প্রতিবন্ধী মায়ের সন্তান সুস্থ হয়

প্রকাশ | ২৯ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

সুমনা ইসলাম
অপসংস্কৃতির অনেকগুলো ধারার মধ্যে কুসংস্কার একটি। কুসংস্কার বাংলাদেশের একটি প্রধান অপসংস্কৃতি। সে কুসংস্কারটি যদি হয় নারীর জন্য তাহলে তো সে নারীর কপালে দুঃখ আছে নিশ্চয়ই। আর নারী হয়েও সে যদি হয় একজন প্রতিবন্ধী, সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার তো দুইয়ে দুইয়ে চারের মতো। সেই প্রতিবন্ধী নারীর জীবন কলুর বলদের চেয়েও খারাপ হবে। বইকি হতেই হবে। নারীর দোষ ধরা এটা তো সমাজের নৈতিক কাজের মধ্যে একটি। সমাজের এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে সেই মান্ধাতার আমলের ধারণাগুলো আজও রয়েছে। তাদের ধারণা প্রতিবন্ধী নারী সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম। এটা সম্পূণর্রূপে ভুল বলে অনেক নারী প্রমাণও দিয়েছে। তারপরও এ অন্ধ তৈরি করা সমাজের চোখ আজও খোলে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় দশ ভাগ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধী। কেউ শারীরিকভাবে আর কেউ মানসিকভাবে। কেউ জন্মগত আর কেউ ভাগ্য বিড়ম্বনায়। দুভার্গ্যক্রমে প্রতিবন্ধীদের স্বাভাবিক বিকাশের পথ হয়ে যায় রুদ্ধ। বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও মোট জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ প্রতিবন্ধী রয়েছে। যা এই ছোট দেশের জন্য এক বিরাট সমস্যা। তার ওপর প্রয়োজনের তুলনায় অধিক জনসংযোগ, জনসংখ্যার চাপে যাতায়াতের পথ অল্প সময় অসময়ে দুঘর্টনা যেন দিন দিন প্রতিবন্ধীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতিবন্ধীদের উন্নয়ন ও সম-অধিকারের কথা বিবেচনা করলে দেখা যায় প্রতিবন্ধীদের অবস্থান অবহেলিত ও উপেক্ষিত। প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম নিলে যেমন সমাজ, পরিবার মাকে দোষারোপ করে আবার নারীর জন্যই কুসংস্কার দঁাড় করায়, প্রতিবন্ধীর গভের্ সুস্থ সন্তান জন্মায় না। সেসব মান্ধাতার কথা এখন মিথ্যে বলে পরিচয় করছে আমাদের সৃষ্টি। একটি প্রতিবন্ধী সন্তান জন্ম হলে মাকে অনেক সময় সমস্যায় পড়তে হয়। তার ওপর সে মা যদি হয় কমর্জীবী তাহলে তো আরও সমস্যা। প্রতিবন্ধী শিশুর ইতির মা রাহেলা বেগম চাকরিজীবী। নিজেই দীঘর্শ্বাস আর আফসোস করে বলেন, চাকরির জন্য সন্তানকে সময় দিতে পারি না। একজন স্বাভাবিক লোকের চেয়ে একজন প্রতিবন্ধীকে অনেক বেশি সময় দেয়া প্রয়োজন; কিন্তু অথের্র পিছন ছুটতে গিয়ে পরিবারগুলো সে অনুপাতে সময় দিতে পারে না। এতে একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী অনেকটা একা অসহায় জীবনযাপন করে মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। একজন প্রতিবন্ধী স্বাভাবিকভাবে সবার সঙ্গে চলতে ফিরতে বা শিক্ষা নিতে পারে না বলে সুস্থ স্বাভাবিকরা একটু অন্য চোখে দেখে ওদের। কিন্তু পরিবার সমাজ বা শিক্ষা করার সুযোগ পেলে জন্মগত প্রতিবন্ধীরা অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসতে পারে। কিন্তু আমাদের সমাজ সেসব ব্যবস্থা করে না। প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা শিক্ষা প্রতিবন্ধীদের জন্য উন্নয়নের গুরুত্ব অনুধাবন করে জাতীয় শিক্ষা প্রতিবন্ধীদের জন্য উন্নয়নের গুরুত্ব অনুধাবন করে জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরামের উদ্যোগে প্রণীত জাতীয় নীতিমালা করা হয়েছে। বিভিন্ন আথর্-সামাজিক উন্নয়ন কমর্কাÐের সঙ্গে জড়িত সংগঠনগুলো ও এগিয়ে আসছে; কিন্তু উপযুক্ত অথর্ তহবিল না থাকায় বইয়ের সব কাজ পিছিয়ে পড়ছে। প্রতিবন্ধিতা নানান ধরনের হলেও তার স্বাভাবিক ভাবে কাযর্ক্রম করার অধিকার আছে। একজন প্রতিবন্ধীর স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য স্বাভাবিক চলাফেরা শিক্ষা কাযর্ক্রম চালিয়ে নেয়ার জন্য ব্রেইল পদ্ধতি ব্রেইল মুদ্রিত বই, টেপ রেকডার্র, ক্যাসেট, রাইটিং ফ্রেম, ছবি ও অন্যান্য শিক্ষা সহায়ক উপকরণ অপরিহাযর্। কিন্তু এসবের বেশির ভাগই আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, জাতিসংঘ সনদ দেশে বাস্তবায়ন করার জন্য প্রতিশ্রæতিবদ্ধ সরকার। প্রতিবন্ধীদের পরিবার, সমাজ ও জাতির বোঝা করে রেখে সমৃদ্ধির পথে এগোনো সম্ভব নয়। তাদের মধ্যে রয়েছে সম্ভাবনার অনেক পথ। তাদের জন্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সফলতার পথ দেখাতে হবে। প্রতিবছর এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের পর আমরা অনেক কৃতী শিক্ষাথীের্দর খবর পাই যারা প্রতিদ্ব›িদ্বতার সঙ্গে লড়াই করে ভালো ফলাফল করছে। কিন্তু এই ভালো ফলাফল নিয়ে তারা সামনে এগিয়ে যেতে পারে না। ওদের সম্ভাবনা ও সফলতার পথ বন্ধ করে দেয় তাদের অধিকারও আইনের দুবর্ল ব্যবস্থাপনা। উচ্চ পযাের্য়র ভালো ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় বিভিন্ন কোটা থাকলেও প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটাব্যবস্থাই নেই। অথচ তারা একটু সুযোগ-সুবিধা পেলেই ভালো কাজে মনোনিবেশ ঘটাতে পারে। প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষায়িত শিক্ষার পাশাপাশি প্রতিবন্ধীদের মূলধারায় বাধ্যতামূলক ভতির্র সিদ্ধান্ত এবং শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ খুব প্রয়োজন। নেপোলিয়ান বলেছেন, ‘আমাকে তোমরা একটি শিক্ষিত মা দাও আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিব।’ মা সে যদি প্রতিবন্ধীও হয় তারপরও তার সুস্থ সুন্দর শিশু আগামী দিনের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ হয়ে সমাজ ও দেশের মঙ্গল বয়ে আনতে পারবে। সুযোগ-সুবিধা পেলে প্রতিবন্ধী মা ও শিশু নয় সবাই পারে উজ্জ্বল জীবনের দিকে যেতে। শুধু প্রয়োজন তাদের অধিকার তাদের আইনগুলোকে বাস্তবায়ন করা। কুসংস্কার নয়Ñ মানুষ হিসেবে তার অধিকার আর প্রতিবন্ধী হিসেবে তার পাওয়া নীতিগুলোর বাস্তবায়ন হোক আমাদের এই ১ কোটি ৭০ লাখ নাগরিকদের প্রাপ্য অধিকার।