ক্যামেরাম্যান এদিকে ক্যামেরা ঘোরাও

প্রকাশ | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০০:০০

মালা মিত্র
একে কোরোনা কাল, তার ওপর কেউ বলে মৌরি, জিরে, জোয়ান, দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ, পেঁয়াজ, রসুন, মোটামুটি রান্না ঘরের সব মসলা মিশিয়ে দশ মিনিট ফুটিয়ে লেবু মধু দিয়ে খেতে, কোরোনার প্রটেকশন এ, প্রাণের দায়ে সবই খাচ্চি মুখটি বুজে। তার ওপর ওজন বেড়ে যাচ্ছে হু হু করে, নানা জনের পরামর্শ মত, চিরতার গস্নাস, কালো মগের কাপ, ভাতের সঙ্গে উচ্ছে, করলার পিন্ডি চটকাচ্ছি নিয়ম করে, এত সাবধানতা নিয়ে, জল খাবারের পরে একটি হৃষ্টপুষ্ট কালোজাম, শক্তিগড়ের এক আধটা ল্যাংচা, আর রাতের খাবারের শেষ পাতে একটি নাদুসনুদুস রাজভোজ মায় একটা রসে টইটম্বুর রসগোলস্না তো সাঁটাচ্ছি, ইতনা তো বনতা হ্যায় না? আর শীত তো বারবার আসে না, বছরে ও-ই একটিবার, তা মশাই, পুরুষ্টু ক্ষিরের পাটিসাপটা, চুষিপুলির পায়েস, গোকুল পিঠে, রসবড়া, মুগশাউলি বছরকার তো খেতেই হয় নাকি? সে যাই হোক ভাইজির বিয়ে, আমি তো ডায়টিংয়ে আছি, সবাই মিলে ধরল, বলল, 'আরে আরে খা খা সোনাইয়ের তো একবারই বিয়ে নাকি?'। আইবুড়ো ভাতের সকালে মটরশুঁটির কচুড়ি, সাদা আলুর তরকারি বোঁদে এই তো খাওয়া। দুপুরে ভ্যারাইটি মাছের আইটেম ছিল, তৃপ্তির সঙ্গে সব খাবারই খেলাম। সে যাক, গোধূলি লগ্নে বিয়ে, পাক্কা দুই ঘণ্টা ধরে সাজুগুজু করে এক্কেবারে ফুরফুরে মন নিয়ে বর-কনের বসার মঞ্চের পাশে জমিয়ে বসলুম, ভাবখানা এই, ক্যামেরাম্যান এদিকে ক্যামেরা ঘোরাও। তো সব আত্মীয়-স্বজন মিলে খোশগল্পে যখন মশগুল, হঠাৎ আমার এক সম্পর্কে বৌদি এসে বললেন, 'মানু কি মোটা হয়েছিস রে! কি বিচ্ছিরি লাগছে তোকে'। যিনি বললেন তিনিও গায়ে-গতরে বেশ! সবার মাঝে আমি তো ভ্যাবাচ্যাকা! ভীষণ অভিমান নিয়ে মনে মনে বললুম, ধরণি দ্বিধা হও, আমি তোমার মধ্যে সেঁদুই! যাই হোক বিয়েবাড়ির মাটনবিরিয়ানি, মাটনচাঁপ, রসমালাই-টালাই দিয়ে খেয়ে-দেয়ে একটা পান চিবোতে চিবোতে সে দুক্কু ভোলা গেল। কোভিড-১৯ মানুষকে খুব স্বাস্থ্য-সচেতন করেছে, রং-বেরঙের মাস্ক সুন্দর সুন্দর হাতের কাজ করা, সবাই জামা-কাপড়ের সঙ্গে ম্যাচ করে পরেছে, সবাইকে বেশ লাঙলটানা বলদ বলদ লাগছে, এক সুদর্শনা ভাইজি, দামি সুন্দর লেহেঙ্গা পরে, মুখে ফিনফিনে নেটের কাজকরা মাস্ক পরে দুলতে দুলতে এসে বলল, 'পিসিমণি আমাকে কেমন লাগছে?' আমি বললুম, 'দারুণ দেখাচ্ছে তোকে শীর্ষা, একদম আরব্য রজনীর নায়িকার মতো'। সে তো খুশি হয়ে উড়তে উড়তে চলে গেল। সবাই বলে মর্নিং ওয়াক করো, তা আমার আবার খুব সকালে ওঠার ওভ্যেস নেই, বিকেলে পাঁচটা থেকে ছটা দিদি নাম্বার ওয়ান দেখি, বিজ্ঞাপন বিরতির মাঝখানে, টুকটুক করে, সালোয়ারটা কামিজটা গলিয়েনি, ছটা বাজতেই স্পোর্টস জুতো পরে, ঝিলের ধারে এক রাউন্ড ইভনিং ওয়াক করতে যাই। করোনার ভয়ে ফুল প্রোটেকশন নিয়ে, বেশ গুছিয়ে নাক থেকে থুতনি পর্যন্ত মেডিকেল ফেস মাস্ক পরে দুগ্‌গা দুগ্‌গা করে হাঁটা দি, সেদিন ঝিলপাড় ধরে হাঁটছিলাম, মধ্যবয়সি এক মহিলা, হাতে ব্যাগ, মাস্কটি গুছিয়ে নাকের নিচে বাঁধা, মাথায় সার্জনদের মতো হেয়ার ক্যাপ, বোধহয় বাজার করে ফিরছিল, ছুটতে ছুটতে এসে ভাব করল, 'দিদি দাঁড়াও, 'আমিও দাঁড়িয়ে গেলুম, সে বেশ শাসনের সুরে বলল, 'দিদি মাথায় কেন হেয়ার ক্যাপ পরোনি?' পাড়ায় কে কোথায় এই কদিনে গত হয়েছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বলে যেতে লাগল, আমি বললুম, 'ভারি ভুল হয়ে গেছে ভাই, আর এমন হবে না'। রাস্তার যত কুকুর ছিল ঘেউ ঘেউ করে পায়ে পায়ে চলতে লাগল, আমি ভয় পাচ্ছি দেখে সে কুকুরদের পরমাত্মীয় জ্ঞানে নানা নামে কালু ভুলু এসব বলতে বলতে চলল, 'অ্যাই চলে আয় তোরা সব, তোদের খাবার ঘরে সব গুছোনো আছে, একটু পরে আসবি সবাই, এই বলে ব্যাগ থেকে বিস্কুট প্যাকেট খুলে তাদের দিতে থাকল। এবার কলরব কমতে সে খুব খুশি মনে বলল, জানো দিদি, সাঁতরাগাছি স্টেশনে পোদানমন্ত্রী এসেছিল গো, সে কি সুন্দর, নাচ, গান, নাটক, ফিরে আসতে মন করছিল না, রান্না করতে হবে বলে চলে এলুম', আমি তো হতভম্ব, ঝিলের অপর পাড়াটাই স্টেশন, মাইকের আওয়াজও আসছে ভেসে, আমি বললুম, তুমি ভুল করছ ওটা মুখ্যমন্ত্রী হবে, সে সরল বিশ্বাসে বলল, 'হঁ্যা গো তাই!' এবার তার ফ্ল্যাট আসাতে সে যাইগো দিদি আবার দেখা হবে বলে, চলে গেল। ঝিলের পাড় ঘুরে স্টেশেেন এসে দেখি, কোনো এক পার্টির মিটিং গান-বাজনা চলছে, টোটোর উদ্দেশ্যে রাস্তার পাশে এসে দেখি, এক টোটো ড্রাইভার, মাস্কটিকে চোখের উপর তুলে জমিয়ে বসে বসে ঘুমাচ্ছে, যাবে নাকি জিজ্ঞেস করাতে, ঘুম জড়ানো গলায় বেশ বিরক্তির সঙ্গে না, বলল। আমার ইভনিং ওয়াকে কোনোদিন, কোনো না কোনো পরিচিত অপরিচিত ধরবেই ধরবে, পুরনো চুলস্নু খেকো ড্রাইভার এসে পথ আটকে বলবেই, 'মা জী আপ ক্যায়সা হ্যায়?', আচ্ছা আপনারাই বলুন, এরপর যদি ওয়াকিং ছেড়ে, চপসহ মুড়িমাখার সঙ্গে সিরিয়াল দেখতে থাকি তাহলে কি আমার দোষ হবে?