হাজারো হারকে কণ্ঠহার করেই এক অপরাজিতার জন্ম

প্রকাশ | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

ফাতেমা ইরাজ
যুগ যুগ ধরে তৈরি নাটক, সিনেমায় কিংবা উপন্যাসের পাতায় দেখে এসেছি, পুরুষ কবি সাহিত্যিকরা তাদের কবিতার জন্য পাহাড় ভ্রমণে যান, সমুদ্র ভ্রমণে যান, দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও যান তাদের স্ক্রিপ্ট লিখতে। অনেকেই তাদের কোনো বিখ্যাত বইয়ের লাইন উলেস্নখ করে বলেন, 'আমি অমুক দিন, অমুক পাহাড়ে বসে এই লাইন দুটো লিখেছিলাম।' কিন্তু এমন বর্ণনা খুব কমই লেখিকাদের কাছ থেকে শোনা যায়। তাদের সাহিত্যচর্চার জায়গা হলো শুধু মাত্রই তার ঘর। আর সে ঘরেও থাকে নানান রকম প্রতিবন্ধকতা। থাকে সময়ের সংকট। একজন পুরুষ বাইরে কাজ করার পর কম হোক বেশি হোক কিছুটা সময় নিজের জন্য বাঁচিয়ে রাখতে পারে, কিন্তু একজন নারী সবার আগে ঘুম থেকে জাগে, তারপর সবার সকালের নাশতা প্রস্তুত করে সবাইকে খাইয়ে ফের রান্নার কাজে লেগে যায়। তার মধ্যে পুরুষদের বাইরে যাওয়ার আনুষাঙ্গিক কাজ, সন্তানকে প্রস্তুত করে স্কুলে পাঠানো, কিংবা দিয়ে আসা। দুপুরের রান্না শেষে ঘর গোছানো পরিষ্কার করা, ফের খাবারের আয়োজন। বিকালে সবার নাশতা, বাচ্চাদের নিয়ে খেলাধুলা করা, বাচ্চাদের পড়ানো, ফের রাতের রান্না। এভাবেই সমস্ত দিন কেটে যায় সংসার-ধর্ম পালন করতে করতে। যেমন ঘুম থেকে ওঠে সবার আগে, তেমনি ঘুমোতে যায় সবার শেষে। রাতের খাবার খাওয়া হলে তা পরিষ্কার করে, এমনকি অনেক সময় সবার বিছানায় পানির বোতলটা পৌঁছে দিয়ে, সবাই শোয়ার পরে সে বিছানায় যায়। সারাদিনের ক্লান্তির পরে আর ইচ্ছে করে না, লিখতে বসতে, কিংবা যে গান গায় রাতে তার গাওয়ার সুযোগ হয় না বা যে ছবি আঁকে তার তুলি চলে না ক্লান্তিতে। আবার যদি কলম চলে, তুলি চলে তবে তা বাধ্য হয়ে মাঝ পথে ফেলে রেখেই ঘুমাতে যেতে হয়। তাকে যে সকাল বেলায় উঠতে হবে। বাড়ির পুরুষরা অফিসে যাবে, বাচ্চারা স্কুল যাবে। আর যখন এই নারী বাইরে কাজ করে, তখন তার ঘর, কর্মক্ষেত্র সামলে আর কলম, তুলি ধরা হয়েই ওঠে না। নারীর সাহিত্যচর্চায় ভোগান্তি সংসারেই সীমাবদ্ধ নয়। সে চাইলেই সহজে বের হয়ে সভা-সেমিনারে যোগদান করতে পারে না। যদিও বা বের হয়ে আসে সে চরমভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। কিংবা দু-কলম লেখা পত্রিকায় ছাপতে, কিংবা একটা বই প্রকাশ করতে বারবার করে ঘুরপাক খেতে হয়, নানান জায়গায় নানান রকম যৌন হেনস্তার শিকার হতে হয়। কেউ প্রতিবাদ করে, কেউ বুঝেও না বোঝার ভান করে, কিংবা কারও কলম থেমে যায়, আর গোপনে ছটফট করতে থাকে। তবুও কেউ কলম চালিয়ে নিয়ে যায়, সব বাঁধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে, কেউ কেউ নানা রকম পারিপার্শ্বিক যন্ত্রণাকে কলম দিয়ে উগরে ফেলে কাগজের বুকে। কোনো মা তার বাচ্চাকে পায়ে শুইয়ে দিয়ে লিখতে বসে যান তার হৃদয়ের কথা, কেউ রান্না ঘরে বসেই জন্ম দেয় কোনো মহাকাব্যের। কেউ চুলা থেকে কয়লা তুলে এঁকে ফেলেন তার স্বপ্ন। কেউবা সবজি কাটতে কাটতে, বাচ্চাকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতেই গেয়ে ওঠেন কালজয়ী গান। কেউ প্রথমবারেই জিতে যায়, কেউ হেরে যায়, একবার চেষ্টা করে, দুবার চেষ্টা করে, শতবার চেষ্টা করে উঠে দাঁড়ায়। আর এভাবেই হাজারো হারকে কণ্ঠহার করেই একজন অপরাজিতার জন্ম হয়।