দেশে বাল্যবিয়ে ২৫ বছরে সর্বোচ্চ

করোনা যতটা শৈশব কেড়েছে ততটা জীবন কেড়ে নেয়নি

পরিসংখ্যান বলছে দেশে প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার শতকরা ১৭ ভাগ। আর মাধ্যমিক পর্যায়ে শতকার ৩৭ ভাগ। তবে করোনায় এ সংখ্যা বেড়েছে বলে আশঙ্কা করছে সরকার। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডও আগামী শিক্ষাবর্ষে ৭৭ লাখ বই কম ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

প্রকাশ | ২৫ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০

ম নন্দিনী ডেস্ক
করোনা মহামারির সময় বাল্যবিয়ে বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে মেয়েদের ঝরে পড়া বেড়েছে।ু কিন্তু দেশজুড়ে মোট ঝরে পড়া স্কুলছাত্রীর সংখ্যা কত তা নিয়ে এখনো সরকারি বা বেসরকারি কোনো জরিপ হয়নি। বাল্যবিয়ের কারণে কী পরিমাণ স্কুলছাত্রী ঝরে পড়েছে সে সংখ্যা জানা না গেলেও কিছু বেসরকারি সংস্থা বলছে করোনার সময়ে দেশজুড়েই উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে বাল্যবিয়ের ঘটনা। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এক গবেষণা বলছে, দেশে করোনার কারণে বাল্যবিয়ে শতকরা ১৩ ভাগ বেড়েছে। গত ২৫ বছরে যা বাংলাদেশে সর্বোচ্চ। এদিকে সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার শতকরা ১৭ ভাগ। আর মাধ্যমিক পর্যায়ে শতকার ৩৭ ভাগ তবে করোনায় এ সংখ্যা বেড়েছে বলে আশঙ্কা করছে সরকার। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডও আগামী শিক্ষাবর্ষে ৭৭ লাখ বই কম ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার আলীপুর আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণিতে মোট ছাত্রী ৪৭০ জন। তাদের মধ্যে ৬৭ জনেরই চলতি বছর বিয়ে হয়ে গেছে। যাদের বিয়ে হয়েছে তারা সবাই অপ্রাপ্ত বয়স্ক। সাতক্ষীরা বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটির প্রধান সাকিবুর রহমান সরেজমিন গিয়ে এই তথ্য সংগ্রহ করেছেন। যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের সর্বোচ্চ বয়স ১৭ বছর। আর তাদের বেশির ভাগের বয়সই ১৬ বছর। তারা সবাই নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তবে ষষ্ঠ এবং সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিয়ের ঘটনাও ঘটেছে। সাকিবুর রহমান বলেন, ''করোনার সময়ে প্রধানত খরচ মেটাতে না পেরেই বাল্যবিয়ের এমন ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে অনলাইন ক্লাসের জন্য ইন্টারনেট ডাটা কেনা তাদের পরিবারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর অভিভাবকদের আয়ও কমে যায়।'' তিনি জানান, বিয়ে হওয়া এ ছাত্রীদের কেউই আর স্কুলে যাচ্ছে না। তিনি আরো দাবি করেন, স্কুল থেকেও বিবাহিত মেয়েদের স্কুলে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ তারা মনে করছেন, ওই মেয়েরা স্কুলে গিয়ে বিয়ের গল্প করলে অন্য মেয়েরাও বিয়েতে উৎসাহিত হতে পারে। আর যাদের বিয়ে হয়েছে তাদের অধিকাংশেরই কাবিন নেই। ফলে বয়স নিয়ে কোনো বাধার মুখে পড়তে হয়নি। শনিবার তালা উপজেলার শার্শা বাহারুল উলুম মাদ্রাসায় ঘুরে সাকিবুর রহমান জানান ওই মাদ্রাসায় মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১৬৯ জন। এর মধ্যে মোট ছাত্রী ৮৭ জন। ছাত্রীদের ৪০ জনের বিয়ে হয়ে গেছে। দশম শ্রেণির ১৮ জন ছাত্রীর মধ্যে ১১ জনের এবং অষ্টম শ্রেণির ১৮ জনের মধ্যে আটজনের বিয়ে হয়েছে। যাদের বিয়ে হয়েছে তারা আর মাদ্রাসায় আসছে না। আলীপুর আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধানশিক্ষক আবদুল লতিফ ছাত্রীদের বাল্যবিয়ের কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, 'এবার ৬৮ জনের এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল, কিন্তু পরীক্ষা দেবে ৪৭ জন। ২১ জন দিচ্ছে না। তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। দশম শ্রেণির ১৪-১৫ জনের বিয়ে হয়ে গেছে। আরও চার-পাঁচজন আছে বিয়ে হয়েছে। তারা নিচের ক্লাসে পড়ে।' তিনি বলেন, 'যাদের বিয়ে হয়েছে তারা যাতে স্কুলে আসে তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। শিক্ষকদের এলাকাভিত্তিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যাতে বাল্যবিয়ের ঘটনা না ঘটে।' এদিকে বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনাকালে বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ৬৫টি করে বাল্যবিয়ে হয়েছে। সাত মাসে ২১ জেলার ৮৪ উপজেলায় মোট ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিয়ের তথ্য পেয়েছে তারা। গত বছরের এপ্রিল মাস থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশের মোট ২১ জেলায় জরিপ চালিয়েছে সংস্থাটি। প্রতিষ্ঠানটির কো-অর্ডিনেটর অর্পিতা দাস বলেন, 'এই বাল্যবিয়ের কারণ হিসেবে আমরা যা জেনেছি তার মধ্যে রয়েছে স্কুল বন্ধ থাকায় মেয়েদের নিরাপত্তা সংকট, অভিভাবকদের কাজ হারানো এবং ব্যবসাবণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া। তাছাড়া বাল্যবিয়ের যেহেতু একটি ট্রেডিশন আছে তাই করোনাকে বিয়ে দেয়ার সুযোগ হিসেবে নিয়েছেন অনেকে।' তিনি জানান, যারা এই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে তারা সবাই স্কুলের ছাত্রী। আর বিয়েগুলো হয়েছে শুক্র-শনিবার বন্ধের দিন রাতে। তার মতে, 'তারা (বিয়ে হয়ে যাওয়া এসব ছাত্রী) সবাই শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়েছে। আমরা এখন যে খবর পাচ্ছি তাতে ড্রপআউটের তথ্য পাচ্ছি। আমরা সে কারণে আরেকটি জরিপ করব।'তিনি বলেন, করোনার সময় বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের কারণে ঠিক কি পরিমাণ ছাত্রী ঝরে পড়েছে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ এখনো কোনো পূর্ণাঙ্গ জরিপ হয়নি। মেয়েদের ড্রপআউট হয়ে যাওয়ার বিষয়ে আলাদাভাবে কাজ না হলেও করোনাকালে ড্রপআউট শিক্ষার্থীদের তালিকা তৈরির কাজ করছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি। অনলাইন ক্লাসে অনুপস্থিতি ধরে একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে ওই তালিকা করা হয়। মোংলা উপজেলা শিক্ষা অফিসার (প্রাথমিক) সুমন্ত পোদ্দার দুই সপ্তাহ আগে জানান, 'আমাদের কাছে যে তালিকা পাঠানো হয়েছে তাতে প্রাথমিকে শতকরা ৫০ ভাগের মতো ড্রপআউট দেখানো হয়েছে। এখন আমরা এটা সরেজমিন পরীক্ষা করে দেখছি। কাজ শেষ করতে আরও কিছু দিন সময় লাগবে।' দেশের ৬৪ জেলার ৩৪৫টি উপজেলা, সব সিটি করপোরেশন এবং ১৫টি শহরে এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এদিকে সারাদেশে বাংলা মাধ্যমের কিন্ডারগার্টেন স্কুল ছিল ৪০ হাজার। করোনার কারণে এই ধরনের ১০ হাজার স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। এ স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের শতকরা ৫২ ভাগ মেয়ে বলে জানান বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব জি এম জাহাঙ্গীর কবির রানা।তিনি বলেন, 'বন্ধ হয়ে যাওয়া ১০ হাজার স্কুলের শিক্ষার্থীদের বড় অংশই অন্য কোথাও ভর্তি হয়নি। আর সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৪০ ভাগ শিক্ষার্থী স্কুলে ফিরেছে।' একটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, মহামারী করোনা ভাইরাসের কারণে রাজশাহী জেলায় সাড়ে ছয় হাজারের অধিক ছাত্রী বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছে। বেড়েছে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনাও। সংশ্লিষ্ট জেলা শিক্ষা অফিসের তথ্য মতে ষষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই লাখ ১২ হাজার ১৬৩ জন। এর মধ্যে ছাত্রী এক লাখ তিন হাজার ৪০৭ জন। এদের মধ্যে প্রায় ছয় হাজার ৫১২ ছাত্রী বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. একেএম মাহমুদুল হক বলেন, বাল্যবিয়ের ক্ষতিকর দিক নতুন করে তুলে ধরার কিছু নেই। করোনা যতজনের শৈশব, স্বপ্ন সুযোগ ও সম্ভাবনা কেড়ে নিয়েছে করোনা এতো জনের জীবনও কেড়ে নিতে পারেনি। বাল্যবিয়ের শিকার ছাত্রীর বেশির ভাগ শৈশব উপভোগ করতে পারবেনা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এ ক্ষতিকর প্রভাব থাকবে।