অস্ত্রের সম্মেলনে বাঙালি হয়েছিল দুর্জয়। বাংলার স্বাধীনতাকামী নারী ও সশস্ত্র যুদ্ধে অনুপ্রাণিত হয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। পাক-হানাদার কর্তৃক সম্ভ্রমহানির শিকার হয় প্রায় দুই লক্ষাধিক মা-বোন। সবচেয়ে হতাশা ও দুঃখের বিষয় আমাদের দেশেরই সেই সব দালাল, রাজাকার, আলবদর, আলশামস পাকফৌজদের দোসর হিসেবে আমাদের দেশের মা-বোনকে তাদের হাতে তুলে দেয়, তারা আজও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও উন্নয়নকে মেনে নিতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দিকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় একটু শিক্ষিত মেয়েদের খোঁজ করা হয়, তখন বহু মেয়ে সাহস করে নার্স হিসেবে কাজ করতে সম্মত হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে অসুস্থ এবং আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করেন বাংলার সাহসী নারী।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সর্বস্ব হারানো এই নারীদের সমাজ গ্রহণ করেনি। সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বাবা তার ঘরে আশ্রয় দিতে পারেনি তার সম্ভ্রমহারা কন্যাকে, স্বামী ঘরে আনতে পারেনি তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে। ভাইকে যেন সামাজিক গস্নানি সহ্য করতে না হয় সে জন্য আত্মাহুতি দিয়ে মুক্ত করেছে পরিবারকে আমাদেরই সম্ভ্রমহারা বোন। তাদের কোনো দোষ না থাকলেও প্রতিমুহূর্তে সামাজিকভাবে নিগ্রহের শিকার হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে