বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বর্ণ বিদ্বেষের শিকার বাঙালি নারীরাও

ম ম সিনেমা, টিভি সিরিয়ালে এমনকি সাহিত্যেও কালো মেয়েদের জীবন হয় দুঃখের। অথচ ব্রিটেনে এখন প্রতিষ্ঠার শীর্ষে থাকা মডেল নওমি ক্যাম্পবেল একজন কৃষ্ণকায়া মেয়ে। আমেরিকার অনেক মেয়ে কৃষ্ণকায়া হওয়া সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠার শীর্ষে আছেন। ম ম
জুলফিয়া ইসলাম
  ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০
নওমি ক্যাম্পবেল

পাত্রপক্ষকে যদি বলা হয় তুমি যে বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে যাচ্ছো- তার কি কি গুণকে তুমি প্রাধান্য দেবে? অধিকাংশ পাত্রপক্ষই উত্তর দেবে পাত্রীকে ফর্সা হতে হবে। অর্থাৎ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গায়ের রংকে প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে, চেহারা সুন্দর না হলেও শুধু ফর্সা পাত্রীই সুন্দরী হিসেবে বিবেচিত। 'ফর্সাসুন্দরী পাত্রীচাই' এটি আমাদের বৈবাহিক বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত একটি সাধারণ শব্দ।

শরীরের চামড়াকে ফর্সা করার জন্য বাজারে অনেক ক্রিম আছে। ওই সব কোম্পানি কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছে। এখন শুধু মেয়েদের নয় পুরুষদেরও প্রলোভিত করা হচ্ছে ফর্সা চেহারার জন্য। ইদানীং বলিউডের বিজ্ঞাপনে তারকা শাহরুখ খানও ক্রিমের কোম্পানির বিজ্ঞাপন করে থাকেন। আমাদের দেশে ফর্সা হওয়াটাকে নিয়ে এখন বিজনেস চলছে। গায়ের রং নিয়ে ব্যবসা চলছে বিশ্বের যে কোনো স্থানে।

গায়ের রং হিন্দি ও ইংরেজি ছবিগুলোকে প্রভাবিত করতে ছাড়েনি। সাধারণত ছবির ভিলেনরা যারা গুন্ডা প্রকৃতির বদমায়েশ এমনকি ধর্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য যেসব চরিত্রকে বেছে নেওয়া হয় তাদের গায়ের রং কালো করে দেওয়া হয়। সিনেমা, টিভি সিরিয়ালে এমনকি সাহিত্যেও কালো মেয়েদের জীবন হয় দুঃখের। অথচ ব্রিটেনে এখন প্রতিষ্ঠার শীর্ষে থাকা মডেল নওমি ক্যাম্পবেল একজন কৃষ্ণকায়া মেয়ে। আমেরিকার অনেক মেয়ে কৃষ্ণকায়া হওয়া সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠার চরমে আছেন। সেই সব কৃষ্ণকায়া নায়িকারা হলেন শ্যারোনা ওয়ারেন, মারিয়ানা জাবাপতিস্তে, মেসি গ্রে, জড়োপিংকেট স্মিথ, রেগিনাকিং, কুইনলতিফা, ট্রাসি থোমাস, রোজারিও ডাওসন, থান্ডিনিউটন, কেরি ওয়াশিংটন, হুপি গোল্ডবার্গ, হালে বেরি, ডায়হান কারেল, অ্যাঞ্জেলা ব্যাসেট, অলফ্রে উজার্ড প্রমুখ। এদের রূপেরচ্ছটায় উদ্ভাসিত পাশ্চাত্যের সিনেমা ও টিভি পর্দা। অথচ কতজন কালো মেয়ে আমাদের প্রতিষ্ঠার শিখর ছুঁয়েছেন। এমন কথা কি ভাবা যায়? শরীরের চামড়ার উপরের ত্বককে বলা হয় এপিডার্মিস। এই স্তরে থাকা মেলানোসাইটের গুণের প্রভাবে শরীরের রং নির্ধারিত হয়ে থাকে। ফর্সা ও কালো চামড়ার ভেতরে সমান পরিমাণে মেলানোসাইট থাকে। কিন্তু তাদের শরীরে থাকা মেলানোসাইটিসের গুণের প্রভাবে শরীরের রং নির্ধারিত হয়ে থাকে। কালো মানুষের শরীরে বেশি পরিমাণে মেলোনিন পাওয়া যায়। বিষুবরেখার কাছাকাছি মানুষের শরীরের মেলোনিনের মাত্রা বেশি থাকে।

কালো চামড়া নিয়ে অনেক ভ্রান্তধারণা আছে। যার কোনো বৈজ্ঞানিক কারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন। ধারণা করা হতো আর্যরা ফর্সা তাই যারা ফর্সা তারা আর্য জাতি থেকে উদ্ভূত। এবং দ্রাবিড়রা কালো হয়ে থাকার জন্য দক্ষিণের লোকজনের শরীরের রং কালো হয়ে থাকে। তাই যাদের রং বাদামি তারা আর্যদের সঙ্গে দ্রাবিড় কিংবা আদিবাসীদের বৈবাহিক সম্পর্কের স্বরূপে উদ্ভূত হয়েছেন। এগুলো সঠিক কোনো ধারণা নয়। এ উপমহাদেশে আর্য আক্রমণ মতবাদটি এখন বিতর্কিত। নৃতত্ত্ববিদদের অনেকেই এর বিরোধিতা করে থাকেন।

দক্ষিণের লোকজন কেউ কেউ আবার অনেক ফর্সা হয়ে থাকেন। আরেকটি ভ্রান্ত ধারণা যে, যারা অভিজাত শ্রেণি থেকে এসেছেন তাদের গায়ের রং ফর্সা হয়। শ্রমিক শ্রেণির বা আদিবাসীদের গায়ের রং কালো। এই উপমহাদেশের আদিবাসীদের অস্ট্রালয়েড সম্প্রদায়ের বলে মনে করা হলেও অনেক আদিবাসী এই সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত নন। এ উপমহাদেশের আদিবাসীদের অস্ট্রালয়েড সম্প্রদায়ের বলে মনে করা হলেও অনেক আদিবাসী এই সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত নন। এই উপমহাদেশের অধিকাংশ মানুষ শংকর সম্প্রদায়ের। শঙ্কর শব্দটি সংস্কৃত থেকে আনিত। এর অর্থ হচ্ছে মিশ্রণ। আসলে আমরা মনুষ্য জাতিরা এক অদ্ভুতবর্ণ বিদ্বেষের দ্বন্দ্ব নিয়ে বেঁচে আছি। পাশ্চাত্য জগতের বর্ণবিদ্বেষ নিয়ে আমরা নিন্দা করে থাকি। অথচ নিজেদের মধ্যে থাকা বিদ্বেষের প্রতি আমরা চোখ বন্ধ করে থাকি। পাশ্চাত্য জগতে বসবাসকারী অনেকে এ উপমহাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী নন।

বর্ণ বিদ্বেষের আরেকটি রূপ হলো নারী বিদ্বেষ। ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রফেসর সিলিয়া আর, ডেল্ডার একজন নারীবাদী শাস্ত্রজ্ঞ বর্ণ বিদ্বেষ। তিনি যে নারী বিদ্বেষের সঙ্গে জড়িত এটি বোঝানোর জন্য তিনি একটি নতুন শব্দ তৈরি করেছেন যাকে বলা হয় 'ওথেলো স্মিথ' বা ওথেলোফিলিয়া'। তার মতে আমেরিকার মানুষের মনে এক ধরনের ফ্যান্টাসি আছে তারা কালোপুরুষ ও সাদা চামড়ার নারীদের মিলন চায়। তাদের মতে এটি একটি বিদ্বেষী বিষয়। আপাতদৃষ্টিতে এটি বর্ণ বিদ্বেষী হলেও এই ফ্যান্টাসির ওখানেও বর্ণ বিদ্বেষ আছে। এখানে সাদা চামড়ার নারীদের এবং কালো চামড়ার নারীদের অর্থাৎ এখানেও নারীর ওপর পুরুষ কর্তৃত্ব করছে। ওথেলো আসলে নারীর সাংস্কৃতিক রূপ। এখানে নারী বিদ্বেষ ক্রমান্বয়ে বর্ণ বিদ্বেষে পরিণত হয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে