নারীকে হয়ে উঠতে হবে আরও অধিকার সচেতন :মীনা বড়ুয়া

প্রকাশ | ০৭ জুন ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ০৭ জুন ২০২১, ১৪:৪৭

আবদুর রহমান মল্লিক

যেসব গানের পাখি বাংলা গানকে আপন সাধনায় উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাদের একজন মীনা বড়ুয়া। বাংলাদেশের কিংবদন্তি শিল্পী, সংগীত জগতের এক প্রিয় নাম। দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা গভীর মমতায় তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন কণ্ঠের জাদুতে। তার কণ্ঠে ঝঙ্কৃত হয়েছে পলস্নীগীতি, ভাটিয়ালি, লালনগীতি, বিজয়গীতি, কীর্তন ও আধুনিক গানের অনবদ্য সুর। বাংলা ভাষাভাষি মানুষের কাছে তিনি প্রাণের শিল্পী। যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম/ কত রঙের পিরিতি তুমি জানো/আমার গলার হার খুলে নে ওগো ললিতে/প্রাণ বন্ধুর বিরহে মন মোর ছটফট ছটফট করে/মিলন হবে কত দিনে/যারে যা চিঠি লেইখ্যা দিলাম/ভালাবাসা আমার হলো না, ইত্যাদি জনপ্রিয় গান গেয়ে কোটি কোটি দর্শক স্রোতাদের মুগ্ধ-বিমোহিত করেছেন। গুণি এই শিল্পীর জন্ম গাজীপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চল, কেশরিতা গ্রামে। গানের প্রতি মীনার অসম্ভব ঝোঁক দেখে মা আশালতা ভৌমিকের কথায় তাকে হারমোনিয়াম কিনে দিয়েছিলেন দাদা অশোক ভৌমিক। মামাবাড়িতে গিয়ে পরিচয় হন যাত্রার সংগীত পরিচালক গোপাল সরকারের সঙ্গে। তার কাছেই প্রথম গানের হাতেখড়ি হয়। তার পরামর্শে মীনা বড়ুয়া গান শেখেন কাপাসিয়ার ওস্তাদ মমতাজের কাছে। মমতাজের সুবাদে তিনি গান শেখার সুযোগ পান কে এ মোনেমের কাছে। মোনেম তাকে সাহস জোগালেন রেডিওতে (রেডিও পাকিস্তান) গান গাওয়ার ব্যাপারে। ১৯৬৮ সালের কথা। ছোটবেলা থেকেই ম্যাচিউরড গলায় গান গাইতে পারতেন বলে ওস্তাদ মোনেম তাকে নিয়ে যান শিল্পী আবদুল লতিফের কাছে। আবদুল লতিফ তখন রেডিওতে সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে একটা সংগীত শিক্ষার আসর করতেন যেটা রেডিওতে প্রচারিত হতো। তিনি তার সঙ্গে মীনার পরিচয় করিয়ে দেন। তার হাত ধরেই শুরু হয় রেডিওতে গান গাওয়া। প্রথম দিকে তিনি উচ্চাঙ্গসংগীত ও আধুনিক গান করতেন। উচ্চাঙ্গসংগীত শেখেন পিসি গোমেজ, ফুল মোহাম্মদ খান, মুন্সী রইস উদ্দিন, কাদের জামেরী, জগনন্দ বড়ুয়া, নিতাই রায় প্রমুখের কাছে থেকে। সেই ধারাবাহিকতায় দেখা হয় খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে। আলতাফ মাহমুদ বললেন, নায়িকার ভয়েস দিতে হবে।,সেমতে তিনি শুয়োরানী দুয়োরানী ছবির গানে কণ্ঠ দিলেন। সে থেকে ২০/২৫টি ছবিতে গান করেন তিনি। তার সংগীত সাধনা পুরোদমে শুরু হয়ে যায়। আলী সাবের, খোদা বকশ বিশ্বাস, মোকসেদ আলী সাই প্রমুখের কাছে শেখেন লালনগীতি। কীর্তন শেখেন কৃষ্ণকীর্তন ও কমল দাসগুপ্তের কাছে। বিজয় সরকারের কাছে শেখেন বিজয়গীতি। আর আবদুল লতিফ, ওসমান খান ও মমতাজ আলী খানের কাছে পলস্নীগীতি। মীনা বড়ুয়া হিসেবে খ্যাতিটা এসেছে মূলত ৭৫ সালে। ওস্তাদ আবদুল লতিফের বাসায় গান শিখে আর ডেডিওতে প্রোগ্রাম করে। যারে যা চিঠি লেইখ্যা দিলাম সোনা বন্ধের নামেরে, গানটি রেকর্ডিং হলো। রেডিওতে প্রচারিত হলো। গানটিতে সারাদেশ আলোড়িত হলো। গানটির দোতরায় ছিলেন, কানাইলাল শীল ও গিরিলাল শীল। তখনই মানুষ মীনা বড়ুয়াকে চিনলো। বলতে গেলে সেটা একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল। তিনি বলেন, 'গ্রামের একটা মেয়ে একা গান শিখছে। সপ্তাহে একদিন রেডিওতে (ঢাকা) যাচ্ছে। আশপাশের লোকজন আমার রেওয়াজ শুনে ঠাট্টা-মস্করা করত। এমনকি রাস্তা-ঘাটেও টিজ করত। তখন সামাজিক রক্ষণশীলতা বেশি ছিল। সময়টা এখনকার মতো ছিল না।' রেডিওতে গান করার সূত্র ধরে পরিচয় হয় রেডিওর প্রডিউসার (ট্রান্সক্রিপ্ট সার্ভিস) ধর্মদর্শী বড়ুয়ার সঙ্গে। তার সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি সংগীত জগতের মানুষ। সংগীতের অসাধারণ সমঝদার। তার কাছে সর্বোতো সহযোগিতা পেয়েছেন। বিয়ের পর থেকে তিনিই পুরোপুরি গাইড করেছেন। খ্যাতিমান সঙ্গীত শিল্পী হলেও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সংসারী মানুষ। দুই সন্তান। ছেলে গৌতম বড়ুয়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে সম্মান ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। আর মেয়ে গৌরী বড়ুয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে সম্মান ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন। সংগীতচর্চা ও সংসারের পাশাপাশি নিজের লেখাপড়াও চালিয়ে গেছেন। নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এমএ করেছেন। প্রাচীন কলাকেন্দ্র চন্ডীগড়, ভারত থেকে সংগীতের সর্বোচ্চ ডিগ্রি, সংগীত বিশারদ ডিগ্রি অর্জন করেন। নারীর অগ্রযাত্রা সম্পর্কে মীনা বড়ুয়া বলেন,নারী তার জীবিকা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় যুগের পর যুগ সংগ্রাম করে আসছে। নারীর যা অর্জন তা তার একাগ্র চেষ্টার ফসল। অনেক ক্ষেত্রে তারা সফল হলেও এখনও তার কর্মপরিবেশ তৈরি হয়নি। তারা নানা রকম হয়রানি ও সহিংসতার স্বীকার হচ্ছে। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন হয়নি। নারীর সুরক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথাযথ ভূমিকা শুধু নয় সকলের মনোজাগতিক উন্নয়ন প্রয়োজন। তিনি বলেন, নারী যেন স্বাধীনভাবে চলতে পারে। একটি ছেলে যেমন স্বাধীনভাবে চলতে পারে নারীও যেন সেভাবে নিরাপত্তা নিয়ে চলতে পারে। নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী তৈরির ক্ষেত্রে নারীকে আরও অধিকার সচেতন হয়ে উঠতে হবে। সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে মীনা বড়ুয়া ভারত, থাইল্যান্ড, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও জাপানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পলস্নীগীতি, লালনগীতি, দেশের গান, হাসন রাজার গান, বিজয়গীতি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, জারি-সারি, মুর্শিদী, মারফতি গান পরিবেশন করেছেন। শিল্পী মীনা বড়ুয়া ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি সম্মাননা, কলকাতার চট্টগ্রাম সমিতি গুণীজন সম্মাননা, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী সম্মাননাসহ নানা পুরস্কার পেয়েছেন।