শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বকীয়তায় অনন্য অপ্রতিরোধ্য নারী

বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রকোপ এখনো চলছে। তাই সরকার খুলে দিতে পারছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এক ধরনের বৈরী পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা আনন্দহীন শৈশব ও মানসিক বিষাদ নিয়ে দিন যাপন করছে। যে কারণে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত শিক্ষক-অভিভাবকরা। দৈনিক যায়যায়দিনের পক্ষ থেকে আমরা যোগাযোগ করেছিলাম প্রতিশ্রম্নতিশীল কয়েকজন নারী শিক্ষকের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে আসে শিক্ষা ও নারীদের বিভিন্ন প্রসঙ্গ।
আবদুর রহমান মল্লিক
  ১৪ জুন ২০২১, ০০:০০
আপডেট  : ১৪ জুন ২০২১, ১৫:৫৫
মালেকা ফেরদৌস

মালেকা ফেরদৌস

কলেজ শিক্ষক
বরিশাল আদর্শ কলেজের সাবেক শিক্ষক মালেকা ফেরদৌস বলেন, সব নারীই স্বভাবত একজন শিক্ষক। নারী শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মমতা, আবেগ, প্রেরণার নানা অর্জন। একজন স্বশিক্ষিত নারীই হতে পারেন একজন সফল মা, একজন সফল শিক্ষক। নেপোলিয়ন বলেছিলেন, তোমরা আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটা সমৃদ্ধ জাতি দেব।’ সব পেশাতেই নারীর স্বচ্ছন্দ বিচরণ। বর্তমানে শিক্ষকতা পেশায় নারীর ভূমিকা ভীষণ বলিষ্ঠ ও সুবিদিত। একজন নারীর ধৈর্য অপরিসীম আর ধৈর্যই নারীকে সন্তানসম ছাত্রদের প্রতি মনোযোগী করে তোলে। আর এ পেশাতে নারী অনন্য।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের কারণে এক বছরেরও অধিক সময় ধরে বন্ধ রয়েছে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ সময় স্কুলের বাইরে থাকায় অনেক শিশুর মধ্যেই আচরণগত পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। শিশুদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। আচরণগত পরিবর্তনও দেখা যাচ্ছে। মোবাইল ফোনে গেমসের প্রতি অত্যধিক আসক্তি মাদকের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এর খারাপ প্রভাব সুদূরপ্রসারি। পরিবারের বাবা-মাসহ পরিবারের অন্য সিনিয়র সদস্যের শিশুদের মনস্তত্ত্ব বুঝে আচরণ করতে হবে, ধৈর্যসহকারে তাদের প্রতিটি কাজে পাশে থাকতে হবে। তাদের সাহচার্য দিতে হবে।
আমি মনে করি না যে করোনাকালে বাল্যবিয়ে বেড়েছে। গ্রাম, শহর মিলেই আমার জীবন। আমি যখন স্কুলে পড়তাম তখনও দেখতাম আমার সহপাঠীর ফোর-ফাইভে পড়া অবস্থায় বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। শহরেও দেখেছি অষ্টম-নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে হতে। এখন বরং মানুষ অনেক সচেতন অন্তত এসএসসি পাস করার পর মেয়েদের বিয়ে হয়।
একজন শিক্ষিত নারীর মতামত পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, জাতি যেভাবে মূল্যায়ন করে একজন সাধারণ নারীর মতামত সেভাবে কখনোই মূল্যায়িত হয় না। আর পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নিতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন অধিকাংশ নারী। নারীরা এই পেশায় এগিয়ে এলে মানুষে মানুষে যে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে, তা পরিবর্তিত হয়ে এক মানবিক বিশ্ব গড়ে উঠবে এটাই প্রত্যাশা। শিক্ষকতাই হোক নারীর প্রধান ও প্রিয় পেশা। আর এ যাত্রা হোক অপ্রতিরোধ্য।
মাজেদা বেগম (মুক্তি)
প্রধান শিক্ষক
পশ্চিমগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (নারায়ণগঞ্জ) প্রধান শিক্ষক মাজেদা বেগম (মুক্তি) বলেন, নারীরা অনেক এগিয়েছে। বিভিন্ন পেশায় সুনাম ও সাফল্যের সঙ্গে তারা কাজ করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নারীর ক্ষমতায়নের নীতি প্রশংসার দাবি রাখে। কর্মক্ষেত্রে নারীদের এই অংশগ্রহণ যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে তা দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি। কারণ যে কোনো কাজেই নারীরা অনেক বেশি দায়িত্বশীল, ঠিক যেমন দায়িত্বশীল সংসার কর্মে। মূল কথাÑ পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে।
করোনায় আজ সারাবিশ্ব বিপর্যস্ত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ অনেক দেশে। আমরাও তার ব্যতিক্রম নই। অনলাইনে আমরা নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছি। শিক্ষা কর্মকর্তা এবং শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়মিত মিটিং হচ্ছে। এ সময়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ঘাটতিপূরণে আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি।
বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র সব সময়ই সোচ্চার। তার পরও এটা হচ্ছে, যা কোনোমতেই কাম্য নয়। এ ক্ষেত্রে নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ সবারই জানা। তবুও ঠেকানো যাচ্ছে না। এ ধরনের বিয়ে বেশির ভাগই হয় অতি দরিদ্র পরিবারগুলোতে। পারিবারিক সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি বাল্যবিয়ে রোধে নৈতিক শিক্ষাও খুবই প্রয়োজন। দরিদ্র পরিবারকে আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বাল্যবিয়ে রোধ করা যেতে পারে। বাল্যবিয়ের মতো যৌতুক একটি মারাত্মক ব্যাধি। এটা রোধে প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রচারের মাধ্যমে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি এবং কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে। আমরা আমাদের শিক্ষকতা পেশার কারণে অভিভাবকদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যুক্ত। এসব বিষয়ে আমরাও তাদের মোটিভেশন দেওয়ার চেষ্টা করি।
নারীর ওপর সহিংসতা বেড়েছে। এর উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছেÑ ১. সামাজিক অবক্ষয় ২. নেশাজাতীয় দ্রব্যের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার ৩. সমাজে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ইত্যাদি। এটা উত্তরণের জন্য নারীকে সাহসী হতে হবে। তাকে মনে করতে হবে সে নারী নয়। তার পরিচয় মানুষ। নারীর ক্ষমতায়নের এই সময়ে নারীদের নানা পেশায় নিজেদের নিয়োজিত করতে হবে। আত্মরক্ষার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে, সেসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। প্রত্যেকটা সহিংসতার চরম শাস্তি বিধান করতে হবে এবং তা দ্রুত করতে হবে। বছরের পর বছর মামলা ঝুলিয়ে রেখে নয়।
আমি মনে করি নারী সমাজকে আরও সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আবার এমনটিও উচিত হবে না, কর্মক্ষেত্রে গিয়ে তারা ঘর-সংসার ভুলে যাবে। আমাদের সংস্কৃতির কথা মাথায় রাখতে হবে। খুব শালীন একটা সংস্কৃতিতে আমাদের বাস, সেটা মনে রাখতে হবে। এভাবে চললে নারীর অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে না বরং তার অবস্থান আরও সুসংহত হবে।
মোসা. খোদেজা খাতুন
প্রধান শিক্ষক
মেছিরপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (লালমনিরহাট) প্রধান শিক্ষক মোসা. খোদেজা খাতুন জানান, নারীর অগ্রযাত্রার আমি নিজেও একজন গর্বিত অংশীদার। জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। অর্থনীতিতে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া রাষ্ট্র দাঁড়াতে পারে না। বিশেষত গত দুই দশকে নারীর অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা অবশ্যই দেশকে শুভ বার্তা দেয়। নারীরা এখন বিভিন্ন সেক্টরে সক্রিয় অবদান রাখছে। তবে তাদের জন্য অনুকূল কর্মপরিবেশ ও যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। প্রযুক্তির এই যুগে পুরুষের মতো নারীরা সমসুযোগের ভিত্তিতে বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করলে দেশ আরও দ্রুত এগিয়ে যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
করোনার এই সময়ে শিশুশিক্ষা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। দীর্ঘ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এক জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছি আমরা। নির্দেশনা অনুযায়ী অনলাইন ক্লাস ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্ভাব্য যোগাযোগ করলেও পাঠদানে একটা ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেট সুবিধার অপ্রতুলতার কারণে অনলাইন ক্লাসের সুবিধা সব শিক্ষার্থী পাচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ না নেওয়ায় তাদের মনোদৈহিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। উঠোন বৈঠক, ওয়ার্কসিট বিতরণ, মূল্যায়ন ও বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়ার মাধ্যমে এই অবস্থা থেকে কিছুটা হলেও উত্তরণ সম্ভব।
বাল্যবিয়ে দীর্ঘদিনের সামাজিক সমস্যা। এটি প্রতিরোধে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি আমরা শিক্ষকরাও শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সচেতন করার চেষ্টা করি। বিভিন্নস্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বাল্যবিয়ের সঙ্গে জড়িতদের জেল জরিমানা করতে দেখি। ফলে এটি কমে এসেছিল। করোনাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সেই প্রবণতা আবার বেড়ে যাচ্ছে। এ থেকে আমাদের ছেলেমেয়েদের রক্ষা করতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে বাল্যবিয়ের কুফল ও যৌতুক নিয়ে আমরা আশপাশের মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করি।
নারী সহিংসতার শিকার হবে এটা কোনো সভ্য সমাজের প্রতিচ্ছবি হতে পারে না। বিষয়টি নিয়ে আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। শিশুদের নারী-পুরুষ সমমর্যাদার বিষয়ে ধারণা দিতে হবে। নারীদের সুশিক্ষিত করে, কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায়ন করতে পারলে এই সমস্যা অনেক কমে যাবে বলে আমি মনে করি। নারীদের তাই শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে তাদের বেরিয়ে এসে আত্মপরিচয়ে বলীয়ান হতে হবে।
সিফাত আরা হুসেন
সহকারী শিক্ষক
রামনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সিফাত আরা হুসেন জানান, নারীর অগ্রযাত্রাকে আমি অবশ্যই ইতিবাচক হিসেবে দেখতে চাই। আগের তুলনায় কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। নারী শিক্ষার হারও বেড়েছে। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়েও নারী শিক্ষার হার বেড়েছে। নারীরা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়ে সমাজের অগ্রযাত্রায় রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। মাতৃস্নেহের পরশ দিয়ে তারা জাতিগঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
করোনাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় লেখাপড়া যেমন ব্যাহত হচ্ছে তেমনি ভবিষ্যতের জন্য এক বিরাট সংকট তৈরি হ্েচ্ছ। পড়াশোনা থেকে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ সরে গেছে। গ্রামপর্যায়ে অবস্থা তো আরও বেহাল। অভিভাবকদের অশিক্ষা দারিদ্র্য অসচেতনতার জন্য শিক্ষার্থী ধীরে ধীরে পড়াশোনা থেকে দূরে সরে গেছে। কেউ কেউ দারিদ্র্য ঘোচাতে মা-বাবাদের সঙ্গে উপার্জনে অংশ নিচ্ছে। অটোপাসের কারণে নতুন শ্রেণিতে উঠলেও আগের শ্রেণির পড়াশোনা সম্পর্কেই ধারণা নেই তাদের। অনলাইন ক্লাস চালু করেছি। বাস্তবায়নে সীমাবদ্ধতা থাকলেও ঝরেপড়া রোধে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
দারিদ্র্য জয় করা যায়; কিন্তু অন্তরে শিক্ষার আলো না থাকলে ঘুটঘুটে অন্ধকারে মানুষ পথ হারায়। শিক্ষা আর সচেতনতার অভাবেই সমাজে বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটছে। অসচেতন অভিভাবকরা কুফল বিবেচনা না করেই বাল্যবিয়ের দিকে ঝুঁকে যায়। নিজেকে কন্যাদায়গ্রস্ত মনে করে সে দায় থেকে তাড়াতাড়ি মুক্তি পাওয়ার পথ খোঁজে। এই করোনাকালে সেই প্রবণতা আরও বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে অভিভাবক সভার মধ্যদিয়ে আমরা তাদের সচেতন করার চেষ্টা করি। দরিদ্রতা এ ক্ষেত্রে অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত।
নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে নারীকেই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। সেজন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তাকে স্বাবলম্বী হতে হবে। নিজের ভেতরের শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে হবে। পূরুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। একজন মা তার সন্তানকে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পোষণে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারেন। সুরক্ষা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় নারীকে শিক্ষা-দীক্ষায় আলোকিত ও সচেতন হতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে