শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় নারী তাঁতশিল্পীরা

ম জোবায়েদ মলিস্নক বুলবুল
  ২৫ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০

অভাব অনটনে তাঁত শিল্পীদের ঘরে আজ হাহাকার। কাজ নেই, তাই ঘরে খাবার নেই, পরনে তার পুরনো কাপড়। ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে যাবে সে অবস্থাও নেই। তাঁত মালিকরা টাকার অভাবে তাঁতে তেনা দিতে (সুতা উঠানো) পারছে না। বৈশ্বিক মহামারি করোনা তাঁতিদের পথে বসিয়েছে। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলছিলেন টাঙ্গাইলের শাড়ির রাজধানীখ্যাত পাথরাইলের পঞ্চাশোর্ধ বয়সি নারী তাঁত মালিক লাবনী বসাক।

প্রায় একই কথা বলেছেন, ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প পাথরাইলের অপর নারী উদ্যোক্তা বাসন্তী সূত্রধর, প্রতিমা বসাক, আলো বসাক, গীতা বসাক, দিপালী বসাক, কালিহাতী উপজেলার রামপুরের ফরিদা আক্তার, খালেদা বেগম, বলস্না গ্রামের আয়েশা আক্তার, নাসরিন আক্তার, নাছিমা খাতুন, বীরপাকুটিয়া গ্রামের জমেলা বেগম, বেহেলাবাড়ির ফারজানা ইয়াসমিন, মমিন নগরের আল্পনা আক্তারসহ অনেকে।

নারী উদ্যোক্তারা জানান, অত্যাধুনিকতা বাঙালির ঘর থেকে শাড়িকে বের করে দিয়েছে। জায়গা দখল করেছে সালোয়ার-কামিজ, থ্রি-পিসসহ অত্যাধুনিক পোশাক। শাড়ির বাজার ওইসব পোশাকের দখলে যাওয়ায় এমনিতেই তাঁত শিল্পের বারোটা বেজেছিল। একই সঙ্গে বাজারজাত সংকট, ঋণ পাওয়ায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সুতা আমদানিতে শুল্ক, রপ্তানি সমস্যা তো ছিলই। তারপরও পৈত্রিক ঐতিহ্য রক্ষায় এবং অন্য কাজে অভিজ্ঞ না হওয়ায় অনেকে তাঁত শিল্পকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল। কিন্তু মহামারি করোনা তাঁত শিল্পকে একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে। করোনাকালে বৃহত্তর স্বার্থে লকডাউনে দীর্ঘ ৮ মাস তাঁত ফ্যাক্টরি বন্ধ ছিল।

তাঁত শাড়ির নারী উদ্যোক্তারা আরও জানান, প্রথম দফা করোনায় লকডাউনের পরই বন্যার থাবা। আবার দ্বিতীয় দফায় করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসাবাণিজ্যে যেমন ধস নামে। তেমনই তাঁতিদেরও কপাল পুড়ে। ফ্যাক্টরি বন্ধ রাখায় তাঁতে থাকা ভিমের তানায় (শাড়ি তৈরির সুতার কুন্ডলী) পোকার আক্রমণ মারাত্মক ক্ষতি করে। এরপরই বন্যার পানিতে তাঁত সরঞ্জামাদিগুলো বিনষ্ট হয়ে যায়।

স্থানীয় তাঁত শিল্পের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৈশ্বিক মহামারি করোনা ও বন্যার ধকল কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প। দুর্যোগকালীন সরকারি প্রণোদনা না পাওয়ায় লক্ষাধিক তাঁত শ্রমিক ও চার হাজারেরও বেশি তাঁত মালিক বেকার হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড (বাতাঁবো) ঋণ সহযোগিতা না করায় দেখা দিয়েছে পুঁজি সংকট। এতে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক তাঁত মালিকরা শাড়ি উৎপাদনে যেতে পারছেন না। অনেকেই বাধ্য হয়ে ঝুঁঁকে পড়ছেন ভিন্ন পেশায়।

টাঙ্গাইল জেলায় তাঁত শিল্প ও তাঁতিদের উন্নয়নের জন্য স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের (বাতাঁবো) কালিহাতী বেসিক সেণ্টারে ১৭টি প্রাথমিক তাঁতি সমিতির এক হাজার ৮৮৪ জন ক্ষুদ্র তাঁত মালিকের ২১ হাজার ৯৭৩টি তাঁত রয়েছে। টাঙ্গাইল সদর (বাজিতপুর) বেসিক সেন্টারে ৩২টি প্রাথমিক তাঁতি সমিতির দুই হাজার ২৬৭ জন ক্ষুদ্র তাঁত মালিকের ১২ হাজার ৪২৯টি তাঁত রয়েছে। এসব তাঁতের চার হাজার ১৫১ জন ক্ষুদ্র তাঁত মালিকের অধীনে এক লাখ তিন হাজার ২০৬ জন তাঁত শ্রমিক জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। এর মধ্যে ৩৪ হাজার ৪০২ জন নারী এবং ৬৮ হাজার ৮০৪ জন পুরুষ রয়েছেন। তাঁত মালিক তথা তাঁত শিল্পের নারী উদ্যোক্তাদের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান বাতাঁবোর কাছে নেই। তবে তাঁত মালিকদের কাছ থেকে জানা যায়, জেলার তাঁত শিল্পে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা প্রায় দেড়শ'।

বাতাঁবো স্থানীয় বেসিক সেন্টারের কর্মকর্তা, তাঁত মালিক, তাঁত শ্রমিক ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটি তাঁতে নূ্যনতম তিনজন নারী-পুরুষ প্রত্যক্ষভাবে শ্রম দিয়ে থাকেন। তিন জনের মধ্যে আবার একজন নারী। একজন তাঁতে কাপড় বোনে, একজন চরকায় কাপড় বুননের সুতা (নলি বা ছিটা) কাটেন, একজন কাপড়ের নকশার সুতা কটেন (ড্রপ কাটা)। এছাড়া সুতা রঙ করা, শুকানো, পাটিকরা, তানার সুতা কাটা, ড্রাম থেকে ভিমে সুতা পেঁচানো, তানা সাজানো, মালা বা নকশার ডিজাইন তোলা, কাপড় ভাঁজ করা, পেটি করা এবং বাজারজাত ও আনা-নেওয়ার জন্যও শ্রমিকের প্রয়োজন হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে