শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

করোনায় তছনছ রোকেয়া পারভীনের সাজানো সংসার

রহমান মলিস্নক
  ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

জীবন আসলেই যেন পদ্মপাতার শিশির বিন্দু। কখন কে পিছলে পড়ে তা বোঝার উপায় নেই। কিন্তু একটি মানুষের আকস্মিক চলে যাওয়াটা যে কতটা বেদনার তা তার স্বজনরাই কেবল গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেন। হৃদয়ে যে অসীম শূন্যতা আর হাহাকার তৈরি করে তা কাউকে বলে বোঝানো যায় না। ঠিক এমন পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে বাংলা সাহিত্যের ভোরের পাখিখ্যাত বিহারী লাল চক্রবর্তী বলেছিলেন, 'সর্বদাই হু হু করে মন, বিশ্ব যেন মরুর মতন।'

রোকেয়া বেগমের সংসারটা ছিল সাজানো বাগান। স্বাস্থ্য বিভাগের অল্টারনেটিভ মেডিকেল কেয়ার (এএমসি) শাখার পরিচালক স্বামী আর দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে দিনগুলো সত্যিই সোনার খাঁচায় বন্দি ছিল। করোনার ভয়াল থাবা এক লহমায় কেড়ে নিয়ে গেল বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন প্রিয়তম স্বামীকে। একজন চিকিৎসক হিসেবে, সিভিল সার্জন হিসেবে স্বামী এফবিএম আবদুল লতিফ নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন মানুষের সেবায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন পরিচালক হিসেবে সহকর্মীদের কাছে ছিলেন একান্ত আপনজন।

করোনাকালে মানুষ যখন আতঙ্কিত, প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসাসেবা না পেয়ে মানুষ যখন দিশাহীন তখন তার মধ্যে মানবিক বোধ আরও তীব্র হয়ে ওঠে। একটি কথা তার মনে জেগে উঠেছিল, মানুষের জন্য কিছুই করতে পারছি না। করোনাকালে নিয়মিত অফিস করার বাধ্যবাধকতা যখন ছিল না তখন তিনি মানুষের সাহায্যার্থে ছুটে বেড়ান হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। পরিদর্শন করতে থাকেন সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো। রুটিন কাজের বাইরে গিয়ে তিনি দুস্থ আর অসুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। গত বছর লকডাউনের পর অফিস করতেন নিজের গাড়িতেই। নিজেকে সেইফ রেখে চলাফেরা করতেন। তিনি অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জীবনযাপন করতেন। তাই পরিবারের কেউ তাকে নিয়ে কোনো আশঙ্কা অনুভব করেনি। ঈদ করতে তিনি গেলেন বগুড়ায়। ১ জুলাই ঈদ উদ্‌যাপনের পর জ্বর অনুভব করেন পরের দিন। খাবার খেতে গিয়ে কোনো স্বাদ পাচ্ছিলেন না। সেখানে ইবনে সিনার ডাক্তার দেবাশীষ গুপ্তের পরামর্শ নেন ও পরে ৪ জুলাই বগুড়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। সিনিয়র এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তার প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়ার জন্য ডাক্তার-নার্স কারও কোনো আন্তরিকতার কমতি ছিল না। এমন আন্তরিক সেবায় তিনি ঢাকায় যাওয়ার প্রস্তাবও নাকচ করে দেন। তিনি না চাইলেও এক অনাবিল আন্তরিক পরিবেশ উপেক্ষা করে তাকে চলে যেতে হলো। ২০২০ সালের ৩০ অক্টোবর তার এলপিআরে যাওয়ার কথা থাকলেও সে পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করতে পারলেন না। প্রিয়তম জীবনসঙ্গিনী আর দুই ছেলেমেয়ের বুকে শূন্যতা সৃষ্টি করে চলে গেলেন তিনি। ছেলে মুন্তাকীম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। মেয়ে ফাতেমা বিনতে আবদুল লতিফ ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। কেউই তাদের আদর্শবান পিতাকে আগলে রাখতে পারেনি। বাবাকে হারিয়ে এখন তারা নীরবে-নিভৃতে কাঁদে। স্ত্রী রোকেয়া বেগমের হৃদয়জুড়ে এখন শুধুই হাহাকার। মিরপুর এক নম্বরের তার চারতলার বাসাটি এখনো যেন তার অফিস থেকে ফেরার প্রতীক্ষা করে। স্বামীর ব্যবহৃত কলম, ব্যাগ, চশমা, জুতা তিনি সযতনে রেখে দিয়েছেন। স্মৃতিগুলো বুকে আগলে তিনি প্রতিটি দিন পার করেন। দিন যায় আর তার স্মৃতিগুলো যেন চোখের সামনে আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। যে স্বামী তাকে শুধু ভালোবাসেননি তাকে স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতেন তার অনুপস্থিতি তার পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি ক্ষণে ক্ষণে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। 'এ অনন্ত চরাচরে, সবচেয়ে পুরাতন কথা, সবচেয়ে গভীর ক্রন্দন, যেতে আমি দেবো না তোমায়।' স্বামী তাকে আদর করে বুড়ি বলে ডাকতেন। সারাজীবন তিনি এ নামেই ডেকেছেন। সেই প্রিয় নামে আর কেউ ডাকবে না। তবুও তিনি যেন সন্ধ্যা হলেই তার পদধ্বনি শুনতে পান। এই বুঝি অফিস সেরে বাসায় ফিরে এলেন। মাঝেমধ্যেই স্বামীর ভাবনায় সম্বিত হারিয়ে ফেলেন। মেয়ের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলতে গিয়ে তার কণ্ঠ আড়ষ্ট হয়ে আসে। কেঁদে ফেলেন, নিজেরই যেখানে সান্ত্বনা নেই, মেয়েকে কী সান্ত্বনা দেবেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে