শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

'সংসার' শব্দটি এখন দিচ্ছে নতুন ভাবনার খোরাক

নাসরীন গীতি
  ৩১ মে ২০২১, ০০:০০

সংসার-এক কথায় স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি ও পরিবার-পরিজন নিয়েই হচ্ছে সংসার। ভাবছেন তো, এ আর নতুন কি, সবাই তো এ রকমটাই জানি। হুম, তাতো জানিই। কিন্তু দেশে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় নতুন করে 'সংসার' শব্দটি নিয়ে ভাবনার খোরাক দিচ্ছে।

সম্প্রতি কলেজছাত্রী মুনিয়ার মৃতু্য আর তাকে নিয়ে যে সংবাদ দেখা বা শোনা যাচ্ছে তাতে প্রথম প্রশ্ন জাগল- এই সংসারটার নাম কি? যেখানে একজন বিবাহিত পুরুষ, আরেকজন তরুণীকে আলাদা আলিশান বাড়িতে প্রাচুর্যের মধ্যে রেখে ভোগের রাজত্ব কায়েম

করতে পারে।

আবার মোটামুটি উচ্চবিত্ত এক ব্যবসায়ীকে জানি, যিনি তিন সন্তানের জনক, উচ্চশিক্ষিত ও রুচিশীল স্ত্রীর স্বামী। খুব প্রাচুর্য না দিতে পারলেও একজন তরুণীকে অনায়াসে আলাদা এক বাড়িতে রাখতে পারছেন। নিজের অফিসে চাকরি দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পেরেছেন।

তারা দুজনই সামাজিক দৃষ্টিতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুখী পরিবারের কর্তা। অথচ, দুজনই অতিরিক্ত সম্পর্কে (এক্সট্রা অ্যাফেয়ার্স) জড়িয়ে আছেন।

অন্যপক্ষে, স্বামীদের এ হেন আচরণ জানা সত্ত্বেও তাদের স্ত্রীরা সন্তান-সংসার ফেলে অন্যত্র সম্পর্কে জড়াতে পারছে না বা পারেনি। এদিকে, স্বামীরা তাদের ছাড়ছেনও না, ক্ষেত্রবিশেষে উল্টো স্ত্রীর বিরুদ্ধে নানা ধরনের অযোগ্যতার অভিযোগ তোলেন। দ্বিতীয়ত, উলিস্নখিত ব্যবসায়ী নিজের পরকীয়ার সাফাই গেয়ে বলেন, 'তিনি ১৮/১৯ বছরের সংসারে কখনোই সুখী নন। দুজনের মিলনে সন্তান জন্মানো, আর দাম্পত্য সুখ পাওয়া এক কথা নয়।'

নতুন নতুন সুখের জন্য ওই ধরনের ব্যক্তিরা যখন নতুন পাত্র খুঁজে বেড়ায়, তখন তাদের মূল সংসারে কি প্রভাব পড়ছে? স্ত্রী স্বাভাবিকভাবেই আর স্বামীর সঙ্গে সহজ হতে পারেন না। প্রথম দিকে চেষ্টা করেন যাতে সন্তানদের ওপর এর প্রভাব না পড়ে। পরে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে তা অসহনীয় হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে তার প্রভাব পড়েই সন্তানদের ওপরও। এভাবেই অস্থিরতা আর অসহিষ্ণুতায় চলতে থাকে সংসার। একপর্যায়ে সংসারও ভেঙে যায়।

বর্তমানে এ ধরনের সংসারের তালিকাটা দীর্ঘই হচ্ছে সমাজে।

শুধু কি উচ্চবিত্ত সংসারেই এ ধারা চলছে? তা নয়। নিম্নবিত্ত সমাজেও এরকম চরিত্র প্রকট হচ্ছে। সেখানে শ্রেণিভেদে দেখা যায়, বহুগামিতা কোনো কোনো পুরুষের ক্ষেত্রে অতিসাধারণ একটি ব্যাপার। আর মধ্যবিত্ত বরাবরই একটু রেখে-ঢেকে চলার পক্ষপাতি। তাই এই শ্রেণির মধ্যে যে, এক্সট্রা অ্যাফেয়ার্স থাকে না তা চূড়ান্তভাবে বলা যাবে না।

এবার আসা যাক, নারীদের প্রশ্নে। শুধু কি পুরুষরাই অবৈধ সম্পর্ক বা অতিরিক্ত সম্পর্কের চর্চা করে, নারীরা করে না? একটু চারপাশে তাকালেই উত্তরটি মিলে যাবে।

ইদানীং অনেক নারীকেই দেখা যায়, পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ছেন। এজন্য সংসার, সন্তান জলাঞ্জলি দিতেও প্রস্তুত থাকেন তারা। এরকম অনেক নজির নিকট অতীতেই দেখা গেছে। শিশু সামিউলকে হত্যা ছিল মায়ের পরকীয়ার ফলই।

শুধু পূর্ণবয়স্ক নারীই নয়, কিশোরী-তরুণীদের ক্ষেত্রেও এক্সট্রা অ্যাফেয়ার্স দেখা যায়। তবে এ বয়সের নারীদের ক্ষেত্রে অসম প্রেমের সম্পর্ক লক্ষণীয়। এখানেও অনেককে দেখা গেছে প্রায় তাদের বাবার বয়সি লোকদের (যারা অর্থ ও সামাজিক মর্যাদায় উচ্চস্তরে আসীন) সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করে। পরে তা শারীরিক সম্পর্কে উন্নীত হয়। এসব নারীর জানাই থাকে যে, তার প্রেমিক পুরুষটির সুখী একটি সংসার আছে। তারপরও ভালোবাসায় সে জড়িয়ে নেন ওই ব্যক্তিটিকে। চেষ্টা থাকে আগের সব মুছে দেওয়ার। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফলাফল দাঁড়ায় সম্প্রতি মারা যাওয়া কলেজছাত্রী

মুনিয়ার মতো।

এসব প্রেক্ষাপটে মনোবিদ ডক্টর হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, পারিবারিক একটি সুন্দর বন্ধনে যে সন্তান বেড়ে ওঠে না, পরিণত বয়সে এসে সে-ও তার পরিবারকে বন্ধনের মধ্যে রাখতে পারে না। তিনি বলেন, মানুষই একমাত্র প্রাণী যার ভেতর একটা মনোদৈহিক উন্নয়ন হয়। এই উন্নয়ন না ঘটলে বা ব্যাহত হলে পারিবারিক বন্ধনের অভাব হয়। অর্থাৎ শৈশব থেকেই সামাজিক দক্ষতার অভাব হয়। এর সঙ্গে মনোবিদরা যোগ করেন, বর্তমানে অনেক পরিবারেই পারিবারিক বন্ধনের নৈতিকতা বোধ জেগে উঠছে না। বাবা-মায়েরা এ জায়গাটাতে সন্তানকে তৈরি করতে ব্যর্থ হলে, পরবর্তী জীবনে সেই ছেলে বা মেয়েটিই তার জীবনেও পারিবারিক বন্ধন তৈরি করতে পারে না। তাই অন্যত্র

নিরাপত্তা, ভালোবাসা খোঁজে।

স্বামী বা স্ত্রী থাকার পরও অন্যত্র নারী-পুরুষের সম্পর্ক থাকার কারণ খুঁজতে গেলে মনোবিদ ডক্টর হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, মানুষ শুধু তার পাশবিক প্রবৃত্তির কারণে বা লিবিডু বা সেক্সুয়াল আর্জ- এগুলোর কারণেই আরেকটি সংসার করবে বা আরেকজনের সঙ্গে সম্পর্ক করবে তা কিন্তু নয়। তিনি বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধরে নিচ্ছি, এটা তার বিকৃত মনের আচরণ। এটি হতে পারে তার সামাজিক যে বিশ্বাস বা যে নৈতিকবোধগুলো আমরা লালন করি তার বাইরে এক ধরনের বিচু্যতির একটি জায়গা।

অর্থাৎ সামাজিক বিচু্যতি ঘটেছে।

সামাজিক রীতি-নীতির বাইরে গিয়ে সে দ্বিতীয় একজনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছে। দ্বিতীয়ত, হয়তো এই দ্বিতীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্যান্য (দুই পক্ষ থেকেই) আরও অনেক কিছু থাকতে পারে। নিরাপত্তার অভাব বা কমফোর্ট জোনের ব্যাপার থাকতে পারে। সেই জায়গাটি পারস্পরিক সম্মতির জায়গাতেও হতে পারে। এই বিষয়টিকে নৈতিকতার বিচারে নানাভাবে বিশ্লেষণ করা গেলেও, মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে একে 'বহুচারিতা' বলা হয়।

প্রশ্ন হলো- বহুচারিতা কি অপরাধ? নাকি সামাজিক বিচু্যতি-এ নিয়ে সমাজবিজ্ঞানী এবং নৈতিকতা শিক্ষাদানকারীদের মধ্যে নানা তর্ক-বিতর্ক চলে। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের দিক থেকে ডক্টর হেলাল বলেন, এ ধরনের বহুগামিতা বা বহুচারিতা সবার ক্ষেত্রে হবে না। যাদের প্রথম সম্পর্কের মধ্যে কোথাও কোনো ঘাটতি থাকবে, তখনই দেখা যাবে সে দ্বিতীয় সম্পর্কে যুক্ত হয়েছে। অথবা সে পারস্পরিক বোঝাপড়া, নিরাপত্তাবোধ ও জৈবিক

চাহিদা ইত্যাদিরও একটা গুরুত্ব সেখানে থাকবে।

নানা টানাপড়েনে একাধিক সম্পর্ক তৈরি না করে, সুন্দর পারিবারিক ও সামাজিক জীবনযাপনে নিজেকে সামাজিক দক্ষতায় গড়ে তোলার প্রতি তাগিদ দিলেন মনোবিদ ও সমাজবিদরা। এ জন্য প্রথমত, পারিবারিক বন্ধনের দৃঢ়তা দরকার। দরকার নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা এবং সামাজিক মূল্যবোধ। এ সবের সমষ্টিতেই অনৈতিক বা এক্সট্রা অ্যাফেয়ার্স কমে আসবে। বর্তমান সমাজে ক্রমবর্ধমান বিবাহ বিচ্ছেদ কমে আসবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মও

হবে সুস্থির, নিয়ন্ত্রিত এবং সুস্থ চিন্তাশক্তির ধারক।

লেখক : সাংবাদিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে