জাতীয় অগ্রযাত্রায় বড় বাধা বাল্যবিয়ে

আয়েশা সিদ্দিকা সম্প্রতি বাল্যবিয়ে নামের পুরনো সামাজিক এই ব্যাধিটি আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। করোনা মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে এ সমস্যাটি জনগণের কাছে প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। সাধারণত বাল্যবিয়ে বলতে বোঝায় অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক বিয়ে। দেশীয় আইন অনুযায়ী মেয়েদের বয়স সর্বনিম্ন ১৮ এবং ছেলেদের ২১ বছর হলে বিয়ের জন্য প্রাপ্তবয়স্ক হয়। তার নিচে হলে তা বাল্যবিয়ে হিসেবে গণ্য হয়। বাল্যবিয়ের কারণে তছনছ হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কিশোর-কিশোরীর পড়ালেখার স্বপ্ন। আর এই বাল্যবিয়ে নিয়ে কী ভাবছেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণীরা? বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া প্রতিশ্রম্নতিশীল তরুণীরা জানিয়েছেন তাদের মূল্যবান অভিমত।

প্রকাশ | ০২ আগস্ট ২০২১, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
বিয়ে মানে অভিভাবকের দায়মুক্তি নয় দিলুয়ারা আক্তার ভাবনা শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে বিয়ের আইনত বয়স মেয়েদের সর্বনিম্ন ১৮ ও ছেলেদের ২১ বছর হলেও অধিকাংশ পরিবার এর আগেই সন্তানদের বিয়ে দিয়ে দেয়। যেটা বাল্যবিয়ে হিসেবে পরিগণিত। যে এলাকাগুলো দরিদ্রতা ও অশিক্ষার কবলে পতিত সেখানেই অধিক হারে বাল্যবিয়ে চর্চা করা হয়। মেয়েরা এর শিকার হয় বেশি। বিগত কয়েক বছরে বাল্যবিয়ের হার কমে এলেও বর্তমান করোনা পরিস্থিতি বাল্যবিয়ের ঘটনাকে দ্বিগুণ হারে বাড়িয়ে দিয়েছে। বাল্যবিয়ের কারণস্বরূপ আর্থ-সামাজিক দুরবস্থা, শিক্ষার নিম্নহার, কুসংস্কার, যৌতুক, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সামাজিক রীতিনীতি ও যৌন হয়রানিকে দায়ী করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনও এর একটি উলেস্নখযোগ্য কারণ। বাল্যবিয়ে চর্চা করেন এমন পরিবারের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে তারা সম্মান ও পবিত্রতা বজায় রাখতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সন্তানদের বিয়ে দেন। বাংলাদেশের অধিকাংশ সমাজব্যবস্থা ঘরে অবিবাহিত মেয়ে থাকাকে সম্মানের চোখে দেখেন না। যৌন হয়রানিকে উল্টো মেয়ের পরিবারের কলঙ্ক ও অপবিত্রতা বলে গণ্য করা হয়। মেয়েদের আর্থিক বোঝাস্বরূপ বিবেচনা করা হয়। বিয়ে দিয়ে দেওয়া মানে যেন দায়মুক্ত হওয়া। এতে অধিকাংশ কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকাল চলাকালে বিয়ে হয়ে যায় বিধায় তারা মানসিক ও স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগে। অপরিণত বয়সে সন্তান নিতে গিয়ে মা ও সন্তানের মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি পোহাতে হয়। ইউনিসেফসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রচারণায় বাল্যবিয়ে প্রথা কমিয়ে আনলেও বর্তমান সময়ে কোভিড-১৯ এর কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বাল্যবিয়ের হার আবার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন বাল্যবিয়ে চর্চা বন্ধ করা সময়ের দাবি। অতিসত্বর কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। আশঙ্কা অনিরাপত্তায় বেড়েছে বাল্যবিয়ে তৌহিদা আকতার শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় একটি সুস্থ জাতি পেতে প্রয়োজন একজন শিক্ষিত মা। অথচ আজ একুশ শতকে এসেও বাংলাদেশের ৬৬ শতাংশ মেয়ে এখনো শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, যার প্রধান কারণ বাল্যবিয়ে। বাল্যবিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ৪র্থ। এ দেশে ৫৯ শতাংশ মেয়ের ১৮ আর ২২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৫ বছরের আগে, যা খুবই হতাশাব্যঞ্জক। বর্তমানে করোনা মহামারিতে এ অবস্থা আরও নাজুক। লকডাউনে এ দেশে বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে ১৩ শতাংশ যা বিগত ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এই বয়সে যে মেয়ের কলম চলার কথা ছিল পরীক্ষার খাতায়, লকডাউনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সে কলম ব্যবহৃত হচ্ছে বিয়ের কাবিন নামায়। এ নিয়ে ব্র্যাকের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, লকডাউনে অভিভাবকের কাজকর্ম না থাকায় ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তার কারণে ৮৫ শতাংশ, স্কুল খোলার অনিশ্চয়তায় ৭১ শতাংশ এবং মহামারি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কায় অনিরাপত্তা বোধে ৬২ শতাংশ বেড়েছে বাল্যবিয়ে। সেভ দ্য চিলড্রেনের গেস্নাবাল রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ৫ লাখ মেয়ে বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে আছে যার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় ২ লাখেরও বেশি, যার প্রভাব বাংলাদেশের জন্য খুবই অশুভ। করোনা মহামারির কারণে ২০২৫ সালে বাল্যবিয়ের সংখ্যা ৬ কোটি ১০ লাখ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে আশঙ্কা করেছে সংস্থাটি। এভাবে ঝরে পড়েছে হাজারো শিক্ষার্থী, বৃদ্ধি পাচ্ছে বাল্যবিয়ের সংখ্যা। বিদ্যালয়মুখী করতে হবে শিক্ষার্থীদের মাহমুদা ভূঁইয়া কাজল শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাল্যবিয়ে এখন আমাদের সমাজে মহামারি আকার ধারণ করছে। এই করোনা মহামারিতে সবকিছু স্থবির। স্থবির শিক্ষা ব্যবস্থাও। প্রায় ১৮ মাস ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এরই ফলে বাল্যবিয়ের পরিমাণও বেড়ে চলছে। সূত্র মতে, বাংলাদেশে ৫৯ শতাংশ মেয়ে ১৮ আর ২২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৫ বছরের আগে। বাল্যবিয়েতে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। করোনা মহামারিতে ১৩ শতাংশ বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্র্যাকের গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাকালে কাজকর্ম হারিয়ে ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তার ফলে ৮৫ শতাংশ এবং ছেলেমেয়েদের স্কুল খোলার অনিশ্চয়তার কারণে ৭১ শতাংশ বাল্যবিয়ে বেড়েছে। বাল্যবিয়ে বৃদ্ধির ফলে নানারকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকরণের অন্যতম প্রতিবন্ধক হচ্ছে বাল্যবিয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া। এছাড়া বাল্যবিয়ের ফলে একজন কিশোরী তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন থাকে না। অল্প বয়সে গর্ভধারণ করার ফলে মাতৃমৃতু্যর এবং নবজাতক ও মায়ের অপুষ্টিহীনতায় ভোগার পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে মা ও নবজাতক। সমাজে নারীনির্যাতন বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে বাল্যবিয়ে। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার ফলে একজন কিশোরী তার স্বামীর আয়ের উপর নির্ভরশীল থাকে। এরফলে স্বামী তার স্ত্রীকে দুর্বল মনে করে যৌন ও শারীরিক নির্যাতন করতে থাকে। যার চিত্র আমরা সমাজে অহরহ দেখতে পাই। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন করা এবং ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়মুখী করার বিকল্প আর কিছু হতে পারে না। করোনার দোহাই দিয়ে যদি এভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রাখা হয় তাহলে হতাশা এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার ফলে বাল্যবিয়ের পরিমাণ আরও দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পাবে বলে আমি মনে করি। প্রয়োজন আইনের কঠোর বাস্তবায়ন নাঈমা আক্তার রিতা শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কোভিড-১৯ এর তান্ডবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতিসহ সব খাতেই পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু পিছিয়ে নেই বাল্যবিয়ে। করোনাকালীন এ পরিস্থিতি যেন বাল্যবিয়ের স্বর্ণযুগ। গত ৭ মাসে বাল্যবিয়ের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪ হাজার। সূত্রমতে, বাংলাদেশে ৫৯ শতাংশ মেয়ের ১৮ আর ২২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৫ বছরের আগে। বাল্যবিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। কিন্তু করোনা মহামারির মধ্যে এ দেশে ১৩ শতাংশ বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বিগত ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। জরিপে উঠে এসেছে, খাদ্য-সংকট, হতদরিদ্র ও অনিশ্চিত শিক্ষা ব্যবস্থা এর মূল হোতা। মহামারিতে পারিবারিক টানাপড়েনে ছোট্ট মেয়েকে বিয়ে দিয়ে সংসারে জনসংখ্যার চাপ কমাচ্ছেন অনেক অভিভাবক। বাল্যবিয়ে এভাবে আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়াটা দেশের জন্য নিঃসন্দেহে একটি অশুভ সংকেত। এতে বৃদ্ধি পাবে মাতৃমৃতু্য হার, গর্ভপাত, শিশুমৃতু্যর হার, অপরিকল্পিত গর্ভধারণসহ নানান সমস্যা। এ ছাড়া দেশের নারীসমাজ দিনকে দিন পিছিয়ে পড়বে, অশিক্ষিত মা অশিক্ষিত জাতি উপহার দিয়ে যাবে, সমাজে বেড়ে যাবে নারীনির্যাতন, নারীর প্রতি সহিংসতা এবং লোপ পাবে নারীর ক্ষমতায়ন ও দেশের উন্নয়নে নিষ্ক্রিয় রয়ে যাবে নারীসমাজ। এখনই সময় বাল্যবিয়ের লাগাম টেনে ধরার। অন্যথায়, আধুনিক যুগে এসেও পড়ে থাকতে হবে কয়েক যুগ পিছনে। এ ক্ষেত্রে প্রান্তিক জনগণের খাদ্যসংকট দূর করতে সরকারের বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থার চাকাকে সচল করতে বিকল্প পথ উদ্ধারে কালক্ষেপণের সুযোগ নেই। এছাড়া সর্বস্তরের জনগণকে সচেতন করে তুলতে একযোগে কাজ করতে হবে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে। বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন ২০১৭-এর কঠোর বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। ক্ষতিগ্রস্ত করে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রাশেদা আক্তার শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রাম \হ আইনের তোয়াক্কা না করেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো বাল্যবিয়ের ঘটনা অনেক বেশি ঘটছে। ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশে ৬৪% নারীর বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে। বাল্যবিয়ের ফলে মেয়েশিশুদের শারীরিক ও মানসিক জটিলতার পাশাপাশি তাদের বর্তমান ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এছাড়া বাল্যবিয়ের ফলে অপুষ্ট মা অপুষ্ট শিশুর জন্ম দেয় যার কারণে শিশুদেরও শারীরিক জটিলতা তথা প্রতিবন্ধী হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং এটা একটা পরিবারকে আর্থিক বিপর্যস্তসহ নেতিবাচক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রাখে। পাশাপাশি একটি কর্মক্ষম ও শিক্ষিত দক্ষ প্রজন্মের বদলে দেশকে উপহার দেয় অশিক্ষিত ও অদক্ষ জাতি। বাল্যবিয়ে হার গতবছর ৫১.৪০ শতাংশ থাকলেও বর্তমান করোনা বিপর্যয়ে তা আরও ১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছেলেশিশু ও মেয়েশিশুর পার্থক্য অনুধাবন করতে না পারা এবং অভিভাবকদের অসচেতনতার জন্য এটা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অনুন্নত জীবনযাত্রা, সামাজিক বিভাজন ও নানা কুসংস্কার, বখাটের উৎপাত, ধর্ষণের মতো চরম লালসাসহ সামাজিক নিরাপত্তার ভয়ে আইনের তোয়াক্কা না করে অভিভাবকরা বাল্যবিয়ে দিয়ে থাকে। বাল্যবিয়ে কেবল শিশুদের স্বাস্থ্য ও মানসিকতায় নয় পরিবার, সমাজ তথা জাতীয় উন্নয়নেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। তাই ব্যক্তি পরিবার ও জাতীয় উন্নয়নের জন্য এটি রোধ করতে হবে। এর জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি আইনের পূর্ণাঙ্গ ও কার্যকর প্রয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। আর ছেলেশিশু ও মেয়েশিশু পার্থক্যের মানসিকতা পরিহার করে উভয়কে শিক্ষার সুযোগ দিয়ে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে হবে। আর বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে দারিদ্র্য, অপুষ্টি ও অশিক্ষা রোধের পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা ও ধর্ষণ রোধেও সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। লেখক : শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়